পাওয়েল স্ট্রিটে পথ হারিয়ে by শিহাব সরকার
শৈশব থেকেই রাজপথ আমার জীবনে ওতপ্রোত
জড়িয়ে আছে। ঢাকায় জন্মেছি। সেই থেকে আজ অবধি এই নগরীতেই_ মাঝেমধ্যে শহর বা
দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ছাড়া। সেই ষাট দশকে আমার শৈশব-কৈশোর থেকে ঢাকার
ছোট-বড় রাজপথের বেড়ে ওঠা দেখে এসেছি।
আমার চোখের সামনে
এগুলোর পরিসর ও ব্যস্ততা বেড়েছে; বদলেছে অবয়ব। আগে ঢাকার রাস্তার রিকশা বা
ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াবার আনন্দ ছিল। যানজটের চিন্তা থাকত না মাথায়।
গায়ে গায়ে লেগে যানবাহন পথে স্থবির হয়ে থাকত না। তখন ছিল গাড়িতে করে
স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াবার দিন। তবে মাঝেমধ্যে হঠাৎ ছন্দপতনের মতো ঘটে যেত
সড়ক দুর্ঘটনা। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ট্রাক চলত বেপরোয়া গতিতে। ফলে ট্রাককে
কেন্দ্র করে রোড অ্যাক্সিডেন্টের একটা প্রকোপ ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এই
বিকট-দর্শন যানটির দৌরাত্ম্য ঢাকায় এমন বেড়ে যায় যে, এটি শহরের মানুষদের
জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
গত পঞ্চাশ বছর ধরে ঢাকার রাজপথ বা জনপথগুলো কত পালাবদলই না অতিক্রম করে এসেছে! কত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই পথগুলো! এক অর্থে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে ঢাকার রাজপথের রয়েছে এক বিশাল ভূমিকা। পৃথিবীর খুব অল্প শহরের রাজপথ মানুষের জাতীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এমন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে, যেমন দেখি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। তবে রাজপথের অন্য এক চেহারাও আছে। রাজপথকে বলা যেতে পারে নগর জীবনের ধমনী। একটি দেশের নাগরিক বাস্তবতাকে বুঝতে হলে দেখতে হয় সে দেশের রাজপথগুলোকে।
রাজপথে চলতে ফিরতে আমার বেশ লাগে। আবার বিদেশে রাজপথের কিছু বাড়তি আকর্ষণ আছে। ধনী দেশের রাজপথের চরিত্র একেবারে ভিন্ন। এদের বড় মহানগরীগুলোর এভিনিউ বা বড় রাস্তাগুলোতে একটা মৃদু কোলাহল ঠিকই আছে। কিন্তু সেটা মোটেই আমাদের মতো কান ঝালাপালা করার মতো নয়। সেই শব্দ অনেকটা গুঞ্জনের মতো। গাড়ি চলাচলের শব্দ ছাপিয়ে ফুটপাত বা সাইডওয়াক থেকে পথ চলতে মানুষের টুকরো কথাবার্তা বা হাসির শব্দ ভেসে আসে। কোনো হাঁকডাক নেই কোথাও। ওয়াশিংটন ডিসির মতো বড় শহরের কোনো কোনো রাস্তায় গাড়ি বা ফুটপাতে মানুষ চোখেই পড়ে না প্রায়। নিউইয়র্ক তার উল্টো। রাজপথে প্রচুর গাড়ি। বিকেলে যানজট লাগে কোনো কোনো দিন। সাইডওয়াক ধরে ছুটছে নানা জাতির মানুষ। এত গাড়ির চলাচল সত্ত্বেও নিউইয়র্কে হর্নের উৎপাত নেই। সামান্য পরপর একটাই ভারি, গুমগুম শব্দ পওয়া যায়_ যখন মাটির নিচ দিয়ে সাবওয়ে বা পাতাল রেল ছোটে।
আমেরিকা বা ইউরোপের বড় শহরগুলোতে চোর-বাটপারের ভয় তেমন নেই। কারণ সারাক্ষণ রাস্তায় আছে পুলিশের টহল গাড়ি। তবুও বড় দোকান থেকে পাউরুটি চুরি করে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে পড়ি-মরি দৌড়ে পালাতে দেখেছি নিউ অরলিন্সের রাস্তায়। প্রচুর দালানকোঠা আছে। এর পরও লুজিয়ানার রাজধানী নিউ অরলিন্স আমেরিকার দরিদ্র শহরগুলোর একটি। ধনী-গরিবের প্রচণ্ড ফারাক এ শহরে। একদিকে নাইট ক্লাবে ভরা ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার, অন্যদিকে অভাব-বঞ্চনায় জরাজীর্ণ ব্ল্যাকদের লোকালয়। বড় শহরে আছে পথ হারানোর ভয়। এটা সাধারণত হয় শহর বিশেষের ভাষা না জানা অথবা ট্রাফিক আইন বা সংকেত চিহ্ন না বোঝার কারণে। আমি শহরে বড় হয়েছি, ইংরেজিও জানি মোটামুটি। এর পরও আমি নিউইয়র্ক এবং সানফ্রান্সিসকোতে পথ হারিয়েছি। সেটা অবশ্য কাগজে লেখা ঠিকানার কিছু শব্দ পরিষ্কার না বোঝার কারণে। ধনী দেশের রাজপথে পথ হারালে ঘাম ছোটে ঠিকই, কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিয়ে বা ট্যাক্সিতে চড়ে নির্বিঘ্নে সঠিক গন্তব্যে পেঁৗছানো যায়। হোটেলের ঠিকানা লেখা কার্ড বা শহরের প্রধান ভাষায় নির্ধারিত গন্তব্যের হদিস লেখা চিরকুট খুব কাজে দেয় ওই সময়।
একবার চার-পাঁচজন মিলে ঘুরছি সানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত পাওয়েল স্ট্রিটে। ছোট দলটিতে ছিলাম আইওয়া রাইটার্স প্রোগ্রাম শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ক'টি স্টেট ঘুরতে বেরুনো লেখকরা। অন্য লেখকরা গেছেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে। আমাদের গ্রুপে ছিলেন ভারত, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া এবং মোজাম্বিকের ক'জন লেখক। আর ছিলেন আমেরিকান গাইড কেরি কিজ এবং ওর গার্লফ্রেন্ড। পাওয়েল স্ট্রিটে পা দেওয়ামাত্র বাঁশের বাঁশি এবং আরও কিছু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ পেলাম। যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় চারদিক আমোদিত হয়ে আছে। শেষ বিকেল। সূর্যাস্তের ঠিক আগমুহূর্তের কাঁচাসোনা রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে মনোরম সানফ্রান্সিসকো নগরী। দলে দলে মানুষ ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রচুর পর্যটকও দেখা গেল। পাওয়েল স্ট্রিট এই নগরীতে আসা ট্যুরিস্টদের জন্য প্রধান এক আকর্ষণ। চওড়া সড়কের দু'পাশের সাইডওয়াকে উৎসবের আমেজ লেগেই আছে। কোথাও গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে তরুণ-তরুণীর যুগল নাচ, ছবি উঠছে ক্লিক ক্লিক। কোথাও গান বা যন্ত্রসঙ্গীত, কোথাও ম্যাজিক বা কৌতুক। আমার কানে বাজছিল শুরুতেই শোনা বাঁশির শব্দ। বিষাদ মাখা, সুরেলা টানটা আমি ভুলতে পারছিলাম না। এক দুর্নিবার আকর্ষণে আমি চলে এলাম যন্ত্রসঙ্গীতের স্পটে। মোটামুটি ভিড়। সঙ্গে বাকি সবাই। দেখলাম দুই তামাটে রঙের তরুণ বিভোর হয়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। এক বৃদ্ধ টুলে বসে বাজাচ্ছেন কঙ্গো, একজন ম্যান্ডোলিন। কেরি এই ব্যান্ড গ্রুপটিকে চেনেন। উনি আমাদের জানালেন, ওরা পেরু থেকে এসেছে। নিজেদের বাজানো যন্ত্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বা সিডি বিক্রি করে জীবন চলে ওদের। বাঁশি শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল, সবুজ ঘন অরণ্যে ছাওয়া পর্বতের ঢালে ইন্কা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে আমি দাঁড়িয়ে আছি। একটা তীব্র ঘোর আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
পেরুর গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বাঁশির মূর্ছনায় আমি যতটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম, অন্যদের ক্ষেত্রে বোধহয় সেটা হয়নি। কেরি, মাঙ্গালেশ ও অন্যরা ফুটপাতে দাঁড়ানো ঝলমলে দোকানগুলোতে উইন্ডোশপিং করছিলেন। ওরা আমাকে হাত তুলে ওদের কাছে যেতে বললেন। আমি ইশারায় বললাম, আসছি। মিনিট পাঁচ-সাত কেটে গেল। যন্ত্রসঙ্গীত আপাতত শেষ। যে বৃদ্ধ ছিলেন কঙ্গো হাতে, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন। আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের বাজনা শুনছি_ এটা দেখে তার খুব ভালো লেগেছে বলে মনে হলো। ফুটপাতে একটা নকশিদার শতরঞ্জিতে জড়ানো ক্যাসেট এবং সিডি। বেশ আগের কথা। তখনও ক্যাসেটের যুগ শেষ হয়নি। বৃদ্ধ একটা ক্যাসেট তুলে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, 'ফ্রম ইন্ডিয়া?' আমি বললাম, 'বাংলাদেশ'। উনি কী বুঝলেন কে জানে! বললেন, 'ইউ উইল লাইক ইট।' দাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, ত্রিশ ডলার। টাকার অঙ্ক শুনে আমি ঢোক গিললাম। বিদেশে হঠাৎ এতগুলো টাকা খরচ করে ক্যাসেট কেনা অবিবেচকের কাজ হবে। ডলার ছিল পকেটে। কিন্তু বহু খরচ বাকি। ইমার্জেন্সি তো আছেই। দশ-বারো ডলার দাম হলে কেনা যেত। ক্যাসেটটা আমি উল্টেপাল্টে দেখি। একটা সুন্দর পাহাড়ি লাতিন আমেরিকান গ্রামের ছবি আছে। লেখাগুলো সব স্প্যানিশ ভাষায়। কিছু কিছু শব্দ বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা যায়। কিন্তু মানে দাঁড় করাতে পারছি না।
_টেক ইট। ইট ইজ গুড মিউজিক। স্প্যানিশ টানে বৃদ্ধ বললেন। আমি মলিন মুখে বললাম, 'আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট মাচ মানি।' বৃদ্ধ কিছু ভাবলেন, আমার মুখের ওপর চোখ রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, 'ওকে, দেন টেক ইট। দিস ইজ গিফ্ট ফ্রম মি।' ঘটনার আকস্মিকতায় এবং খুশিতে চোখ ভিজে এলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছলাম। বোধ হয়, এটাকেই বলে একজন শিল্পী এবং শিল্পানুরাগীর চিরায়ত আত্মিক যোগাযোগ। আবেগাপ্লুত ভাষায় ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বৃদ্ধ এবং অন্য শিল্পীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফুটপাতের উল্টোদিকে দোকানটার সামনে এলাম। এখানেই আমার লেখক-বন্ধুরা উইন্ডোশপিং করছিলেন। ওরা কেউ নেই ওখানে। হয়তো আমার দেরি দেখে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। ফুটপাত ঘেঁষে দোকানের সারি। নানা ধরনের বাহারি দোকান। আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অনেক দূর। আমার বন্ধুরা কেউ নেই। মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিছুটা ভয়ও লাগছিল। ভিড়ভাট্টা তেমন নেই, কিন্তু ছড়ানো ছিমছাম শহর সানফ্রান্সিসকো। ট্যুরিস্ট স্পটের অভাব নেই। আমরা শুধু গিয়েছি পৃথিবীর প্রথম ঝুলন্ত ব্রিজ, বিখ্যাত গোল্ডেন গেট, প্রশান্ত মহাসাগরের কূলঘেঁষা স্টিনসন সৈকত এবং চায়না টাউনে। আগামী ক'দিন যাওয়ার কথা আছে আইল্যান্ড অব আলকাতরাসের পাশে কিয়ট টাওয়ার, বে-ফ্রন্ট ইত্যাদি জায়গা এবং হাজার বছরের পুরনো অরণ্য মিউর উডসে। এই বনের ভেতরেই এক জায়গায় লিগ অব নেশনসের অবলুপ্তির পর বর্তমান জাতিসংঘের গঠন সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক বৈঠক হয়। আমাদের যাওয়ার কথা আছে সানফ্রান্সিসকো মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে। ওখানে আছে পিকাসো, মাতিস, ব্রেকমেন, গগ্যাঁ প্রমুখ বড় শিল্পীর মূল চিত্রকর্ম। হেনরি মুর এবং অন্যান্য শিল্পীর ভাস্কর্যও আছে। আছে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের প্রচুর নিরীক্ষাধর্মী কাজ। কেরি এবং অন্যদের খুঁজে না পেয়ে আমি কিছুটা মুষড়ে পড়লাম। কী করে হোটেলে ফিরব কে জানে! ভুলে হোটেলের কার্ড নেওয়া হয়নি। শুধু নামটা মনে আছে। তীব্র উৎকণ্ঠার ভেতর এলোমেলো হাঁটছি আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। বেশকিছু নাকচাপা এবং উপমহাদেশীয় চেহারার মানুষ চোখে পড়ল। কিন্তু আমার সঙ্গীরা কেউ নেই কোথাও। ঘড়ি দেখলাম। ৮টা বাজে। ভিড় ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দোকানের শাটার নামাচ্ছে মহিলা ও পুরুষ কর্মচারীরা।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ঝলমলে নিয়ন সাইন, রাস্তার ওপারে 'থাই রেস্টুরেন্ট'। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আমাদের গাইড কেরি একবার কথায় কথায় বলছিলেন, আমরা যেন কোনোভাবে সানফ্রান্সিসকোর থাই ফুড মিস না করি। এটা খাঁটি থাইল্যান্ডের খাবার। থাইল্যান্ডের মানুষ বংশপরম্পরায় এসব রেস্তোরাঁ চালিয়ে আসছে এ শহরে। এরা এখন আমেরিকার নাগরিক। আমি দ্রুত রাস্তা পার হয়ে থাই রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকি। মন বলছিল, এখানে আমার সঙ্গীদের পাবই। হায়, ধন্য আশা কুহকিনী! মানুষের সব আশা কি মেটে! ভেতরে খুব একটা ভিড় নেই। বিচ্ছিন্নভাবে নানা বয়সের মানুষ কাঠি দিয়ে তুলে থাই ফুড খাচ্ছে। আমি কোনার দিকে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। এক টেবিলে ক'জন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ-তরুণী খুব হল্লা করছে। এক সুবেশা থাই তরুণী নিঃশব্দে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। মুখে মিষ্টি হাসি, হাতে কাগজ-কলম। আমার এ সময় খিদে পাওয়ার কথা নয়, তারপর উদ্বেগে খিদে মরে গেছে। কিন্তু টের পেলাম থাই ফুডের গল্পটা আমাকে কাবু করে ফেলছে। ওদের খাবার অনেকটা চীনা ডিশের মতো। তবে থাইরা ফ্রায়েড রাইসের চেয়ে আঠালো চিকন চালের ভাত বেশি পছন্দ করে। আর খাবারের সঙ্গে থাকে প্রচুর সুগন্ধি লতাপাতা। আমাদের ধনেপাতা, পুদিনা পাতার মতো। থাই ফুডের স্বাদ আমি প্রথম নিই ঢাকা-ব্যাংকক থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে। আমি সাদা প্লাস্টিক শিটে মোড়ানো মেন্যুটা হাতে নিতে তরুণী আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
'থাই ফুডের ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। আপনি আমাকে হেলপ করুন'_ আমি বললাম। তরুণী জানতে চাইল, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। 'বাংলাদেশ' বলতেই তরুণী বলল, 'তাহলে আপনি বাঙালি?' আমি মাথা নাড়তে ও কয়েকটা ডিশের বর্ণনা দিয়ে গেল। অধিকাংশই মাছ, অর্থাৎ চিংড়িপ্রধান আইটেম। একটা ছিল বাঁশের কচি ডগা সিদ্ধ। আমি অবশ্য ওটা খেতে পারিনি। খাবারের আগে স্যুপটা ছিল দারুণ। ওটা মোটেই আমাদের দেশের থাই স্যুপের মতো নয়। বহুদিন পর তৃপ্তি নিয়ে আঠালো চালের ভাত খেলাম। চপ স্টিকের ব্যবহার জানি না। অগত্যা ছুরি, কাঁটা-চামচ এবং টেবিল স্পুনই ভরসা। তরুণী বারবার এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল, খাবার কেমন লাগছে। আমি বলে যাচ্ছিলাম 'গ্রেট, সুপার!'
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কফির অর্ডার দিলাম। খেলাম ধীরে ধীরে। এক সময় কফি শেষ। রেস্তোরাঁ ফাঁকা। কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ বেয়ারা টেবিল সাফসুতরো করে চেয়ার উল্টে রাখছিলেন। আমি অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাচ্ছি। যে সময়টার কথা বলছি, তখনও হাতে হাতে মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়নি। নইলে শুরুতেই আমার সঙ্গীদের কাউকে না কাউকে মোবাইলে ধরতাম। তরুণী কয়েকবার আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। আমি আড়চোখে ওর মুখটা খেয়াল করলাম। আমার ওপর বিরক্ত কি-না বোঝা গেল না।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে ১০টার ওপর। তরুণী এবার টেবিল ঘেঁষে সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুতভাবে হাসল। নমস্কারের ভঙ্গিতে দু'হাত জড়ো করে ও বলল, 'স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, উই আর ক্লোজড নাও।'
_ ও হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। অবশ্যই। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বললাম।
প্লেটে রাখা বিল আগেই দেখেছি। আমি একটা বড় ডলারের নোট প্লেটে রেখে বললাম, 'কিপ দ্য চেঞ্জ।' তরুণী অবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে তাকাল। বোধহয় এত বড় টিপস ওর প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
তরুণী রেস্তোরাঁর অফিসে ঢুকে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। এবার ওর মুখে লজ্জার হালকা একটা রক্তিম আভা। আমার ওপর ও সামান্য হলেও বিরক্ত হয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। বেচারা সারাদিন খেটেছে। এখন দরকার ওর লম্বা বিশ্রাম। হয়তো বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব করবে, নয়তো টিভি দেখবে। জানি না, ওর বাড়িতে কে কে আছে। এমনও হতে পারে, ও এখনও বিয়ে করেনি। নতুন সংসার গড়ার জন্য রেস্তোরাঁয় কাজ করে টাকা জমাচ্ছে। এমনও তো হতে পারে, ও এই রেস্তোরাঁর মালিক; সঙ্গে আছে মা-বাবা।
স্যার, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। আই ওয়াজ রুড উইথ ইউ। তরুণী মাথা নিচু করে বলল। বুঝলাম, ওর অনুশোচনা হচ্ছে আমাকে ওঠার ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য। অবশ্য আমার অনুমান ভুলও হতে পারে।
কী বলছেন? কিছুই হয়নি। বরং আমিই আপনাদের বিরক্ত করছি। আমি ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার একটা উপকার করবেন? আপনার লোকদের দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পারেন? আমার হোটেলের নাম ভুলে গেছি, সঙ্গে কার্ডও নেই। তবে নামটা বোধহয় হোটেল রামাদা বা রেমন্ড।
হোয়াট, হোটেল রামাদা? আমি ওই হোটেলের উল্টোদিকের লেনে থাকি। দেখেননি নীল তিনতলা বাড়িটা? ওটার দোতলায়। চলুন, চলুন। আমার গাড়ি আছে। এবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম থাই তরুণীর মুখে হালকা মেকআপ। ওদের জাতীয় ফুল জেসমিনের বডি স্প্রের সৌরভ আসছে ওর শরীর থেকে, পোশাক থেকে, চুল থেকে। চারদিক মাতোয়ারা।
পাওয়েল স্ট্রিট থেকে আমার হোটেল অনেক দূর। তরুণী জানাল, রেমন্ড নামে কোনো হোটেল নেই এ শহরে। ও ভালো ড্রাইভ করে। রাতের ফাঁকা রাস্তা। ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে ও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসে থামল রামাদা হোটেলের সামনে। আমার বাংলাদেশের ঠিকানা দেওয়া ভিজিটিং কার্ড রাখল ও। ওর কার্ডও দিল আমাকে। কিন্তু ওই কার্ড ঢাকায় পেঁৗছেনি। আমেরিকার আরও কিছু জায়গায় আমি বেশ কয়েকদিন ছিলাম। একটানা ভ্রমণ। এর মধ্যে অজস্র কাগজপত্রের ভেতরে পড়ে গোলাপি ছোট্ট ভিজিটিং কার্ডটা কখন হারিয়ে গেছে টের পাইনি।
ঢাকা পেঁৗছার তিন-চার মাস পর আমি থাই তরুণীর চিঠি পেলাম। আমাকে নিনি ভোলেনি। ও লিখেছে, কৈশোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউইয়র্কে এক শ্রীলংকান তরুণকে ও লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। ওর মা-বাবা বিয়েটা কিছুতে মেনে নিতে পারেনি। যদিও ছেলেটা ছিল ওদের মতোই বৌদ্ধ। দুঃখে-শোকে শ্রীলংকান তরুণ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। স্থান হয় মেন্টাল অ্যাসাইলামে। ওখানেই ও ধুঁকতে ধুঁকতে অল্পদিনের মধ্যে মারা যায়। চিঠির শেষ দিকে আমি ধাক্কাটা খেলাম।
নিনি লিখেছে, আমার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, কণ্ঠ_ সবকিছুর সঙ্গে ওই শ্রীলংকান ছেলেটার মিল আছে। কবেকার কথা! চোখ বুজলেই আমি নিনিকে দেখতে পাই। ওর চিঠির সঙ্গে পাঠানো ছোট্ট পার্সেলে একটা বক্সে ছিল এক ডজন শিশি। জেসমিন ফুলের পারফিউম। টলটলে জলের রঙ। নিনির মনের রঙ। হ
গত পঞ্চাশ বছর ধরে ঢাকার রাজপথ বা জনপথগুলো কত পালাবদলই না অতিক্রম করে এসেছে! কত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই পথগুলো! এক অর্থে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে ঢাকার রাজপথের রয়েছে এক বিশাল ভূমিকা। পৃথিবীর খুব অল্প শহরের রাজপথ মানুষের জাতীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এমন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে, যেমন দেখি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। তবে রাজপথের অন্য এক চেহারাও আছে। রাজপথকে বলা যেতে পারে নগর জীবনের ধমনী। একটি দেশের নাগরিক বাস্তবতাকে বুঝতে হলে দেখতে হয় সে দেশের রাজপথগুলোকে।
রাজপথে চলতে ফিরতে আমার বেশ লাগে। আবার বিদেশে রাজপথের কিছু বাড়তি আকর্ষণ আছে। ধনী দেশের রাজপথের চরিত্র একেবারে ভিন্ন। এদের বড় মহানগরীগুলোর এভিনিউ বা বড় রাস্তাগুলোতে একটা মৃদু কোলাহল ঠিকই আছে। কিন্তু সেটা মোটেই আমাদের মতো কান ঝালাপালা করার মতো নয়। সেই শব্দ অনেকটা গুঞ্জনের মতো। গাড়ি চলাচলের শব্দ ছাপিয়ে ফুটপাত বা সাইডওয়াক থেকে পথ চলতে মানুষের টুকরো কথাবার্তা বা হাসির শব্দ ভেসে আসে। কোনো হাঁকডাক নেই কোথাও। ওয়াশিংটন ডিসির মতো বড় শহরের কোনো কোনো রাস্তায় গাড়ি বা ফুটপাতে মানুষ চোখেই পড়ে না প্রায়। নিউইয়র্ক তার উল্টো। রাজপথে প্রচুর গাড়ি। বিকেলে যানজট লাগে কোনো কোনো দিন। সাইডওয়াক ধরে ছুটছে নানা জাতির মানুষ। এত গাড়ির চলাচল সত্ত্বেও নিউইয়র্কে হর্নের উৎপাত নেই। সামান্য পরপর একটাই ভারি, গুমগুম শব্দ পওয়া যায়_ যখন মাটির নিচ দিয়ে সাবওয়ে বা পাতাল রেল ছোটে।
আমেরিকা বা ইউরোপের বড় শহরগুলোতে চোর-বাটপারের ভয় তেমন নেই। কারণ সারাক্ষণ রাস্তায় আছে পুলিশের টহল গাড়ি। তবুও বড় দোকান থেকে পাউরুটি চুরি করে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে পড়ি-মরি দৌড়ে পালাতে দেখেছি নিউ অরলিন্সের রাস্তায়। প্রচুর দালানকোঠা আছে। এর পরও লুজিয়ানার রাজধানী নিউ অরলিন্স আমেরিকার দরিদ্র শহরগুলোর একটি। ধনী-গরিবের প্রচণ্ড ফারাক এ শহরে। একদিকে নাইট ক্লাবে ভরা ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার, অন্যদিকে অভাব-বঞ্চনায় জরাজীর্ণ ব্ল্যাকদের লোকালয়। বড় শহরে আছে পথ হারানোর ভয়। এটা সাধারণত হয় শহর বিশেষের ভাষা না জানা অথবা ট্রাফিক আইন বা সংকেত চিহ্ন না বোঝার কারণে। আমি শহরে বড় হয়েছি, ইংরেজিও জানি মোটামুটি। এর পরও আমি নিউইয়র্ক এবং সানফ্রান্সিসকোতে পথ হারিয়েছি। সেটা অবশ্য কাগজে লেখা ঠিকানার কিছু শব্দ পরিষ্কার না বোঝার কারণে। ধনী দেশের রাজপথে পথ হারালে ঘাম ছোটে ঠিকই, কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিয়ে বা ট্যাক্সিতে চড়ে নির্বিঘ্নে সঠিক গন্তব্যে পেঁৗছানো যায়। হোটেলের ঠিকানা লেখা কার্ড বা শহরের প্রধান ভাষায় নির্ধারিত গন্তব্যের হদিস লেখা চিরকুট খুব কাজে দেয় ওই সময়।
একবার চার-পাঁচজন মিলে ঘুরছি সানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত পাওয়েল স্ট্রিটে। ছোট দলটিতে ছিলাম আইওয়া রাইটার্স প্রোগ্রাম শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ক'টি স্টেট ঘুরতে বেরুনো লেখকরা। অন্য লেখকরা গেছেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে। আমাদের গ্রুপে ছিলেন ভারত, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া এবং মোজাম্বিকের ক'জন লেখক। আর ছিলেন আমেরিকান গাইড কেরি কিজ এবং ওর গার্লফ্রেন্ড। পাওয়েল স্ট্রিটে পা দেওয়ামাত্র বাঁশের বাঁশি এবং আরও কিছু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ পেলাম। যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় চারদিক আমোদিত হয়ে আছে। শেষ বিকেল। সূর্যাস্তের ঠিক আগমুহূর্তের কাঁচাসোনা রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে মনোরম সানফ্রান্সিসকো নগরী। দলে দলে মানুষ ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রচুর পর্যটকও দেখা গেল। পাওয়েল স্ট্রিট এই নগরীতে আসা ট্যুরিস্টদের জন্য প্রধান এক আকর্ষণ। চওড়া সড়কের দু'পাশের সাইডওয়াকে উৎসবের আমেজ লেগেই আছে। কোথাও গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে তরুণ-তরুণীর যুগল নাচ, ছবি উঠছে ক্লিক ক্লিক। কোথাও গান বা যন্ত্রসঙ্গীত, কোথাও ম্যাজিক বা কৌতুক। আমার কানে বাজছিল শুরুতেই শোনা বাঁশির শব্দ। বিষাদ মাখা, সুরেলা টানটা আমি ভুলতে পারছিলাম না। এক দুর্নিবার আকর্ষণে আমি চলে এলাম যন্ত্রসঙ্গীতের স্পটে। মোটামুটি ভিড়। সঙ্গে বাকি সবাই। দেখলাম দুই তামাটে রঙের তরুণ বিভোর হয়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। এক বৃদ্ধ টুলে বসে বাজাচ্ছেন কঙ্গো, একজন ম্যান্ডোলিন। কেরি এই ব্যান্ড গ্রুপটিকে চেনেন। উনি আমাদের জানালেন, ওরা পেরু থেকে এসেছে। নিজেদের বাজানো যন্ত্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বা সিডি বিক্রি করে জীবন চলে ওদের। বাঁশি শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল, সবুজ ঘন অরণ্যে ছাওয়া পর্বতের ঢালে ইন্কা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে আমি দাঁড়িয়ে আছি। একটা তীব্র ঘোর আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
পেরুর গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বাঁশির মূর্ছনায় আমি যতটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম, অন্যদের ক্ষেত্রে বোধহয় সেটা হয়নি। কেরি, মাঙ্গালেশ ও অন্যরা ফুটপাতে দাঁড়ানো ঝলমলে দোকানগুলোতে উইন্ডোশপিং করছিলেন। ওরা আমাকে হাত তুলে ওদের কাছে যেতে বললেন। আমি ইশারায় বললাম, আসছি। মিনিট পাঁচ-সাত কেটে গেল। যন্ত্রসঙ্গীত আপাতত শেষ। যে বৃদ্ধ ছিলেন কঙ্গো হাতে, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন। আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের বাজনা শুনছি_ এটা দেখে তার খুব ভালো লেগেছে বলে মনে হলো। ফুটপাতে একটা নকশিদার শতরঞ্জিতে জড়ানো ক্যাসেট এবং সিডি। বেশ আগের কথা। তখনও ক্যাসেটের যুগ শেষ হয়নি। বৃদ্ধ একটা ক্যাসেট তুলে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, 'ফ্রম ইন্ডিয়া?' আমি বললাম, 'বাংলাদেশ'। উনি কী বুঝলেন কে জানে! বললেন, 'ইউ উইল লাইক ইট।' দাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, ত্রিশ ডলার। টাকার অঙ্ক শুনে আমি ঢোক গিললাম। বিদেশে হঠাৎ এতগুলো টাকা খরচ করে ক্যাসেট কেনা অবিবেচকের কাজ হবে। ডলার ছিল পকেটে। কিন্তু বহু খরচ বাকি। ইমার্জেন্সি তো আছেই। দশ-বারো ডলার দাম হলে কেনা যেত। ক্যাসেটটা আমি উল্টেপাল্টে দেখি। একটা সুন্দর পাহাড়ি লাতিন আমেরিকান গ্রামের ছবি আছে। লেখাগুলো সব স্প্যানিশ ভাষায়। কিছু কিছু শব্দ বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা যায়। কিন্তু মানে দাঁড় করাতে পারছি না।
_টেক ইট। ইট ইজ গুড মিউজিক। স্প্যানিশ টানে বৃদ্ধ বললেন। আমি মলিন মুখে বললাম, 'আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট মাচ মানি।' বৃদ্ধ কিছু ভাবলেন, আমার মুখের ওপর চোখ রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, 'ওকে, দেন টেক ইট। দিস ইজ গিফ্ট ফ্রম মি।' ঘটনার আকস্মিকতায় এবং খুশিতে চোখ ভিজে এলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছলাম। বোধ হয়, এটাকেই বলে একজন শিল্পী এবং শিল্পানুরাগীর চিরায়ত আত্মিক যোগাযোগ। আবেগাপ্লুত ভাষায় ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বৃদ্ধ এবং অন্য শিল্পীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফুটপাতের উল্টোদিকে দোকানটার সামনে এলাম। এখানেই আমার লেখক-বন্ধুরা উইন্ডোশপিং করছিলেন। ওরা কেউ নেই ওখানে। হয়তো আমার দেরি দেখে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। ফুটপাত ঘেঁষে দোকানের সারি। নানা ধরনের বাহারি দোকান। আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অনেক দূর। আমার বন্ধুরা কেউ নেই। মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিছুটা ভয়ও লাগছিল। ভিড়ভাট্টা তেমন নেই, কিন্তু ছড়ানো ছিমছাম শহর সানফ্রান্সিসকো। ট্যুরিস্ট স্পটের অভাব নেই। আমরা শুধু গিয়েছি পৃথিবীর প্রথম ঝুলন্ত ব্রিজ, বিখ্যাত গোল্ডেন গেট, প্রশান্ত মহাসাগরের কূলঘেঁষা স্টিনসন সৈকত এবং চায়না টাউনে। আগামী ক'দিন যাওয়ার কথা আছে আইল্যান্ড অব আলকাতরাসের পাশে কিয়ট টাওয়ার, বে-ফ্রন্ট ইত্যাদি জায়গা এবং হাজার বছরের পুরনো অরণ্য মিউর উডসে। এই বনের ভেতরেই এক জায়গায় লিগ অব নেশনসের অবলুপ্তির পর বর্তমান জাতিসংঘের গঠন সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক বৈঠক হয়। আমাদের যাওয়ার কথা আছে সানফ্রান্সিসকো মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে। ওখানে আছে পিকাসো, মাতিস, ব্রেকমেন, গগ্যাঁ প্রমুখ বড় শিল্পীর মূল চিত্রকর্ম। হেনরি মুর এবং অন্যান্য শিল্পীর ভাস্কর্যও আছে। আছে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের প্রচুর নিরীক্ষাধর্মী কাজ। কেরি এবং অন্যদের খুঁজে না পেয়ে আমি কিছুটা মুষড়ে পড়লাম। কী করে হোটেলে ফিরব কে জানে! ভুলে হোটেলের কার্ড নেওয়া হয়নি। শুধু নামটা মনে আছে। তীব্র উৎকণ্ঠার ভেতর এলোমেলো হাঁটছি আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। বেশকিছু নাকচাপা এবং উপমহাদেশীয় চেহারার মানুষ চোখে পড়ল। কিন্তু আমার সঙ্গীরা কেউ নেই কোথাও। ঘড়ি দেখলাম। ৮টা বাজে। ভিড় ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দোকানের শাটার নামাচ্ছে মহিলা ও পুরুষ কর্মচারীরা।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ঝলমলে নিয়ন সাইন, রাস্তার ওপারে 'থাই রেস্টুরেন্ট'। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আমাদের গাইড কেরি একবার কথায় কথায় বলছিলেন, আমরা যেন কোনোভাবে সানফ্রান্সিসকোর থাই ফুড মিস না করি। এটা খাঁটি থাইল্যান্ডের খাবার। থাইল্যান্ডের মানুষ বংশপরম্পরায় এসব রেস্তোরাঁ চালিয়ে আসছে এ শহরে। এরা এখন আমেরিকার নাগরিক। আমি দ্রুত রাস্তা পার হয়ে থাই রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকি। মন বলছিল, এখানে আমার সঙ্গীদের পাবই। হায়, ধন্য আশা কুহকিনী! মানুষের সব আশা কি মেটে! ভেতরে খুব একটা ভিড় নেই। বিচ্ছিন্নভাবে নানা বয়সের মানুষ কাঠি দিয়ে তুলে থাই ফুড খাচ্ছে। আমি কোনার দিকে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। এক টেবিলে ক'জন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ-তরুণী খুব হল্লা করছে। এক সুবেশা থাই তরুণী নিঃশব্দে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। মুখে মিষ্টি হাসি, হাতে কাগজ-কলম। আমার এ সময় খিদে পাওয়ার কথা নয়, তারপর উদ্বেগে খিদে মরে গেছে। কিন্তু টের পেলাম থাই ফুডের গল্পটা আমাকে কাবু করে ফেলছে। ওদের খাবার অনেকটা চীনা ডিশের মতো। তবে থাইরা ফ্রায়েড রাইসের চেয়ে আঠালো চিকন চালের ভাত বেশি পছন্দ করে। আর খাবারের সঙ্গে থাকে প্রচুর সুগন্ধি লতাপাতা। আমাদের ধনেপাতা, পুদিনা পাতার মতো। থাই ফুডের স্বাদ আমি প্রথম নিই ঢাকা-ব্যাংকক থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে। আমি সাদা প্লাস্টিক শিটে মোড়ানো মেন্যুটা হাতে নিতে তরুণী আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
'থাই ফুডের ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। আপনি আমাকে হেলপ করুন'_ আমি বললাম। তরুণী জানতে চাইল, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। 'বাংলাদেশ' বলতেই তরুণী বলল, 'তাহলে আপনি বাঙালি?' আমি মাথা নাড়তে ও কয়েকটা ডিশের বর্ণনা দিয়ে গেল। অধিকাংশই মাছ, অর্থাৎ চিংড়িপ্রধান আইটেম। একটা ছিল বাঁশের কচি ডগা সিদ্ধ। আমি অবশ্য ওটা খেতে পারিনি। খাবারের আগে স্যুপটা ছিল দারুণ। ওটা মোটেই আমাদের দেশের থাই স্যুপের মতো নয়। বহুদিন পর তৃপ্তি নিয়ে আঠালো চালের ভাত খেলাম। চপ স্টিকের ব্যবহার জানি না। অগত্যা ছুরি, কাঁটা-চামচ এবং টেবিল স্পুনই ভরসা। তরুণী বারবার এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল, খাবার কেমন লাগছে। আমি বলে যাচ্ছিলাম 'গ্রেট, সুপার!'
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কফির অর্ডার দিলাম। খেলাম ধীরে ধীরে। এক সময় কফি শেষ। রেস্তোরাঁ ফাঁকা। কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ বেয়ারা টেবিল সাফসুতরো করে চেয়ার উল্টে রাখছিলেন। আমি অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাচ্ছি। যে সময়টার কথা বলছি, তখনও হাতে হাতে মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়নি। নইলে শুরুতেই আমার সঙ্গীদের কাউকে না কাউকে মোবাইলে ধরতাম। তরুণী কয়েকবার আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। আমি আড়চোখে ওর মুখটা খেয়াল করলাম। আমার ওপর বিরক্ত কি-না বোঝা গেল না।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে ১০টার ওপর। তরুণী এবার টেবিল ঘেঁষে সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুতভাবে হাসল। নমস্কারের ভঙ্গিতে দু'হাত জড়ো করে ও বলল, 'স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, উই আর ক্লোজড নাও।'
_ ও হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। অবশ্যই। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বললাম।
প্লেটে রাখা বিল আগেই দেখেছি। আমি একটা বড় ডলারের নোট প্লেটে রেখে বললাম, 'কিপ দ্য চেঞ্জ।' তরুণী অবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে তাকাল। বোধহয় এত বড় টিপস ওর প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
তরুণী রেস্তোরাঁর অফিসে ঢুকে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। এবার ওর মুখে লজ্জার হালকা একটা রক্তিম আভা। আমার ওপর ও সামান্য হলেও বিরক্ত হয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। বেচারা সারাদিন খেটেছে। এখন দরকার ওর লম্বা বিশ্রাম। হয়তো বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব করবে, নয়তো টিভি দেখবে। জানি না, ওর বাড়িতে কে কে আছে। এমনও হতে পারে, ও এখনও বিয়ে করেনি। নতুন সংসার গড়ার জন্য রেস্তোরাঁয় কাজ করে টাকা জমাচ্ছে। এমনও তো হতে পারে, ও এই রেস্তোরাঁর মালিক; সঙ্গে আছে মা-বাবা।
স্যার, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। আই ওয়াজ রুড উইথ ইউ। তরুণী মাথা নিচু করে বলল। বুঝলাম, ওর অনুশোচনা হচ্ছে আমাকে ওঠার ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য। অবশ্য আমার অনুমান ভুলও হতে পারে।
কী বলছেন? কিছুই হয়নি। বরং আমিই আপনাদের বিরক্ত করছি। আমি ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার একটা উপকার করবেন? আপনার লোকদের দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পারেন? আমার হোটেলের নাম ভুলে গেছি, সঙ্গে কার্ডও নেই। তবে নামটা বোধহয় হোটেল রামাদা বা রেমন্ড।
হোয়াট, হোটেল রামাদা? আমি ওই হোটেলের উল্টোদিকের লেনে থাকি। দেখেননি নীল তিনতলা বাড়িটা? ওটার দোতলায়। চলুন, চলুন। আমার গাড়ি আছে। এবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম থাই তরুণীর মুখে হালকা মেকআপ। ওদের জাতীয় ফুল জেসমিনের বডি স্প্রের সৌরভ আসছে ওর শরীর থেকে, পোশাক থেকে, চুল থেকে। চারদিক মাতোয়ারা।
পাওয়েল স্ট্রিট থেকে আমার হোটেল অনেক দূর। তরুণী জানাল, রেমন্ড নামে কোনো হোটেল নেই এ শহরে। ও ভালো ড্রাইভ করে। রাতের ফাঁকা রাস্তা। ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে ও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসে থামল রামাদা হোটেলের সামনে। আমার বাংলাদেশের ঠিকানা দেওয়া ভিজিটিং কার্ড রাখল ও। ওর কার্ডও দিল আমাকে। কিন্তু ওই কার্ড ঢাকায় পেঁৗছেনি। আমেরিকার আরও কিছু জায়গায় আমি বেশ কয়েকদিন ছিলাম। একটানা ভ্রমণ। এর মধ্যে অজস্র কাগজপত্রের ভেতরে পড়ে গোলাপি ছোট্ট ভিজিটিং কার্ডটা কখন হারিয়ে গেছে টের পাইনি।
ঢাকা পেঁৗছার তিন-চার মাস পর আমি থাই তরুণীর চিঠি পেলাম। আমাকে নিনি ভোলেনি। ও লিখেছে, কৈশোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউইয়র্কে এক শ্রীলংকান তরুণকে ও লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। ওর মা-বাবা বিয়েটা কিছুতে মেনে নিতে পারেনি। যদিও ছেলেটা ছিল ওদের মতোই বৌদ্ধ। দুঃখে-শোকে শ্রীলংকান তরুণ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। স্থান হয় মেন্টাল অ্যাসাইলামে। ওখানেই ও ধুঁকতে ধুঁকতে অল্পদিনের মধ্যে মারা যায়। চিঠির শেষ দিকে আমি ধাক্কাটা খেলাম।
নিনি লিখেছে, আমার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, কণ্ঠ_ সবকিছুর সঙ্গে ওই শ্রীলংকান ছেলেটার মিল আছে। কবেকার কথা! চোখ বুজলেই আমি নিনিকে দেখতে পাই। ওর চিঠির সঙ্গে পাঠানো ছোট্ট পার্সেলে একটা বক্সে ছিল এক ডজন শিশি। জেসমিন ফুলের পারফিউম। টলটলে জলের রঙ। নিনির মনের রঙ। হ
No comments