জীবনের সাইকেল-অবাক পৃথিবী: পৃথিবী চেয়ে রয় by মামুনুর রশীদ
‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি’— কোনো নবজাতকের জন্ম হলেই বুকটায় কেমন একটা অনুভূতি হয়, কেন পৃথিবীতে জন্ম নিল শিশুটি? একদিকে পৃথিবীটায় ঋতু পরিক্রমা বিধ্বস্ত, অন্যদিকে বিশ্বায়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সংকট বাড়ছে। শিশুটি জন্মেই ঋণগ্রস্ত।
একটা বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবী। এসবই আবার মানুষের তৈরি। ঋণগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি তো আমরা চোখের সামনে দেখলাম। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করলেন, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যের প্রকোপ কমাতে পারছে না। ছয় কোটি লোক ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। এই দারিদ্র্য কমানোর আশুপদক্ষেপ যে ক্ষুদ্রঋণ বা ঋণ নয়, তা আজ বিশ্বে স্বীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋণের সুদ দিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতে তার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? সম্ভবত বর্তমানে সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সারা পৃথিবী থেকে থাবা দিয়ে টাকা নিয়ে তারা দেশ চালায়। আবার এই মাস্তানির অর্থ সাহায্য হিসেবেও সারা পৃথিবীতে বিতরণ করে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি টাকা ধার করে সে গণচীনের কাছ থেকে।
বাংলাদেশে অনেক পরীক্ষিত সম্ভাবনা ছিল। এর মধ্যে কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে পাট। একসময় পাটই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায়। অনেক পাটকল গড়ে উঠেছিল এ দেশে। বৃহত্তম ছিল আদমজী। কীভাবে পাটকলগুলো ধ্বংস হলো, কার ষড়যন্ত্রে—তাও আজ আর অজানা নয়। কৃষিকে আধুনিকায়নের ফলে খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গার্মেন্টসে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানিও একটা উল্লেখযোগ্য খাত। শিল্প-কলকারখানাও গড়ে উঠছে সর্বত্র। মাছ চাষের ক্ষেত্রেও একটা নীরব বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। কলকারখানায় চাকরি নিলে, বিদেশে একটা চাকরি নিলে ঋণের আওতা থেকে বেঁচে যাওয়া যায়, কিন্তু বিশাল ও ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান হয় না। এই যে বেকার দরিদ্র মানুষ, এর মধ্যে ঢুকে গেছে ক্ষুদ্রঋণ। ক্ষুদ্রঋণ কিছু করতে পারছে না, শুধু কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে সে দিশেহারা। তাহলে উপায় কী? উপায়ের উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে। সবচেয়ে দ্রুততম উপায়ে উন্নয়নের উদাহরণও আছে। মালয়েশিয়া। মাত্র ২৫ বছর আগেও ছিল হতদরিদ্র। বিশাল দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার তারা করতে পারত না। সে দেশের নেতা মাহাথির মোহাম্মদ শিল্পায়নে বিপুল বিনিয়োগকে সম্ভব করে তুললেন। দেশি এবং বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগের ফলে দেশে একটা শিল্পবিপ্লব হয়ে গেল। জনসংখ্যা তেমন নয়, তাই বিদেশ থেকেও শ্রমিক আনতে হলো।
আমাদের দেশে বিনিয়োগ এক রাজনৈতিক বিষয়। অস্থিতিশীল সমাজ, সর্বত্র দলীয় বিবেচনা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব—সব মিলিয়ে একটা আস্থা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে যে গুণসম্পন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন, তা-ও নেই। আসলে বৃহত্তর অর্থে সবকিছুই রাজনৈতিক। ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দেশে ন্যূনতম জবাবদিহি ছিল না, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিটা ছিল। ক্ষমতার ছিটেফোঁটা নিয়ে কিছু রাজনীতিক জবাবদিহির বিষয়টাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণকে নিয়ে, জনগণের শ্রেষ্ঠ মেধাটিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যদি নেতৃত্বের মধ্যে একজন একনায়কের উত্থান হয়, তাও ক্ষতির কিছু নেই। মাহাথিরও একনায়ক ছিলেন। ১৬ কোটি জনগণকে মানবসম্পদে পরিণত করলে বাংলাদেশ সিংহ হয়ে যেতে পারে। প্রবাসে অনেক মেধা অন্য দেশের উন্নয়নে কাজে লাগছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনেও বড় কাজে লাগানো যায়।
কালক্রমে আমলাতন্ত্র একটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বিদেশি কনসালট্যান্টদের স্বাগত জানাবেন, কিন্তু দেশের মেধাকে সেখানে ঢুকতে দেবেন না। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, শিক্ষক তাঁরা বিদেশি নানা সংস্থায় কাজ করে দেশের সেবার চেয়ে সেসব সংস্থার স্বার্থকেই বড় করে দেখবেন। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের স্থান হয়েছিল, কিন্তু ক্যাডার সৃষ্টির মাধ্যমে সেসব আর নেই। আমলারাই প্রমোশন পেয়ে সেসব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছে আর ক্ষমতা বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেস্তে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্ক থাকছে ভীষণভাবে দ্বান্দ্বিক। একেবারেই জাতীয় প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য হচ্ছে না। তুচ্ছ বিষয়ে বিতর্ক চলছে অথচ জাতিরক্ষার প্রশ্নে একযোগে কাজ করার কোনো প্রতিশ্রুতি আসছে না। এ অবস্থা কত দিন চলবে? ৫০ বছর, ১০০ বছর, ২০০ বছর? না, বেশি দিন তা চলে না। একটা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবশ্যম্ভাবী উত্থান হতে হবেই।
তাহলে আর ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি থাকবে না বরং হতে পারে এক অবাক বাংলাদেশ, পৃথিবী চেয়ে রয়।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশে অনেক পরীক্ষিত সম্ভাবনা ছিল। এর মধ্যে কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে পাট। একসময় পাটই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায়। অনেক পাটকল গড়ে উঠেছিল এ দেশে। বৃহত্তম ছিল আদমজী। কীভাবে পাটকলগুলো ধ্বংস হলো, কার ষড়যন্ত্রে—তাও আজ আর অজানা নয়। কৃষিকে আধুনিকায়নের ফলে খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গার্মেন্টসে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানিও একটা উল্লেখযোগ্য খাত। শিল্প-কলকারখানাও গড়ে উঠছে সর্বত্র। মাছ চাষের ক্ষেত্রেও একটা নীরব বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। কলকারখানায় চাকরি নিলে, বিদেশে একটা চাকরি নিলে ঋণের আওতা থেকে বেঁচে যাওয়া যায়, কিন্তু বিশাল ও ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান হয় না। এই যে বেকার দরিদ্র মানুষ, এর মধ্যে ঢুকে গেছে ক্ষুদ্রঋণ। ক্ষুদ্রঋণ কিছু করতে পারছে না, শুধু কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে সে দিশেহারা। তাহলে উপায় কী? উপায়ের উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে। সবচেয়ে দ্রুততম উপায়ে উন্নয়নের উদাহরণও আছে। মালয়েশিয়া। মাত্র ২৫ বছর আগেও ছিল হতদরিদ্র। বিশাল দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার তারা করতে পারত না। সে দেশের নেতা মাহাথির মোহাম্মদ শিল্পায়নে বিপুল বিনিয়োগকে সম্ভব করে তুললেন। দেশি এবং বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগের ফলে দেশে একটা শিল্পবিপ্লব হয়ে গেল। জনসংখ্যা তেমন নয়, তাই বিদেশ থেকেও শ্রমিক আনতে হলো।
আমাদের দেশে বিনিয়োগ এক রাজনৈতিক বিষয়। অস্থিতিশীল সমাজ, সর্বত্র দলীয় বিবেচনা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব—সব মিলিয়ে একটা আস্থা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে যে গুণসম্পন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন, তা-ও নেই। আসলে বৃহত্তর অর্থে সবকিছুই রাজনৈতিক। ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দেশে ন্যূনতম জবাবদিহি ছিল না, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিটা ছিল। ক্ষমতার ছিটেফোঁটা নিয়ে কিছু রাজনীতিক জবাবদিহির বিষয়টাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণকে নিয়ে, জনগণের শ্রেষ্ঠ মেধাটিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যদি নেতৃত্বের মধ্যে একজন একনায়কের উত্থান হয়, তাও ক্ষতির কিছু নেই। মাহাথিরও একনায়ক ছিলেন। ১৬ কোটি জনগণকে মানবসম্পদে পরিণত করলে বাংলাদেশ সিংহ হয়ে যেতে পারে। প্রবাসে অনেক মেধা অন্য দেশের উন্নয়নে কাজে লাগছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনেও বড় কাজে লাগানো যায়।
কালক্রমে আমলাতন্ত্র একটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বিদেশি কনসালট্যান্টদের স্বাগত জানাবেন, কিন্তু দেশের মেধাকে সেখানে ঢুকতে দেবেন না। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, শিক্ষক তাঁরা বিদেশি নানা সংস্থায় কাজ করে দেশের সেবার চেয়ে সেসব সংস্থার স্বার্থকেই বড় করে দেখবেন। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের স্থান হয়েছিল, কিন্তু ক্যাডার সৃষ্টির মাধ্যমে সেসব আর নেই। আমলারাই প্রমোশন পেয়ে সেসব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছে আর ক্ষমতা বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেস্তে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকার ও বিরোধী দলের সম্পর্ক থাকছে ভীষণভাবে দ্বান্দ্বিক। একেবারেই জাতীয় প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য হচ্ছে না। তুচ্ছ বিষয়ে বিতর্ক চলছে অথচ জাতিরক্ষার প্রশ্নে একযোগে কাজ করার কোনো প্রতিশ্রুতি আসছে না। এ অবস্থা কত দিন চলবে? ৫০ বছর, ১০০ বছর, ২০০ বছর? না, বেশি দিন তা চলে না। একটা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবশ্যম্ভাবী উত্থান হতে হবেই।
তাহলে আর ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি থাকবে না বরং হতে পারে এক অবাক বাংলাদেশ, পৃথিবী চেয়ে রয়।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments