বন আইন সংশোধন এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্ন by শক্তিপদ ত্রিপুরা
শোনা যাচ্ছে, সরকার বন আইন সংশোধন ও বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন করতে চলেছে। বন আইন প্রণীত হয় ১৯২৭ সালে, ব্রিটিশ আমলে। এটি একটি ঔপনিবেশিক আইন। স্রেফ মুনাফা লাভকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার এ আইন প্রণয়ন করেছিল। এ আইন এ দেশের মানুষের স্বার্থে প্রণীত হয়নি।
সে কারণে এ আইন সংশোধন জরুরি এবং এ আইন সংশোধনের লক্ষ্য হওয়া উচিত এটিকে এ দেশের মানুষের স্বার্থোপযোগী করে তোলা। সে লক্ষ্যে এ আইন সংশোধনের আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা অতীব জরুরি।
ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আইনে আছে, বনবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে 'রিজার্ভ ফরেস্ট' ঘোষণা করা যাবে না। সেসব দেশ বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বনবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে 'বন আইন' প্রণয়ন বা সংশোধন করে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে 'বন অধিকার আইন' প্রণীত হয়েছে, যেখানে বনবাসীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশে বন অধিকার বা বনবাসী অধিকার আইন আজ অবধি প্রণীত হয়নি। বাংলাদেশ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত বন আইনের মাধ্যমে বন বিভাগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বন সম্পর্কিত না হলেও বাংলাদেশে কিছু কিছু আইন আছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব আইন বন ও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক আইন প্রণয়ন করে। এ আইনটি সরাসরি বন সম্পর্কিত না হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম যেহেতু বন পরিবেষ্টিত অঞ্চল এবং বনে মূলত আদিবাসীরা বসবাস করে, তাই এ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উল্লেখ আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সে আইন প্রণয়ন করতে হবে। বন আইন ও বন্য প্রাণী আইন দুটি পার্বত্য চট্টগ্রামেও কার্যকর হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বনভূমি ও বন বিভাগের রিজার্ভ বন রয়েছে। আমার জানা মতে, সরকার যে বন আইন সংশোধন ও বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে অদ্যাবধি আলোচনা করা হয়নি। সরকার যদি আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে এ দুটি আইন সংশোধন ও প্রণয়ন করে তা হলে, তা হবে ১৯৯৮ সালের আঞ্চলিক পরিষদ আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। সরকারকে নিজে নিজের প্রণীত আইন যথাযথভাবে মান্য ও বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। নইলে জনগণকে 'আইন মান্য করো'_এ কথা বলার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। তাই আইন মান্য করে 'বন আইন' সংশোধন ও 'বন্য প্রাণী আইন' অনুমোদনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করা অত্যাবশ্যক। সঙ্গত কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের প্রধান রাজা-হেডম্যান ও বনবাসীর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
বনবাসীরা মূলত আদিবাসী। আদিবাসীদের চিরায়ত ভূমি দখল করে বন বিভাগ 'রিজার্ভ ফরেস্ট' ঘোষণা করে। তখন থেকে আদিবাসীরা তাদের চিরায়ত ভূমিতে বন বিভাগের দাস হিসেবে বসবাস করে আসছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বনবাসীদের অধিকার সমুন্নত রেখে বন ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও বনবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি ও বনকে কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয় এবং প্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে সহাবস্থান করতে হয়, তা আদিবাসীরা খুব ভালো করে জানে। এ বিষয়ে আদিবাসীদের রয়েছে হাজার বছরের অভিজ্ঞতা। নিজেদের স্বার্থের কারণেও আদিবাসীদের বন সংরক্ষণ করতে হয়। বন ও আদিবাসীর জীবন এবং জীবিকা একসূত্রে গাঁথা, এক ও অভিন্ন। বন নেই তো আদিবাসীর জীবন নেই, জীবিকা নেই। আদিবাসীদের বন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে তাদের জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়, তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে ওঠে এবং তাদের অর্থনীতি, সমাজ বিকলাঙ্গতার দিকে ধাবিত হয়। ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক কারণে আদিবাসীরা বিপন্ন হয়ে পড়লে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বন বিপন্ন হয়ে ওঠে। বন ও বৃক্ষদস্যুরা আদিবাসী অঞ্চলের বন ও বৃক্ষ উজাড় করে দেয়। আদিবাসীরা নিজেদের বন ও ভূমির সন্তান মনে করে। বৃক্ষ দেবতা, জল দেবতা, বন দেবতাকে তারা পূজা করে। তারা ভূমিকে কেনাবেচার সম্পদ মনে করে না, মাতৃতুল্য মনে করে। জীবিকার জন্য জুম চাষ, অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসার জন্য গাছের লতাপাতা, ঝরনার পানি, শাকসবজি, জ্বালানি, নাচ-গানের জন্য বাঁশের বাদ্য যন্ত্র_আদিবাসীদের সব কিছু বনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সে কারণে বন বিপন্ন হলে আদিবাসীদের জীবনও বিপন্ন হয়ে ওঠে।
বিস্ময়কর যে বন বিভাগ বনায়নের নামে হাজার হাজার একরের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চলেছে, সে বিষয়ে পরিবেশবাদী ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একেবারে নিশ্চুপ। বন বিভাগ কর্তৃক প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার বিরুদ্ধে দেশের পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তি আন্দোলন সংগ্রাম করেছে_সে রকম ঘটনা আমার চোখে পড়েনি। বন বিভাগ এখনো বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে এক বা দুই জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলছে। বিদেশি গাছ দিয়ে এসব বৃক্ষ বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। বন বিভাগের গাছ যেহেতু বিদেশি জাতের এবং এক জাতীয় বৃক্ষের বাগান, এ ধরনের এক জাতের বৃক্ষ বাগানে প্রাকৃতিক বনের পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ বসবাস করতে পারে না এবং বনের বিভিন্ন জাতের গাছপালা, লতাপাতা ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং বন বিভাগের তথাকথিত বনায়ন প্রকল্প পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই এ বিষয়ে পরিবেশবাদীদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। বর্তমান সরকার পরিবেশ বিষয়ে সোচ্চার। এই সরকার যদি পরিবেশবাদী হয়ে থাকে, তা হলে পরিবেশের ক্ষতি করে এ ধরনের কার্যক্রম এ দেশে চলে কি করে?
বন বিভাগের বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশরা মুনাফা লাভের লক্ষ্যে ১৯২৭ সালে এ আইন প্রণয়ন করেছিল। পরিবেশ, প্রাণী ও ঔষধি গাছ রক্ষা এবং এ দেশের মানুষের স্বার্থ তারা বিবেচনায় আনেনি। তাই তারা লাখ লাখ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বিদেশি জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু স্বাধীন দেশের সরকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারণা লালন করতে যাবে কেন? এ সরকার কেন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট করতে যাবে? তারা কেন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে বননির্ভর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে? আদিবাসীরা কি এ দেশের নাগরিক নয়? আদিবাসীরা কি এ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখেনি? বন বিভাগ প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে এক জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলছে। অথচ বন বিভাগ দাবি করছে, তারা বন সৃজন করছে। বন কি সৃজন করার বিষয়? বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন সৃজন করার বিষয় নয়, এটি প্রকৃতিগতভাবে গড়ে ওঠে। প্রকৃতিগতভাবে গড়ে ওঠা শত শত গাছপালা, লতাপাতা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের সমাহারকে বিশেষজ্ঞরা বন বলে থাকেন। অথচ বন বিভাগ এক বা দুই জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলে বলছে, বনায়ন করা হয়েছে। 'বন' সম্পর্কে বন বিভাগের ঔপনিবেশিক ধারণা পরিত্যাগ করা দরকার; তবেই দেশের প্রাকৃতিক বন রক্ষা করা সম্ভব হবে। দেশের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি এবং সংশোধনী বা নতুন আইনে প্রাকৃতিক বন সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত কাম্য।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আইনে আছে, বনবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে 'রিজার্ভ ফরেস্ট' ঘোষণা করা যাবে না। সেসব দেশ বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বনবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে 'বন আইন' প্রণয়ন বা সংশোধন করে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে 'বন অধিকার আইন' প্রণীত হয়েছে, যেখানে বনবাসীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশে বন অধিকার বা বনবাসী অধিকার আইন আজ অবধি প্রণীত হয়নি। বাংলাদেশ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত বন আইনের মাধ্যমে বন বিভাগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বন সম্পর্কিত না হলেও বাংলাদেশে কিছু কিছু আইন আছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব আইন বন ও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক আইন প্রণয়ন করে। এ আইনটি সরাসরি বন সম্পর্কিত না হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম যেহেতু বন পরিবেষ্টিত অঞ্চল এবং বনে মূলত আদিবাসীরা বসবাস করে, তাই এ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উল্লেখ আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সে আইন প্রণয়ন করতে হবে। বন আইন ও বন্য প্রাণী আইন দুটি পার্বত্য চট্টগ্রামেও কার্যকর হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বনভূমি ও বন বিভাগের রিজার্ভ বন রয়েছে। আমার জানা মতে, সরকার যে বন আইন সংশোধন ও বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে অদ্যাবধি আলোচনা করা হয়নি। সরকার যদি আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে এ দুটি আইন সংশোধন ও প্রণয়ন করে তা হলে, তা হবে ১৯৯৮ সালের আঞ্চলিক পরিষদ আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। সরকারকে নিজে নিজের প্রণীত আইন যথাযথভাবে মান্য ও বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। নইলে জনগণকে 'আইন মান্য করো'_এ কথা বলার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। তাই আইন মান্য করে 'বন আইন' সংশোধন ও 'বন্য প্রাণী আইন' অনুমোদনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করা অত্যাবশ্যক। সঙ্গত কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের প্রধান রাজা-হেডম্যান ও বনবাসীর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
বনবাসীরা মূলত আদিবাসী। আদিবাসীদের চিরায়ত ভূমি দখল করে বন বিভাগ 'রিজার্ভ ফরেস্ট' ঘোষণা করে। তখন থেকে আদিবাসীরা তাদের চিরায়ত ভূমিতে বন বিভাগের দাস হিসেবে বসবাস করে আসছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বনবাসীদের অধিকার সমুন্নত রেখে বন ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও বনবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি ও বনকে কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয় এবং প্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে সহাবস্থান করতে হয়, তা আদিবাসীরা খুব ভালো করে জানে। এ বিষয়ে আদিবাসীদের রয়েছে হাজার বছরের অভিজ্ঞতা। নিজেদের স্বার্থের কারণেও আদিবাসীদের বন সংরক্ষণ করতে হয়। বন ও আদিবাসীর জীবন এবং জীবিকা একসূত্রে গাঁথা, এক ও অভিন্ন। বন নেই তো আদিবাসীর জীবন নেই, জীবিকা নেই। আদিবাসীদের বন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে তাদের জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়, তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে ওঠে এবং তাদের অর্থনীতি, সমাজ বিকলাঙ্গতার দিকে ধাবিত হয়। ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক কারণে আদিবাসীরা বিপন্ন হয়ে পড়লে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বন বিপন্ন হয়ে ওঠে। বন ও বৃক্ষদস্যুরা আদিবাসী অঞ্চলের বন ও বৃক্ষ উজাড় করে দেয়। আদিবাসীরা নিজেদের বন ও ভূমির সন্তান মনে করে। বৃক্ষ দেবতা, জল দেবতা, বন দেবতাকে তারা পূজা করে। তারা ভূমিকে কেনাবেচার সম্পদ মনে করে না, মাতৃতুল্য মনে করে। জীবিকার জন্য জুম চাষ, অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসার জন্য গাছের লতাপাতা, ঝরনার পানি, শাকসবজি, জ্বালানি, নাচ-গানের জন্য বাঁশের বাদ্য যন্ত্র_আদিবাসীদের সব কিছু বনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সে কারণে বন বিপন্ন হলে আদিবাসীদের জীবনও বিপন্ন হয়ে ওঠে।
বিস্ময়কর যে বন বিভাগ বনায়নের নামে হাজার হাজার একরের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চলেছে, সে বিষয়ে পরিবেশবাদী ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একেবারে নিশ্চুপ। বন বিভাগ কর্তৃক প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার বিরুদ্ধে দেশের পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তি আন্দোলন সংগ্রাম করেছে_সে রকম ঘটনা আমার চোখে পড়েনি। বন বিভাগ এখনো বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে এক বা দুই জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলছে। বিদেশি গাছ দিয়ে এসব বৃক্ষ বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। বন বিভাগের গাছ যেহেতু বিদেশি জাতের এবং এক জাতীয় বৃক্ষের বাগান, এ ধরনের এক জাতের বৃক্ষ বাগানে প্রাকৃতিক বনের পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ বসবাস করতে পারে না এবং বনের বিভিন্ন জাতের গাছপালা, লতাপাতা ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং বন বিভাগের তথাকথিত বনায়ন প্রকল্প পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই এ বিষয়ে পরিবেশবাদীদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। বর্তমান সরকার পরিবেশ বিষয়ে সোচ্চার। এই সরকার যদি পরিবেশবাদী হয়ে থাকে, তা হলে পরিবেশের ক্ষতি করে এ ধরনের কার্যক্রম এ দেশে চলে কি করে?
বন বিভাগের বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশরা মুনাফা লাভের লক্ষ্যে ১৯২৭ সালে এ আইন প্রণয়ন করেছিল। পরিবেশ, প্রাণী ও ঔষধি গাছ রক্ষা এবং এ দেশের মানুষের স্বার্থ তারা বিবেচনায় আনেনি। তাই তারা লাখ লাখ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বিদেশি জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু স্বাধীন দেশের সরকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারণা লালন করতে যাবে কেন? এ সরকার কেন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট করতে যাবে? তারা কেন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে বননির্ভর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে? আদিবাসীরা কি এ দেশের নাগরিক নয়? আদিবাসীরা কি এ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখেনি? বন বিভাগ প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে এক জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলছে। অথচ বন বিভাগ দাবি করছে, তারা বন সৃজন করছে। বন কি সৃজন করার বিষয়? বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন সৃজন করার বিষয় নয়, এটি প্রকৃতিগতভাবে গড়ে ওঠে। প্রকৃতিগতভাবে গড়ে ওঠা শত শত গাছপালা, লতাপাতা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের সমাহারকে বিশেষজ্ঞরা বন বলে থাকেন। অথচ বন বিভাগ এক বা দুই জাতের বৃক্ষ বাগান গড়ে তুলে বলছে, বনায়ন করা হয়েছে। 'বন' সম্পর্কে বন বিভাগের ঔপনিবেশিক ধারণা পরিত্যাগ করা দরকার; তবেই দেশের প্রাকৃতিক বন রক্ষা করা সম্ভব হবে। দেশের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি এবং সংশোধনী বা নতুন আইনে প্রাকৃতিক বন সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত কাম্য।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
No comments