রোহিঙ্গাদের চায় না কক্সবাজারের মানুষ by হামিদ উল্লাহ ও গিয়াস উদ্দিন

রোহিঙ্গা নাগরিকদের যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশের বিরোধিতা করছেন টেকনাফের স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সচেতন লোকজন। তাঁরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে সমগ্র কক্সবাজার জেলার আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।


মিয়ানমারে সংঘটিত জাতিগত দাঙ্গার পর সীমানাপ্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে অন্তত দেড় শ রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্তে ঢুকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় একশ্রেণীর লোকের সহায়তাও পেয়েছে তারা। বিজিবি অভিযান চালিয়ে ইতিমধ্যে ২৪ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তারও করেছে।
টেকনাফ এলাকার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাঙালিদের সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় তারা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় টেকনাফে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ধরাও পড়েছে।’
টেকনাফের সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকনাফ এলাকার ৯৫ শতাংশ লোক শিক্ষিত নয়। তারা ধর্মীয় অনুভূতির কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়। তবে যাঁরা দেশের লাভ-ক্ষতির কথা ভাবেন, তাঁরা এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিপক্ষে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। তবে দেশটিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা শুরু হওয়ায় সে স্বীকৃতি পাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দাঙ্গায় জড়িয়ে রোহিঙ্গারা নিজেরাই সে সুযোগ নষ্ট করেছে।’ সাংসদ আবদুর রহমান মনে করেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের বিপক্ষে সরকার যে অবস্থান নিয়েছে, তা দেশের জন্য শত ভাগ ইতিবাচক। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রোহিঙ্গা ইস্যুটি জটিল করে তুলেছে।
অভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে কী হচ্ছে, তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে আমরা এ দেশে একজন রোহিঙ্গাকেও আর প্রবেশ করতে দিতে পারি না। কারণ, সুযোগ পেলেই শরণার্থীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কারণে স্থানীয় লোকজনের দুর্ভোগ বাড়ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ। এর মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যাই দেড় লাখ। টেকনাফ ও উখিয়ার তিনটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। শিবিরের বাইরে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। গত দুই দশকে উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গারা পাহাড় ও সরকারি ভূমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে। অনেক এলাকায় বনভূমি উজার করছে তারা। এ নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্যও রোহিঙ্গাদের দায়ী করা হয়।
টেকনাফ এলাকার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. জাহিদ হাসান বলেন, ‘গত দুই মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এলাকা থেকে সাতটি দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় চারজনকে।’
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের সদস্য মো. হাম জালাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭ জুন মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা শুরুর পর থেকে টেকনাফে ইয়াবা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারাই এ মাদক নিয়ে আসে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যে বাণিজ্য হয়, তার বেশির ভাগই সে দেশের রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ন্ত্রণ করে। রোহিঙ্গারা সেসব বৈধ ব্যবসায় যুক্ত না হয়ে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফ উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের আর এ দেশে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ১৯৯১ সাল ও পরবর্তী সময়ে যেসব রোহিঙ্গা এ দেশে অনুপ্রবেশ করেছেন তাঁরা এ এলাকার আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটিয়েছেন। স্থানীয় এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তও তাঁদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করছেন।’ তবে টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি অংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁরা মনে করেন, একটি মুসলমান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা উচিত। টেকনাফের একটি আবাসিক হোটেলের মালিক আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘শুনেছি মিয়ানমারে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা শুরুর পর মালয়েশিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ বিষয়ে চুপচাপ।’

No comments

Powered by Blogger.