চালচিত্র-ভাষার মাস, হাতেখড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধ by শুভ রহমান
আমাদের চেতনার অমূল্য সব সম্পদ_ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস, বিজয়ের মাস। জাতি হিসেবে আমরা এভাবে আমাদের বর্ষপরিক্রমাকে চিহ্নিত করতে শিখেছি এবং নতুন প্রজন্মকে শেখাচ্ছি। এ শিক্ষা অনন্য এবং গৌরবময়। এই ভাষার মাস খুবই গভীর ব্যঞ্জনাময়। এভাবে পৃথিবীর কোনো জাতির কোনো একটি মাস চিহ্নিত হয় না।
ভাষার মাস বলতেই অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য, অনেক রক্তদানের স্মৃতি, অনেক বীর শহীদ, অনেক ইতিহাস ও সংগ্রাম বর্তায় আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
এই ভাষার মাস আমাদের ভাবায়। কেন ভাষার মাস হলো, নতুন প্রজন্মকে তা জানানোর জন্য দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত করে আমাদের। আমরা তা কতটা পালন করি, অনুভব করি, সে কথা ভিন্ন।
লাখো শিশু রয়েছে, যারা ভাষার মাস কী তা বোঝে না। বিশেষ করে পথশিশু, ছিন্নমূল, ভাসমান, গৃহহারা পথহারা সহায়-সম্বলহীন শিশুরা। তাদের সংখ্যা কম নয়। এ রাজধানীতেই নাকি তিন-চার লাখ! সারা দেশে তাদের সংখ্যা নাকি প্রায় চার কোটি। তার মানে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে অবশ্য বিআরডিএস ও সোশ্যাল সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ ৮০ হাজার। আসলে এরা সংখ্যাহীন, অগণন। ঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘাত, বিপর্যয়, সবকিছুর অসহায় শিকার এরা। এদের জন্ম থেমে নেই। যদ্দূর জানি, শিল্পী রনবী তাদের নাম দিয়েছিলেন 'টোকাই', সমাজে রূঢ় বাস্তবে তাদের অবস্থান নিয়ে অনেক অবিনশ্বর কার্টুন এঁকেছেন তিনি। বস্তা কাঁধে ডাস্টবিন ঘেঁটে তারা কাগজ, পানির বোতল, ভাঙা পাইপ ইত্যাদি টোকায়; এগুলো বেচে সংসারে আয় জোগায়। মানুষের চৈতন্যোদয়ের জন্য, সমাজকে তাদের দিকে মুখ ফেরানোর জন্য। মনে হয়, তার সবই অরণ্যে রোদন! এ সমাজ আজও পথশিশুদের দিকে তাকানোর সময় পায়নি।
একুশ আসে, একুশ যায়। কত ভাগ্যবান শিশু কিন্ডারগার্টেনে যায়, ভাষাজ্ঞান অর্জন করে, জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক সরকার এখন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার দুয়ারও খুলে দিয়েছে নিঃস্ব-নিঃসম্বল শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য। কিন্তু এখনো কত অপ্রতুল সে উদ্যোগ। চাহিদা তার সহস্র গুণ বেশি।
এ দেশে এখনো কোটি শিশুর হাতেখড়ি হয় না বললে অত্যুক্তি হবে না। যে দেশে, যে সমাজে শিশুর হাতেখড়িই হয় না, সে দেশে, সে সমাজে একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ হনুজ দূরস্থ। অথচ একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই তো আমাদের মেরুদণ্ড। ভাগ্যবান শিশুরা সে চেতনা আঁকড়ে থাকে না। জীবনে প্রতিষ্ঠার হাতছানি ক্রমেই তাদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অনেক পোড়-খাওয়া ভাষাসৈনিক-গবেষক-কবি-প্রাবন্ধিক ডা. আহমদ রফিক দেখলাম খানিকটা যেন আক্ষেপ, আশঙ্কার সঙ্গেই একুশ এলিটদের হয়ে যাচ্ছে বলে খেদোক্তি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, 'প্রতিটি শিশুর সুন্দর ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করছি আমরা। এ জন্য শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা চাই না, কোনো শিশু তার মৌলিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হোক। ছিন্নমূল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক।'
বেশি দিন হয়নি তাঁর সে ঘোষণার। এর মধ্যে এসে গেল অমর একুশে। সমাজের দৃশ্যপট এত শিগগির পাল্টে যাবে, তা আশা করা যায় না। এতে যেকোনো মূল্যে একুশ উদ্যাপনের বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান, একুশের ঐতিহ্যবাহী বইমেলা, বিভিন্ন পদক-পুরস্কার, মঞ্চ_এসব যেকোনো মূল্যে, পৃথিবী লোপাট হয়ে গেলেও টিকিয়ে রাখতে হবে; আরো ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে হবে। এগুলো ভরসা, একদিন এ গোটা সমাজ সাক্ষর হবে, বইমুখী, জ্ঞানচর্চামুখী, দেশপ্রেমমুখী হবে। সে ভরসা আমাদের অটুট থাক।
তবে তার ভেতর, আমাদের আবেদন থাকবে, পথশিশুদের দিকে, দরিদ্র-অসহায়-নিরাপত্তাহীন ও আশ্রয়হীন মানব-শিশুদের দিকে আমরা যেন সহৃদয় ও মমতার দৃষ্টি নিয়ে তাকাই। আমাদের লজ্জা_আদুড়গায়ে পেট-ড্যাগরা, উলঙ্গ, নাকে পোঁটা ধূলিধূসর আমাদেরই লাখো সন্তানের জন্য, যারা হাতেখড়িটুকু পাওয়ারও সুযোগ পেল না। কিসের ভাষা, কিসের একুশ, কিসের বইমেলা_তাদের কাছে চির অজানা, চির অচেনাই থেকে যাচ্ছে! যত দ্রুত পারি, আমাদের এ লজ্জাকে আমরা দূর করবই। একুশের শত দৃপ্ত শপথের এ হোক দৃপ্ততম শপথ।
আমরা কিছুদিন আগে এ কলামেই আরেক লেখায় লিখেছি, আমাদের শিশুদের অপহরণ করে হাড়গোড় ভেঙে, মাটির-পেতলের হাঁড়িতে পুরে দেহ বিকৃতি ঘটিয়ে একদল নরপশু তাদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাচ্ছে। কী ভয়াবহ অভিশাপ গ্রাস করে আছে এ সমাজকে! শিশুরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তারাই ভবিষ্যৎ। আর তাদের কি না ভিক্ষুক বানানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এ সমাজকে। কালবিলম্ব না করে সমাজকে এ অভিশাপমুক্ত করা হোক। দেশে ভবঘুরে সদন আছে কিছু এখানে-সেখানে। সেখানে নাকি কাজের লোকই নেই। শিশুদের সেখানে পাঠানো হয় আশ্রয়ের জন্য, অন্ন সংস্থানের জন্য, মানুষ হওয়ার জন্য। সেসবের কিছুই হয় না। দাগি, আরো বাদমাশ তৈরি হয় সেখানে। এই তো হচ্ছে সমাজের চেহারা। এত সহজ নয় পথের শিশুকে আশ্রয় দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, মমতা দিয়ে, হাতেখড়ি দিয়ে মানুষ হওয়ার পথে চালিত করা। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, প্রধানমন্ত্রী তবু ভেবেছেন। কাজে পরিণত করুন সে ভাবনাকে। আস্তে-ধীরেই হোক, তবু শুরু তো হতে হবে। কাগজের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কামরাঙ্গীরচরের যে শিশুকে বিকৃত দেহ করে পাষণ্ডরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাতে চেয়েছিল, তাদের ব্যাপারটা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এমন অপরাধীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, অথচ কথিত নিরীহ মানুষকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়।
লাখ লাখ শিশুকে শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়াই নয়, হাতেখড়ি না দেওয়াও অপরাধ। যে শিশুর হাতেখড়ি হলো না, সে তো সমাজের বোঝা হয়েই থাকবে। গোটা প্রক্রিয়াটাই, দৃষ্টিভঙ্গিটাই উল্টে দিতে হবে। সমাজ এমনি পাল্টাবে না। হাতেখড়ি না হলেই সেটা হবে অপরাধ, অপরাধী হবে বাবা-মা-অভিভাবকরা। আর ছিন্নমূলের এহেন অবস্থার জন্য অপরাধী হবে সমাজ। আমাদের দেশে এখন স্বাধীন লেখনীর অধিকারী, সৃষ্টিশীল লেখক আছেন। তাঁরা আমাদের গর্ব। কই তাঁরা লিখুন না_সবার আগে পথশিশুর হাতেখড়ি চাই। তা না হলে সাহিত্যচর্চা, জ্ঞানচর্চা সব বৃথা। বর্ণমালা, দুঃখিনী বর্ণমালাই থেকে যাবে, তার প্রকৃষ্ট ব্যবহার তো হতে হবে দুঃখী মানুষের আত্মস্থ করার মধ্য দিয়েই। সেটা তো হচ্ছে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের জ্ঞানী-গুণী মানুষরা নিজেরাই ঠিকভাবে-শুদ্ধভাবে বাংলাটা লিখতে পারেন না। বেশ কটি প্রিন্ট মিডিয়াতেই দেখলাম লেখা হয়েছে 'সোমেন চন্দ্র মঞ্চ।' সোমেন চন্দ কে ছিলেন, কেন তাঁর নামে মঞ্চ করা হচ্ছে, তিনি যে সোমেন চন্দ্র নন, চন্দ, মিডিয়া এটাও জানবে না? হাতেখড়ি তো মিডিয়ারও দরকার। আরো কত রকম ভুল, ভুলের তো ছড়াছড়ি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর সভাপতিত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমিত বাংলা শেখার জন্য কমিটি হয়েছিল, তার পরে কতবার সে কমিটি নতুন করে হয়েছে, এখানে বাংলা একাডেমীতে ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বেও প্রমিত বাংলা শেখার কমিটি হয়েছে, বিদ্বজ্জন তো এখানে অনেক রয়েছেন, তবু ভুল বাংলা আমরা শিখবই। এঁড়ে তর্কও করব দুই বাংলার বাংলা ভাষা দুই রকম বলে অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করে! স্বাধীন দেশেও আমরা ভাষা-সংস্কৃতিকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে চাই। গায়ের জোরেই বলব, চন্দ্রবিন্দু না হলেও চলবে, 'র'-এর জায়গায় 'ড়', আর 'ড়'-এর জায়গায় 'র' মিডিয়াতেই লিখে চলব। হায় দুঃখিনী বর্ণমালা! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি বর্ণমালার চেতনা বাদ দিয়ে? মুক্তি শুধু দেশ আর সমাজের না। মুক্তি তো চাই ভাষারও।
ভাষা তো আসলে শ্রেণী-সংগ্রাম। ভাষা তো এমনি মুক্ত হবে না। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টাতে হবে। ভাষাকে যারা আবহমানকাল ধরে মুখের কথায় টিকিয়ে রেখেছে, তাদের দূরে ঠেলে রাখলে ভাষা কিভাবে অবিকৃত থাকবে, তার ভেতরে তো অবশ্যম্ভাবী রূপেরই ভাষার শত্রুদের ব্যবহৃত নানা জগাখিচুড়ি মিশে যাবে এবং আজ সেটাই ঘটছে। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষকে হাতেখড়ি দিয়ে কাছে টেনে ভাষায় অধিকার, ভাষার বিশুদ্ধতা তাদের দিয়েই রক্ষা করা সম্ভব, অন্য কাউকে দিয়ে তা হবে, এমন ভরসা করা যায় না।
আমাদের লেখকরা পুঁজিবাদী সমাজের শিক্ষার মতো শুধু নিজেরাই লেখক হতে চান, সমাজের আর কেউ লেখক হোক, তা চান না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ছোটদের হাতেখড়ির জন্য 'সহজ পাঠ', লিখেছেন ইংরেজি শিক্ষা, সংস্কৃত শিক্ষার বই। জ্ঞানকে, শিক্ষাকে, শেখার ক্ষমতাকে নিজের করে আঁকড়ে ধরে থাকার পুঁজিবাদী মানসিকতা তাঁর তো ছিল না। ছিল না বিদ্যাসাগরেরও। তাঁরা সমাজকে নিচুতলা থেকেই শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন। আমাদের লেখকদেরও গল্প-উপন্যাস, মোটা মোটা প্রবন্ধের বই লিখেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না, লিখতে হবে হাতেখড়ি যাদের হবে তাদের জন্যও। ভাষার বিষয়টা পরাধীন আমলেও ছিল রাজনৈতিক, এখনো তাই। একে রাজনীতিবর্জিত করতে গেলেই বিপদ। তাহলেই ভাষা শ্রেণী শোষণের, শ্রেণী শাসনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে। স্বাধীন দেশে আমরা কি সেই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলব?
ভাষা সবার জন্য; সর্বজনীন। আমার পাশের মানুষটি, হোক সে সর্বহারা শ্রেণীরই, তার হাতেখড়ি না হওয়ার মানেই আমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকা। কবে এ দৃষ্টিভঙ্গি আমরা গ্রহণ করব? বইমেলা উপচে পড়লেও হাতেখড়ি না হওয়া লাখো শিশু আমাদের লজ্জা দিতে থাকবে। শিক্ষাবঞ্চিতদের দূরে রেখে আমরা আর কতকাল অশিক্ষিত থাকব?
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, জাতির লজ্জা দূর করতে একুশের বইমেলাতেই একটি দিন সরকারিভাবে হাতেখড়ি দিবস ঘোষিত হোক। সেখানে প্রতীকী হলেও নিরক্ষর পথশিশুদের জমায়েত করে তাদের জন্য হাতেখড়ির আয়োজন হোক। শুধু এখানে-ওখানে চিত্রাঙ্কন বা হাতের লেখা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলেই জাতির কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। আনুষ্ঠানিকভাবেই তাকে একটি দিন গোটা জাতির জন্য হাতেখড়ি দিবস ঘোষণা করতে হবে। সেই পথে সারা দেশেই হাতেখড়ি দিবসে ছিন্নমূল টোকাইদের হাতেখড়ি দেওয়া হবে এবং তাদের ব্যাপারে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে নিয়মিত পাঠদানের কর্মসূচি।
আমি উন্নত দেশগুলোয় দেখেছি, শিশু আর নারীরাই সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাদের নিয়েই জাতির যত ভাবনা, যত গর্ব। একজন মা শিক্ষিত হলে গোটা পরিবার শিক্ষিত হতে পারে, এ কথার যথার্থতা উন্নত সব দেশেই পাওয়া যায়। আমরাও সে দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে চাই। ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ভাষার মাসে হাতেখড়ির উৎসব আয়োজিত হোক। হাতেখড়ি থেকেই শিশু স্বাবলম্বী হওয়ার পথে দৃপ্ত চরণে হেঁটে যাক আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষায় লৌহদৃঢ় শপথ নিয়ে। স্বাধীনতা এনেছে সাক্ষর-নিরক্ষর আপামর জনতা, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে, তাকে সুদৃঢ় ও বলীয়ান করতে, তাকে আকাশচুম্বী সাফল্যের শিখরে পেঁৗছে দিতে একান্তভাবে অপরিহার্য হচ্ছে শিক্ষিত জনশক্তি। এর কোনো বিকল্প নেই।
০১.০২.২০১১
এই ভাষার মাস আমাদের ভাবায়। কেন ভাষার মাস হলো, নতুন প্রজন্মকে তা জানানোর জন্য দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত করে আমাদের। আমরা তা কতটা পালন করি, অনুভব করি, সে কথা ভিন্ন।
লাখো শিশু রয়েছে, যারা ভাষার মাস কী তা বোঝে না। বিশেষ করে পথশিশু, ছিন্নমূল, ভাসমান, গৃহহারা পথহারা সহায়-সম্বলহীন শিশুরা। তাদের সংখ্যা কম নয়। এ রাজধানীতেই নাকি তিন-চার লাখ! সারা দেশে তাদের সংখ্যা নাকি প্রায় চার কোটি। তার মানে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে অবশ্য বিআরডিএস ও সোশ্যাল সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ ৮০ হাজার। আসলে এরা সংখ্যাহীন, অগণন। ঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘাত, বিপর্যয়, সবকিছুর অসহায় শিকার এরা। এদের জন্ম থেমে নেই। যদ্দূর জানি, শিল্পী রনবী তাদের নাম দিয়েছিলেন 'টোকাই', সমাজে রূঢ় বাস্তবে তাদের অবস্থান নিয়ে অনেক অবিনশ্বর কার্টুন এঁকেছেন তিনি। বস্তা কাঁধে ডাস্টবিন ঘেঁটে তারা কাগজ, পানির বোতল, ভাঙা পাইপ ইত্যাদি টোকায়; এগুলো বেচে সংসারে আয় জোগায়। মানুষের চৈতন্যোদয়ের জন্য, সমাজকে তাদের দিকে মুখ ফেরানোর জন্য। মনে হয়, তার সবই অরণ্যে রোদন! এ সমাজ আজও পথশিশুদের দিকে তাকানোর সময় পায়নি।
একুশ আসে, একুশ যায়। কত ভাগ্যবান শিশু কিন্ডারগার্টেনে যায়, ভাষাজ্ঞান অর্জন করে, জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক সরকার এখন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার দুয়ারও খুলে দিয়েছে নিঃস্ব-নিঃসম্বল শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য। কিন্তু এখনো কত অপ্রতুল সে উদ্যোগ। চাহিদা তার সহস্র গুণ বেশি।
এ দেশে এখনো কোটি শিশুর হাতেখড়ি হয় না বললে অত্যুক্তি হবে না। যে দেশে, যে সমাজে শিশুর হাতেখড়িই হয় না, সে দেশে, সে সমাজে একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ হনুজ দূরস্থ। অথচ একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই তো আমাদের মেরুদণ্ড। ভাগ্যবান শিশুরা সে চেতনা আঁকড়ে থাকে না। জীবনে প্রতিষ্ঠার হাতছানি ক্রমেই তাদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অনেক পোড়-খাওয়া ভাষাসৈনিক-গবেষক-কবি-প্রাবন্ধিক ডা. আহমদ রফিক দেখলাম খানিকটা যেন আক্ষেপ, আশঙ্কার সঙ্গেই একুশ এলিটদের হয়ে যাচ্ছে বলে খেদোক্তি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, 'প্রতিটি শিশুর সুন্দর ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করছি আমরা। এ জন্য শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা চাই না, কোনো শিশু তার মৌলিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হোক। ছিন্নমূল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক।'
বেশি দিন হয়নি তাঁর সে ঘোষণার। এর মধ্যে এসে গেল অমর একুশে। সমাজের দৃশ্যপট এত শিগগির পাল্টে যাবে, তা আশা করা যায় না। এতে যেকোনো মূল্যে একুশ উদ্যাপনের বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান, একুশের ঐতিহ্যবাহী বইমেলা, বিভিন্ন পদক-পুরস্কার, মঞ্চ_এসব যেকোনো মূল্যে, পৃথিবী লোপাট হয়ে গেলেও টিকিয়ে রাখতে হবে; আরো ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে হবে। এগুলো ভরসা, একদিন এ গোটা সমাজ সাক্ষর হবে, বইমুখী, জ্ঞানচর্চামুখী, দেশপ্রেমমুখী হবে। সে ভরসা আমাদের অটুট থাক।
তবে তার ভেতর, আমাদের আবেদন থাকবে, পথশিশুদের দিকে, দরিদ্র-অসহায়-নিরাপত্তাহীন ও আশ্রয়হীন মানব-শিশুদের দিকে আমরা যেন সহৃদয় ও মমতার দৃষ্টি নিয়ে তাকাই। আমাদের লজ্জা_আদুড়গায়ে পেট-ড্যাগরা, উলঙ্গ, নাকে পোঁটা ধূলিধূসর আমাদেরই লাখো সন্তানের জন্য, যারা হাতেখড়িটুকু পাওয়ারও সুযোগ পেল না। কিসের ভাষা, কিসের একুশ, কিসের বইমেলা_তাদের কাছে চির অজানা, চির অচেনাই থেকে যাচ্ছে! যত দ্রুত পারি, আমাদের এ লজ্জাকে আমরা দূর করবই। একুশের শত দৃপ্ত শপথের এ হোক দৃপ্ততম শপথ।
আমরা কিছুদিন আগে এ কলামেই আরেক লেখায় লিখেছি, আমাদের শিশুদের অপহরণ করে হাড়গোড় ভেঙে, মাটির-পেতলের হাঁড়িতে পুরে দেহ বিকৃতি ঘটিয়ে একদল নরপশু তাদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাচ্ছে। কী ভয়াবহ অভিশাপ গ্রাস করে আছে এ সমাজকে! শিশুরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তারাই ভবিষ্যৎ। আর তাদের কি না ভিক্ষুক বানানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এ সমাজকে। কালবিলম্ব না করে সমাজকে এ অভিশাপমুক্ত করা হোক। দেশে ভবঘুরে সদন আছে কিছু এখানে-সেখানে। সেখানে নাকি কাজের লোকই নেই। শিশুদের সেখানে পাঠানো হয় আশ্রয়ের জন্য, অন্ন সংস্থানের জন্য, মানুষ হওয়ার জন্য। সেসবের কিছুই হয় না। দাগি, আরো বাদমাশ তৈরি হয় সেখানে। এই তো হচ্ছে সমাজের চেহারা। এত সহজ নয় পথের শিশুকে আশ্রয় দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, মমতা দিয়ে, হাতেখড়ি দিয়ে মানুষ হওয়ার পথে চালিত করা। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, প্রধানমন্ত্রী তবু ভেবেছেন। কাজে পরিণত করুন সে ভাবনাকে। আস্তে-ধীরেই হোক, তবু শুরু তো হতে হবে। কাগজের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কামরাঙ্গীরচরের যে শিশুকে বিকৃত দেহ করে পাষণ্ডরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাতে চেয়েছিল, তাদের ব্যাপারটা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এমন অপরাধীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, অথচ কথিত নিরীহ মানুষকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়।
লাখ লাখ শিশুকে শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়াই নয়, হাতেখড়ি না দেওয়াও অপরাধ। যে শিশুর হাতেখড়ি হলো না, সে তো সমাজের বোঝা হয়েই থাকবে। গোটা প্রক্রিয়াটাই, দৃষ্টিভঙ্গিটাই উল্টে দিতে হবে। সমাজ এমনি পাল্টাবে না। হাতেখড়ি না হলেই সেটা হবে অপরাধ, অপরাধী হবে বাবা-মা-অভিভাবকরা। আর ছিন্নমূলের এহেন অবস্থার জন্য অপরাধী হবে সমাজ। আমাদের দেশে এখন স্বাধীন লেখনীর অধিকারী, সৃষ্টিশীল লেখক আছেন। তাঁরা আমাদের গর্ব। কই তাঁরা লিখুন না_সবার আগে পথশিশুর হাতেখড়ি চাই। তা না হলে সাহিত্যচর্চা, জ্ঞানচর্চা সব বৃথা। বর্ণমালা, দুঃখিনী বর্ণমালাই থেকে যাবে, তার প্রকৃষ্ট ব্যবহার তো হতে হবে দুঃখী মানুষের আত্মস্থ করার মধ্য দিয়েই। সেটা তো হচ্ছে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের জ্ঞানী-গুণী মানুষরা নিজেরাই ঠিকভাবে-শুদ্ধভাবে বাংলাটা লিখতে পারেন না। বেশ কটি প্রিন্ট মিডিয়াতেই দেখলাম লেখা হয়েছে 'সোমেন চন্দ্র মঞ্চ।' সোমেন চন্দ কে ছিলেন, কেন তাঁর নামে মঞ্চ করা হচ্ছে, তিনি যে সোমেন চন্দ্র নন, চন্দ, মিডিয়া এটাও জানবে না? হাতেখড়ি তো মিডিয়ারও দরকার। আরো কত রকম ভুল, ভুলের তো ছড়াছড়ি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর সভাপতিত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমিত বাংলা শেখার জন্য কমিটি হয়েছিল, তার পরে কতবার সে কমিটি নতুন করে হয়েছে, এখানে বাংলা একাডেমীতে ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বেও প্রমিত বাংলা শেখার কমিটি হয়েছে, বিদ্বজ্জন তো এখানে অনেক রয়েছেন, তবু ভুল বাংলা আমরা শিখবই। এঁড়ে তর্কও করব দুই বাংলার বাংলা ভাষা দুই রকম বলে অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করে! স্বাধীন দেশেও আমরা ভাষা-সংস্কৃতিকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে চাই। গায়ের জোরেই বলব, চন্দ্রবিন্দু না হলেও চলবে, 'র'-এর জায়গায় 'ড়', আর 'ড়'-এর জায়গায় 'র' মিডিয়াতেই লিখে চলব। হায় দুঃখিনী বর্ণমালা! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি বর্ণমালার চেতনা বাদ দিয়ে? মুক্তি শুধু দেশ আর সমাজের না। মুক্তি তো চাই ভাষারও।
ভাষা তো আসলে শ্রেণী-সংগ্রাম। ভাষা তো এমনি মুক্ত হবে না। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টাতে হবে। ভাষাকে যারা আবহমানকাল ধরে মুখের কথায় টিকিয়ে রেখেছে, তাদের দূরে ঠেলে রাখলে ভাষা কিভাবে অবিকৃত থাকবে, তার ভেতরে তো অবশ্যম্ভাবী রূপেরই ভাষার শত্রুদের ব্যবহৃত নানা জগাখিচুড়ি মিশে যাবে এবং আজ সেটাই ঘটছে। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষকে হাতেখড়ি দিয়ে কাছে টেনে ভাষায় অধিকার, ভাষার বিশুদ্ধতা তাদের দিয়েই রক্ষা করা সম্ভব, অন্য কাউকে দিয়ে তা হবে, এমন ভরসা করা যায় না।
আমাদের লেখকরা পুঁজিবাদী সমাজের শিক্ষার মতো শুধু নিজেরাই লেখক হতে চান, সমাজের আর কেউ লেখক হোক, তা চান না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ছোটদের হাতেখড়ির জন্য 'সহজ পাঠ', লিখেছেন ইংরেজি শিক্ষা, সংস্কৃত শিক্ষার বই। জ্ঞানকে, শিক্ষাকে, শেখার ক্ষমতাকে নিজের করে আঁকড়ে ধরে থাকার পুঁজিবাদী মানসিকতা তাঁর তো ছিল না। ছিল না বিদ্যাসাগরেরও। তাঁরা সমাজকে নিচুতলা থেকেই শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন। আমাদের লেখকদেরও গল্প-উপন্যাস, মোটা মোটা প্রবন্ধের বই লিখেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না, লিখতে হবে হাতেখড়ি যাদের হবে তাদের জন্যও। ভাষার বিষয়টা পরাধীন আমলেও ছিল রাজনৈতিক, এখনো তাই। একে রাজনীতিবর্জিত করতে গেলেই বিপদ। তাহলেই ভাষা শ্রেণী শোষণের, শ্রেণী শাসনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে। স্বাধীন দেশে আমরা কি সেই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলব?
ভাষা সবার জন্য; সর্বজনীন। আমার পাশের মানুষটি, হোক সে সর্বহারা শ্রেণীরই, তার হাতেখড়ি না হওয়ার মানেই আমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকা। কবে এ দৃষ্টিভঙ্গি আমরা গ্রহণ করব? বইমেলা উপচে পড়লেও হাতেখড়ি না হওয়া লাখো শিশু আমাদের লজ্জা দিতে থাকবে। শিক্ষাবঞ্চিতদের দূরে রেখে আমরা আর কতকাল অশিক্ষিত থাকব?
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, জাতির লজ্জা দূর করতে একুশের বইমেলাতেই একটি দিন সরকারিভাবে হাতেখড়ি দিবস ঘোষিত হোক। সেখানে প্রতীকী হলেও নিরক্ষর পথশিশুদের জমায়েত করে তাদের জন্য হাতেখড়ির আয়োজন হোক। শুধু এখানে-ওখানে চিত্রাঙ্কন বা হাতের লেখা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলেই জাতির কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। আনুষ্ঠানিকভাবেই তাকে একটি দিন গোটা জাতির জন্য হাতেখড়ি দিবস ঘোষণা করতে হবে। সেই পথে সারা দেশেই হাতেখড়ি দিবসে ছিন্নমূল টোকাইদের হাতেখড়ি দেওয়া হবে এবং তাদের ব্যাপারে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে নিয়মিত পাঠদানের কর্মসূচি।
আমি উন্নত দেশগুলোয় দেখেছি, শিশু আর নারীরাই সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাদের নিয়েই জাতির যত ভাবনা, যত গর্ব। একজন মা শিক্ষিত হলে গোটা পরিবার শিক্ষিত হতে পারে, এ কথার যথার্থতা উন্নত সব দেশেই পাওয়া যায়। আমরাও সে দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে চাই। ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ভাষার মাসে হাতেখড়ির উৎসব আয়োজিত হোক। হাতেখড়ি থেকেই শিশু স্বাবলম্বী হওয়ার পথে দৃপ্ত চরণে হেঁটে যাক আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষায় লৌহদৃঢ় শপথ নিয়ে। স্বাধীনতা এনেছে সাক্ষর-নিরক্ষর আপামর জনতা, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে, তাকে সুদৃঢ় ও বলীয়ান করতে, তাকে আকাশচুম্বী সাফল্যের শিখরে পেঁৗছে দিতে একান্তভাবে অপরিহার্য হচ্ছে শিক্ষিত জনশক্তি। এর কোনো বিকল্প নেই।
০১.০২.২০১১
No comments