বিশেষ সাক্ষাৎকার-সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন জিয়া by মাহবুবুর রহমান
পঁচাত্তরের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর। সেনাবাহিনীতে পর পর যে দুটি অভ্যুত্থান ঘটে, তার ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় পরবর্তীকালে রাজনীতিতে। এখনো অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। ৭ নভেম্বর সামনে রেখে আমরা মুখোমুখি হই দুই সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের। তাঁদের সাক্ষাৎকার দুটিতে সেই সময়ের ঘটনার কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো পঁচাত্তরের নভেম্বরে সংঘটিত ঘটনাবলিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? বিশেষ করে ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান?
মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়; যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক দিন টানতে হয়েছে। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁকে সেনাপ্রধান না করে করা হলো কে এম সফিউল্লাহকে। এটা মন্দ দৃষ্টান্ত। এর ফলে সেনাবাহিনীতে কিছুটা অসন্তোষ দেখা যায়। আরেকটি বিষয় ছিল রক্ষীবাহিনী। আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধা তো সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি হতে পারে না। আমরা যখন পাকিস্তানে আটকাবস্থা থেকে ’৭৩-৭৪ সালে ফিরে এসে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ হলাম, তখন এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল।
প্রথম আলো এর পরিপ্রেক্ষিতেই কি ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানো হলো?
মাহবুবুর রহমান পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা কিন্তু সেনাবাহিনী ঘটায়নি; ঘটিয়েছে কতিপয় জুনিয়র কর্মকর্তা। সেনাবাহিনী জড়িত থাকলে সেনাপ্রধানই ক্ষমতা দখল করতেন। এটা ছিল একটি ষড়যন্ত্র। সে সময় আমি সেনা সদর দপ্তরে ছিলাম। দেখেছি, সেনাবাহিনীর মধ্যে নানা সংশয়, সন্দেহ ও গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। সিনিয়র কর্মকর্তারা চাইছিলেন চেইন অব কমান্ড ফিরে আসুক। তখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি মনে করলেন, চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন সাফায়েত জামিল। তাঁরা ৩ নভেম্বর যেটি করলেন, সেটি ছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু তাঁরা সেনাবাহিনীকে নিজের পক্ষে টানতে পারলেন না। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের প্রতি বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও জওয়ানের সমর্থন ছিল। তাঁকে বন্দী করায় তাঁদের সহানুভূতিও তাঁর প্রতি বেড়ে যায়। সে সময় চার দিন দেশে প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না। গোটা জাতি ছিল বিভ্রান্ত। সর্বত্র আতঙ্ক, উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা চলছিল। তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা রকম প্রচারপত্র বিলি করা হয়। জওয়ানদের মধ্যেও ক্ষোভ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মকর্তা ও জওয়ানদের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। তাঁরা সবই একই ক্যাম্পে ছিলেন। কিন্তু নিয়মিত বাহিনীতে তাঁদের অবস্থান আলাদা হয়ে গেল।
আরেকটি বিষয়, কর্নেল তাহের তখন সেনাবাহিনীতে না থাকলেও কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তিনি একটি চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। সেনাদের একাংশের মধ্যে জাসদেরও প্রভাব ছিল। ৭ নভেম্বর বিভিন্ন ব্রিগেডের জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলেন। তাহের চেয়েছিলেন, গণবাহিনী সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটের দিকে এগোচ্ছিল। জিয়াউর রহমান সেই পথে গেলেন না। দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলো। পরবর্তী ঘটনা আপনারা জানেন।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কী ছিল?
মাহবুবুর রহমান ৭ নভেম্বর ছিল ৩ নভেম্বরেরই প্রতিক্রিয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজটি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীর যে জওয়ানরা বেরিয়ে এলেন, তাঁদের ব্যারাকে নিয়ে আসা ছিল কঠিন কাজ। জিয়া ছাড়া আর কেউ পারতেন না। শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনমনীয়। ৭ নভেম্বরের পর তিনি বিভিন্ন সেনানিবাসে দরবারের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে একজন জওয়ান জিয়া ভাই বলে সম্বোধন করতেই তিনি বললেন, ‘চুপ করো, আমি কারও ভাই না। আমি সেনাপ্রধান।’
অতএব এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন।
প্রথম আলো ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক কেমন ছিল?
মাহবুবুর রহমান তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক মধুর ছিল না। হয়তো তিক্ততাও ছিল না। স্বাধীনতার পর সেনাপ্রধানের পদটি জিয়াউর রহমানেরই প্রাপ্য ছিল। সেই পদটি তাঁকে না দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবে কর্মকর্তা ও জওয়ানদের সহানুভূতি তাঁর ওপর ছিল।
প্রথম আলো সেনাবাহিনীর ওপর জিয়াউর রহমানের যদি এতটাই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, পরবর্তী অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান তিনি ঠেকাতে পারলেন না কেন?
মাহবুবুর রহমান প্রতিটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে। যাঁরা ১৫ আগস্টের ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে তাঁদের অনুসারী ছিলেন, কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা ছিলেন—সবাই চেয়েছিলেন নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। সব পক্ষকে সামাল দেওয়া তাঁর পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। তবে তিনি চেষ্টা করে গেছেন। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, জিয়া সেনাবাহিনীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য সাধারণ সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানরা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হওয়ার কথা নয়।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের পর সেনানিবাসগুলোতে কি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল?
মাহবুবুর রহমান অনেকটাই ফিরে এসেছিল। এ ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। সেনানিবাসগুলোতে ঝটিকা সফর করে কর্মকর্তা ও জওয়ানদের বুঝিয়েছেন। আমি মনে করি, ’৮১তে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল তার সঙ্গে পঁচাত্তরের ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ছিল।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের হত্যা করা হয়েছে। কারা হত্যা করেছে? অনেকে মনে করেন, এতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল।
মাহবুবুর রহমান এটি অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়। আমার ধারণা, ৩ নভেম্বরের আগে সেনানিবাসে কী ঘটছে, খালেদ মোশাররফ সেটি উপলব্ধি করতে পারেননি। কর্নেল তাহের যে ভেতরে ভেতরে জওয়ান ও কর্মকর্তাদের সংগঠিত করে ফেলেছেন, সেটি তিনি বুঝতে পারেননি। পারলে অন্য রকম ফল হতো। তিনি যেসব ব্রিগেডকে তাঁর সমর্থনে নামাতে চেয়েছিলেন, তাঁরা উল্টে গেলেন। তাঁর মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু সেটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয় না। খালেদ মোশাররফ পালিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়ি নষ্ট হয় এবং সংসদ ভবন এলাকায় আশ্রয় নেন। জিয়াউর রহমান কোনোভাবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে কিন্তু প্রথমেই কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘খালেদকে রক্ষা করার চেষ্টা করো।’ যখন তিনি জানতে পারলেন, খালেদ ও তাঁর সহযোগীদের মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ও মাই গড।’
প্রথম আলো পঁচাত্তরের নভেম্বরে সংঘটিত ঘটনাবলিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? বিশেষ করে ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান?
মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়; যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক দিন টানতে হয়েছে। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁকে সেনাপ্রধান না করে করা হলো কে এম সফিউল্লাহকে। এটা মন্দ দৃষ্টান্ত। এর ফলে সেনাবাহিনীতে কিছুটা অসন্তোষ দেখা যায়। আরেকটি বিষয় ছিল রক্ষীবাহিনী। আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধা তো সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি হতে পারে না। আমরা যখন পাকিস্তানে আটকাবস্থা থেকে ’৭৩-৭৪ সালে ফিরে এসে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ হলাম, তখন এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল।
প্রথম আলো এর পরিপ্রেক্ষিতেই কি ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানো হলো?
মাহবুবুর রহমান পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা কিন্তু সেনাবাহিনী ঘটায়নি; ঘটিয়েছে কতিপয় জুনিয়র কর্মকর্তা। সেনাবাহিনী জড়িত থাকলে সেনাপ্রধানই ক্ষমতা দখল করতেন। এটা ছিল একটি ষড়যন্ত্র। সে সময় আমি সেনা সদর দপ্তরে ছিলাম। দেখেছি, সেনাবাহিনীর মধ্যে নানা সংশয়, সন্দেহ ও গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। সিনিয়র কর্মকর্তারা চাইছিলেন চেইন অব কমান্ড ফিরে আসুক। তখন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি মনে করলেন, চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন সাফায়েত জামিল। তাঁরা ৩ নভেম্বর যেটি করলেন, সেটি ছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু তাঁরা সেনাবাহিনীকে নিজের পক্ষে টানতে পারলেন না। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের প্রতি বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও জওয়ানের সমর্থন ছিল। তাঁকে বন্দী করায় তাঁদের সহানুভূতিও তাঁর প্রতি বেড়ে যায়। সে সময় চার দিন দেশে প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না। গোটা জাতি ছিল বিভ্রান্ত। সর্বত্র আতঙ্ক, উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা চলছিল। তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা রকম প্রচারপত্র বিলি করা হয়। জওয়ানদের মধ্যেও ক্ষোভ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মকর্তা ও জওয়ানদের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। তাঁরা সবই একই ক্যাম্পে ছিলেন। কিন্তু নিয়মিত বাহিনীতে তাঁদের অবস্থান আলাদা হয়ে গেল।
আরেকটি বিষয়, কর্নেল তাহের তখন সেনাবাহিনীতে না থাকলেও কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তিনি একটি চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। সেনাদের একাংশের মধ্যে জাসদেরও প্রভাব ছিল। ৭ নভেম্বর বিভিন্ন ব্রিগেডের জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলেন। তাহের চেয়েছিলেন, গণবাহিনী সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটের দিকে এগোচ্ছিল। জিয়াউর রহমান সেই পথে গেলেন না। দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলো। পরবর্তী ঘটনা আপনারা জানেন।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কী ছিল?
মাহবুবুর রহমান ৭ নভেম্বর ছিল ৩ নভেম্বরেরই প্রতিক্রিয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজটি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীর যে জওয়ানরা বেরিয়ে এলেন, তাঁদের ব্যারাকে নিয়ে আসা ছিল কঠিন কাজ। জিয়া ছাড়া আর কেউ পারতেন না। শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনমনীয়। ৭ নভেম্বরের পর তিনি বিভিন্ন সেনানিবাসে দরবারের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে একজন জওয়ান জিয়া ভাই বলে সম্বোধন করতেই তিনি বললেন, ‘চুপ করো, আমি কারও ভাই না। আমি সেনাপ্রধান।’
অতএব এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন।
প্রথম আলো ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক কেমন ছিল?
মাহবুবুর রহমান তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক মধুর ছিল না। হয়তো তিক্ততাও ছিল না। স্বাধীনতার পর সেনাপ্রধানের পদটি জিয়াউর রহমানেরই প্রাপ্য ছিল। সেই পদটি তাঁকে না দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবে কর্মকর্তা ও জওয়ানদের সহানুভূতি তাঁর ওপর ছিল।
প্রথম আলো সেনাবাহিনীর ওপর জিয়াউর রহমানের যদি এতটাই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, পরবর্তী অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান তিনি ঠেকাতে পারলেন না কেন?
মাহবুবুর রহমান প্রতিটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে। যাঁরা ১৫ আগস্টের ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে তাঁদের অনুসারী ছিলেন, কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা ছিলেন—সবাই চেয়েছিলেন নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। সব পক্ষকে সামাল দেওয়া তাঁর পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। তবে তিনি চেষ্টা করে গেছেন। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, জিয়া সেনাবাহিনীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য সাধারণ সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানরা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হওয়ার কথা নয়।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের পর সেনানিবাসগুলোতে কি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল?
মাহবুবুর রহমান অনেকটাই ফিরে এসেছিল। এ ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। সেনানিবাসগুলোতে ঝটিকা সফর করে কর্মকর্তা ও জওয়ানদের বুঝিয়েছেন। আমি মনে করি, ’৮১তে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল তার সঙ্গে পঁচাত্তরের ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ছিল।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের হত্যা করা হয়েছে। কারা হত্যা করেছে? অনেকে মনে করেন, এতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল।
মাহবুবুর রহমান এটি অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়। আমার ধারণা, ৩ নভেম্বরের আগে সেনানিবাসে কী ঘটছে, খালেদ মোশাররফ সেটি উপলব্ধি করতে পারেননি। কর্নেল তাহের যে ভেতরে ভেতরে জওয়ান ও কর্মকর্তাদের সংগঠিত করে ফেলেছেন, সেটি তিনি বুঝতে পারেননি। পারলে অন্য রকম ফল হতো। তিনি যেসব ব্রিগেডকে তাঁর সমর্থনে নামাতে চেয়েছিলেন, তাঁরা উল্টে গেলেন। তাঁর মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু সেটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয় না। খালেদ মোশাররফ পালিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়ি নষ্ট হয় এবং সংসদ ভবন এলাকায় আশ্রয় নেন। জিয়াউর রহমান কোনোভাবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে কিন্তু প্রথমেই কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘খালেদকে রক্ষা করার চেষ্টা করো।’ যখন তিনি জানতে পারলেন, খালেদ ও তাঁর সহযোগীদের মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ও মাই গড।’
No comments