যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন-রিপাবলিকানদের জয় নয়, ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় by জন বি জুডিস
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগের দিন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান টিম কাইনির কাছে ডেমোক্র্যাটদের আসন্ন পরাজয়ের তাৎপর্য নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হলে তিনি একে অনেকটা গতানুগতিক নির্বাচন হিসেবেই মন্তব্য করলেন।
বললেন, ‘টেডি রুজভেল্টের সময় থেকেই গড়পড়তা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল প্রতিনিধি পরিষদে ২৮ আসন আর সিনেটে চার আসন হারায়।’ কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদে ৬০-এর অধিক আসন আর সিনেটে আটটি আসন হারানো কি গড়পড়তা ফলের চেয়ে খারাপ বলব, নাকি এই নির্বাচনে আরও গুরুতর ও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটেছে?
রিপাবলিকানরা হয়তো বলতে পারেন, রক্ষণশীল রিপাবলিকান প্রাধান্যের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের লক্ষণ এই নির্বাচন। আসলে তেমনটি ঘটেনি। এই নির্বাচন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ব্যবস্থাগত সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। এমন সংকট দেশটিকে কিছু সময় পর পরই মোকাবিলা করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র যখন গৃহযুদ্ধ, ১৮৯০-এর মন্দা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং মহামন্দা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো বড় সংকট পার হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রতিবারই আগের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়েছে—চাঙা অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব অর্জন করেছে। এর বড় কারণ, দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থা সে সময়ের প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল। এবারের নির্বাচনের পর মনে হয়, আর হয়তো তেমনটি ঘটবে না।
অর্থনীতির অধোগতির সঙ্গে ১৮৯০ ও ১৯৩০-এর মহামন্দার কাঠামোগত সাদৃশ্য দেখা যায়। ঋণে ডুবে থাকা মার্কিন জনগণের এখন প্রতি ছয়জনে একজনের পূর্ণকালীন কাজ নেই। তারা ব্যয় করছে না। বণিকেরা পণ্যের চাহিদা সম্পর্কে অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ করছেন না। ফেডারেল রিজার্ভ কার্যত ক্ষমতাহীন। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত চাহিদা ও বিনিয়োগের প্রণোদনা দেওয়ার একমাত্র পথ হলো সরকারি ব্যয়। ওবামা তাঁর প্রাথমিক কর্মসূচির মাধ্যমে সেটাই করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বাস্থ্যসেবা বিল প্রত্যাহারের ম্যান্ডেট হয়তো রিপাবলিকানরা পাননি, কিন্তু ব্যয়সংকোচনের ম্যান্ডেট তাঁরা পেয়েছেন। অনেক ভোটার মনে করছেন, ওবামার প্রণোদনা কর্মসূচি আসলে বেকারত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে এবং সরকারি ব্যয়সংকোচন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি ত্বরান্বিত করবে। এসবই বাজে কথা—১৯৩৭ সালের যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ১৯৯০ সালের জাপানের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। কিন্তু এমন চিন্তাই কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা নতুন প্রণোদনা কর্মসূচি পাস করতে পারবেন না। রিপাবলিকানরা কর হ্রাসে সম্মত হবেন, বিশেষত যদি তা সম্পদশালীদের জন্য সহায়ক হয়। অর্থনীতির মন্থর গতি অব্যাহত থাকবে, যার ফল হবে দেশের জন্য ভয়াবহ।
এই নির্বাচনের ফলাফল ওবামা প্রশাসনের একটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিতে পৌঁছার প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কার্বন নিঃসরণের সীমা নির্ধারণ হোঁচট খাবে।
যুক্তরাষ্ট্র যে সংকটে, তার জন্য বিভিন্নজনকে দোষ দেওয়ার সুযোগ অজস্র। রক্ষণশীল রিপাবলিকান পার্টির যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গঠনমূলক কিছু দেওয়ার নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ওবামার চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছে। ওবামার ঘাড়েও কিছু দোষ পড়ে। গৃহযুদ্ধ অথবা মহামন্দার মতো কাঠামোগত সংকট প্রেসিডেন্টদের সামনে ভয়ানক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিরাট সম্ভাবনাও হাজির করে। তিনি যদি ব্যর্থ হন, কলঙ্কের কালিমা পড়ে ব্যক্তি ও দলের ওপর। সংকটের সময় প্রেসিডেন্টকে হতে হয় বলিষ্ঠ, তাঁকে অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলোকে মোকাবিলায় অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিতে হয়। অন্যদিকে তাঁকে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির দ্বারস্থ হতে হয়, যা এসব উদ্যোগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করে আর বিরোধীদের শক্তি খর্ব করে। এবার উভয় ক্ষেত্রেই ওবামা ব্যর্থ। তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচি অতীতের তুলনায় যত বিশালই হোক না কেন, তাতে বলিষ্ঠতা ছিল না। আর এসব উদ্যোগ যে অত্যন্ত জরুরি, সেটা জনগণের কাছে তুলে ধরতে তিনি আশ্চর্যজনক ব্যর্থতা দেখিয়েছেন।
এই নির্বাচনের ফলাফলে ওবামার রাজনৈতিক ব্যর্থতা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। অর্থনৈতিক অধোগতি মার্কিনদের মনোজগতের লোকরঞ্জনবাদী দানবিকতাকে জাগিয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের এক বিস্তৃত মধ্যম শ্রেণীর অংশ মনে করে। এরা কাজ করে এবং আইন মেনে চলে। আবার মনে করে যে তাদের সুবিধাদি কেড়ে নিচ্ছে অবৈধ অভিবাসীরা, ওয়াল স্ট্রিটের ফাটকাবাজ এবং নিষ্ঠুর অভিজাততন্ত্র। ওবামা লোকরঞ্জনবাদী কথামালায় অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি অর্থনীতির দুরবস্থার জন্য মেইন স্ট্রিটের পাশাপাশি ওয়াল স্ট্রিটকেও দায়ী করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেন, তা পূরণ করে ডানপন্থী টি পার্টিগুলো। এরা ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের ওয়াল স্ট্রিটের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও চিত্রণ করতে সক্ষম হয়।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিনে বহু ভোটারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তাঁরা কাকে দায়ী মনে করেন। জবাবে অনেকে জর্জ ডব্লিউ বুশ বা বারাক ওবামার নাম না নিয়ে বলেন ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকারদের কথা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, রিপাবলিকান পার্টির প্রতিই এসব ভোটারের পক্ষপাত দেখা গেছে (৫৬ শতাংশ)। এটা ওবামা প্রশাসনের রাজনীতির চরম ব্যর্থতারই নজির।
ওবামার ব্যর্থতার আরেকটি কারণ ভোটকেন্দ্রে তরুণ ভোটারদের অপেক্ষাকৃত কম উপস্থিতি। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে ডেমোক্র্যাটদের সাফল্যের পেছনে বড় কারণ ছিল, তরুণদের মাঝে সমর্থন বৃদ্ধি এবং বেশি সংখ্যায় তাঁদের ভোট দিতে আসা। ২০০৮ সালে তরুণ ভোটারদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন ওবামা। এবারের নির্বাচনেও ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ভোটাররা ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবার এই বর্গের ভোটার মোট ভোটারের মাত্র ১১ শতাংশ। ২০০৮ সালে তা ছিল ১৮ শতাংশ এবং ২০০৬-এ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। ওবামা ও তাঁর সহযোগীরা নির্বাচনের আগে আগে এসব ভোটারকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা চালালেও তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ক্ষতিটা হয়েছে ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, যখন ওবামা ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদেরই তৈরি স্থানীয়ভিত্তিক বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক সংগঠন ভেঙে দিলেন। ওবামা ফর আমেরিকা হয়ে গেল অর্গানাইজিং ফর আমেরিকা এবং শেষমেশ ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটিতে ঢুকে পড়ল। ফলে হয়ে পড়ল নখদন্তহীন। এভাবে ওবামার সাংগঠনিক প্রচেষ্টার উত্থান ও পতন ঘটল।
এ নির্বাচনের ফলাফলকে অতীতের মতো রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রত্যাবর্তন হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নেতৃত্বের অভাবে রিপাবলিকানরা এখনো বিভক্ত। একদিকে আছেন কার্ল রোভ, হ্যালি বারবার, মিট রমনি ও মিচ ম্যাককোনেল আর অন্যদিকে টি পার্টি, সারাহ পেলিন, মাইক হাকাবি ও গ্লেন বেক। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি কার্যত নিষ্ক্রিয়।
১৯৯৪ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয় শুধু ক্লিনটন প্রশাসনকে প্রত্যাখ্যান করাই নয়, তা ছিল রিপাবলিকান বিকল্পের প্রতি স্বীকৃতিও। কিন্তু এবারের নির্বাচন রিপাবলিকানদের কোনো বিজয় নয়, বরং ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়। এক্সিট পোল অনুযায়ী, কংগ্রেস সদস্য নির্বাচনের ৫৩ শতাংশ ভোটার রিপাবলিকান পার্টির প্রতি বিরূপ আর ৪১ শতাংশ দলটিকে পছন্দ করেন। এই নির্বাচনের ফল কোনো নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস বা অ্যালাইনমেন্ট নয়, বরং বিদ্যমান আনুগত্যে মাঝারি মাপের পরিবর্তন নির্দেশ করে। ডেমোক্র্যাটরা কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো ও পেশাজীবী ভোটারদের আনুগত্য ধরে রাখতে পেরেছেন, যদিও কিছু হারে ভোট কমেছে। তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি কম হওয়ায় ডেমোক্র্যাটরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে যেসব শ্বেতাঙ্গ ভোটারের কোনো কলেজ ডিগ্রি নেই, তাঁদের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে ভোটের ব্যবধান বেড়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটের এই ধরন অতীতের মতোই।
এবারের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রাজনীতি কোন জায়গায় এসে দাঁড়াল? অর্থনীতির অধোগতি যদি অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে (সে সম্ভাবনাই প্রবল), আর যদি রিপাবলিকানরা উগ্র ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং ২০১২ সালে মিট রমনির মতো কারও পেছনে একতাবদ্ধ হতে পারেন এবং যে আন্দোলন ওবামাকে হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দিয়েছে, সেই আন্দোলন যদি ডেমোক্র্যাটরা ফিরিয়ে না আনতে পারেন, তাহলে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানরা জিতে যেতে পারেন। কিন্তু দেশের ভেতরে ও বাইরে যুক্তরাষ্ট্র যেসব মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো রয়ে গেলে কোনো নেতার বা দলের বিজয় বেশি দিন স্থায়ী হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বিন্যাস, যেখানে একটি দল এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে প্রাধান্যে থাকে। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি। ২০০১ সালে কার্ল রোভ ভেবেছিলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ যে নতুন রিপাবলিকান প্রাধান্য তৈরি করেছেন, তা কয়েক দশক টিকবে। আবার ওবামা নির্বাচিত হওয়ার সময় বহু ডেমোক্র্যাট ভাবলেন, রুজভেল্টের মতো ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য সৃষ্টির সম্ভাবনা তাঁর আছে। কিন্তু তা ঘটল না। দলীয় অনুগতদের জন্য এটা যেমন সুখবর নয়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। যে অচলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নিমজ্জিত, তাতে দরকার বলিষ্ঠ ও দৃঢ় নেতৃত্ব। মধ্যবর্তী নির্বাচন কোনো বার্তা দিয়ে থাকলে তা হলো, আগামী দুই বছর কিংবা ১০ বছরেও হয়তো তেমন নেতৃত্বের দেখা মিলবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জন বি জুডিস: যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ রিপাবলিক ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক।
রিপাবলিকানরা হয়তো বলতে পারেন, রক্ষণশীল রিপাবলিকান প্রাধান্যের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের লক্ষণ এই নির্বাচন। আসলে তেমনটি ঘটেনি। এই নির্বাচন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ব্যবস্থাগত সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। এমন সংকট দেশটিকে কিছু সময় পর পরই মোকাবিলা করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র যখন গৃহযুদ্ধ, ১৮৯০-এর মন্দা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং মহামন্দা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো বড় সংকট পার হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রতিবারই আগের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়েছে—চাঙা অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব অর্জন করেছে। এর বড় কারণ, দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থা সে সময়ের প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল। এবারের নির্বাচনের পর মনে হয়, আর হয়তো তেমনটি ঘটবে না।
অর্থনীতির অধোগতির সঙ্গে ১৮৯০ ও ১৯৩০-এর মহামন্দার কাঠামোগত সাদৃশ্য দেখা যায়। ঋণে ডুবে থাকা মার্কিন জনগণের এখন প্রতি ছয়জনে একজনের পূর্ণকালীন কাজ নেই। তারা ব্যয় করছে না। বণিকেরা পণ্যের চাহিদা সম্পর্কে অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ করছেন না। ফেডারেল রিজার্ভ কার্যত ক্ষমতাহীন। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত চাহিদা ও বিনিয়োগের প্রণোদনা দেওয়ার একমাত্র পথ হলো সরকারি ব্যয়। ওবামা তাঁর প্রাথমিক কর্মসূচির মাধ্যমে সেটাই করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বাস্থ্যসেবা বিল প্রত্যাহারের ম্যান্ডেট হয়তো রিপাবলিকানরা পাননি, কিন্তু ব্যয়সংকোচনের ম্যান্ডেট তাঁরা পেয়েছেন। অনেক ভোটার মনে করছেন, ওবামার প্রণোদনা কর্মসূচি আসলে বেকারত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে এবং সরকারি ব্যয়সংকোচন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি ত্বরান্বিত করবে। এসবই বাজে কথা—১৯৩৭ সালের যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ১৯৯০ সালের জাপানের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। কিন্তু এমন চিন্তাই কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা নতুন প্রণোদনা কর্মসূচি পাস করতে পারবেন না। রিপাবলিকানরা কর হ্রাসে সম্মত হবেন, বিশেষত যদি তা সম্পদশালীদের জন্য সহায়ক হয়। অর্থনীতির মন্থর গতি অব্যাহত থাকবে, যার ফল হবে দেশের জন্য ভয়াবহ।
এই নির্বাচনের ফলাফল ওবামা প্রশাসনের একটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিতে পৌঁছার প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কার্বন নিঃসরণের সীমা নির্ধারণ হোঁচট খাবে।
যুক্তরাষ্ট্র যে সংকটে, তার জন্য বিভিন্নজনকে দোষ দেওয়ার সুযোগ অজস্র। রক্ষণশীল রিপাবলিকান পার্টির যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গঠনমূলক কিছু দেওয়ার নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ওবামার চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছে। ওবামার ঘাড়েও কিছু দোষ পড়ে। গৃহযুদ্ধ অথবা মহামন্দার মতো কাঠামোগত সংকট প্রেসিডেন্টদের সামনে ভয়ানক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিরাট সম্ভাবনাও হাজির করে। তিনি যদি ব্যর্থ হন, কলঙ্কের কালিমা পড়ে ব্যক্তি ও দলের ওপর। সংকটের সময় প্রেসিডেন্টকে হতে হয় বলিষ্ঠ, তাঁকে অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলোকে মোকাবিলায় অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিতে হয়। অন্যদিকে তাঁকে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির দ্বারস্থ হতে হয়, যা এসব উদ্যোগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করে আর বিরোধীদের শক্তি খর্ব করে। এবার উভয় ক্ষেত্রেই ওবামা ব্যর্থ। তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচি অতীতের তুলনায় যত বিশালই হোক না কেন, তাতে বলিষ্ঠতা ছিল না। আর এসব উদ্যোগ যে অত্যন্ত জরুরি, সেটা জনগণের কাছে তুলে ধরতে তিনি আশ্চর্যজনক ব্যর্থতা দেখিয়েছেন।
এই নির্বাচনের ফলাফলে ওবামার রাজনৈতিক ব্যর্থতা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। অর্থনৈতিক অধোগতি মার্কিনদের মনোজগতের লোকরঞ্জনবাদী দানবিকতাকে জাগিয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের এক বিস্তৃত মধ্যম শ্রেণীর অংশ মনে করে। এরা কাজ করে এবং আইন মেনে চলে। আবার মনে করে যে তাদের সুবিধাদি কেড়ে নিচ্ছে অবৈধ অভিবাসীরা, ওয়াল স্ট্রিটের ফাটকাবাজ এবং নিষ্ঠুর অভিজাততন্ত্র। ওবামা লোকরঞ্জনবাদী কথামালায় অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি অর্থনীতির দুরবস্থার জন্য মেইন স্ট্রিটের পাশাপাশি ওয়াল স্ট্রিটকেও দায়ী করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেন, তা পূরণ করে ডানপন্থী টি পার্টিগুলো। এরা ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের ওয়াল স্ট্রিটের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও চিত্রণ করতে সক্ষম হয়।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিনে বহু ভোটারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তাঁরা কাকে দায়ী মনে করেন। জবাবে অনেকে জর্জ ডব্লিউ বুশ বা বারাক ওবামার নাম না নিয়ে বলেন ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকারদের কথা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, রিপাবলিকান পার্টির প্রতিই এসব ভোটারের পক্ষপাত দেখা গেছে (৫৬ শতাংশ)। এটা ওবামা প্রশাসনের রাজনীতির চরম ব্যর্থতারই নজির।
ওবামার ব্যর্থতার আরেকটি কারণ ভোটকেন্দ্রে তরুণ ভোটারদের অপেক্ষাকৃত কম উপস্থিতি। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে ডেমোক্র্যাটদের সাফল্যের পেছনে বড় কারণ ছিল, তরুণদের মাঝে সমর্থন বৃদ্ধি এবং বেশি সংখ্যায় তাঁদের ভোট দিতে আসা। ২০০৮ সালে তরুণ ভোটারদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন ওবামা। এবারের নির্বাচনেও ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ভোটাররা ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবার এই বর্গের ভোটার মোট ভোটারের মাত্র ১১ শতাংশ। ২০০৮ সালে তা ছিল ১৮ শতাংশ এবং ২০০৬-এ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। ওবামা ও তাঁর সহযোগীরা নির্বাচনের আগে আগে এসব ভোটারকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা চালালেও তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ক্ষতিটা হয়েছে ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, যখন ওবামা ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদেরই তৈরি স্থানীয়ভিত্তিক বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক সংগঠন ভেঙে দিলেন। ওবামা ফর আমেরিকা হয়ে গেল অর্গানাইজিং ফর আমেরিকা এবং শেষমেশ ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটিতে ঢুকে পড়ল। ফলে হয়ে পড়ল নখদন্তহীন। এভাবে ওবামার সাংগঠনিক প্রচেষ্টার উত্থান ও পতন ঘটল।
এ নির্বাচনের ফলাফলকে অতীতের মতো রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রত্যাবর্তন হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নেতৃত্বের অভাবে রিপাবলিকানরা এখনো বিভক্ত। একদিকে আছেন কার্ল রোভ, হ্যালি বারবার, মিট রমনি ও মিচ ম্যাককোনেল আর অন্যদিকে টি পার্টি, সারাহ পেলিন, মাইক হাকাবি ও গ্লেন বেক। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি কার্যত নিষ্ক্রিয়।
১৯৯৪ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয় শুধু ক্লিনটন প্রশাসনকে প্রত্যাখ্যান করাই নয়, তা ছিল রিপাবলিকান বিকল্পের প্রতি স্বীকৃতিও। কিন্তু এবারের নির্বাচন রিপাবলিকানদের কোনো বিজয় নয়, বরং ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়। এক্সিট পোল অনুযায়ী, কংগ্রেস সদস্য নির্বাচনের ৫৩ শতাংশ ভোটার রিপাবলিকান পার্টির প্রতি বিরূপ আর ৪১ শতাংশ দলটিকে পছন্দ করেন। এই নির্বাচনের ফল কোনো নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস বা অ্যালাইনমেন্ট নয়, বরং বিদ্যমান আনুগত্যে মাঝারি মাপের পরিবর্তন নির্দেশ করে। ডেমোক্র্যাটরা কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো ও পেশাজীবী ভোটারদের আনুগত্য ধরে রাখতে পেরেছেন, যদিও কিছু হারে ভোট কমেছে। তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি কম হওয়ায় ডেমোক্র্যাটরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে যেসব শ্বেতাঙ্গ ভোটারের কোনো কলেজ ডিগ্রি নেই, তাঁদের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে ভোটের ব্যবধান বেড়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটের এই ধরন অতীতের মতোই।
এবারের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রাজনীতি কোন জায়গায় এসে দাঁড়াল? অর্থনীতির অধোগতি যদি অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে (সে সম্ভাবনাই প্রবল), আর যদি রিপাবলিকানরা উগ্র ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং ২০১২ সালে মিট রমনির মতো কারও পেছনে একতাবদ্ধ হতে পারেন এবং যে আন্দোলন ওবামাকে হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দিয়েছে, সেই আন্দোলন যদি ডেমোক্র্যাটরা ফিরিয়ে না আনতে পারেন, তাহলে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানরা জিতে যেতে পারেন। কিন্তু দেশের ভেতরে ও বাইরে যুক্তরাষ্ট্র যেসব মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো রয়ে গেলে কোনো নেতার বা দলের বিজয় বেশি দিন স্থায়ী হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বিন্যাস, যেখানে একটি দল এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে প্রাধান্যে থাকে। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি। ২০০১ সালে কার্ল রোভ ভেবেছিলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ যে নতুন রিপাবলিকান প্রাধান্য তৈরি করেছেন, তা কয়েক দশক টিকবে। আবার ওবামা নির্বাচিত হওয়ার সময় বহু ডেমোক্র্যাট ভাবলেন, রুজভেল্টের মতো ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য সৃষ্টির সম্ভাবনা তাঁর আছে। কিন্তু তা ঘটল না। দলীয় অনুগতদের জন্য এটা যেমন সুখবর নয়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। যে অচলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নিমজ্জিত, তাতে দরকার বলিষ্ঠ ও দৃঢ় নেতৃত্ব। মধ্যবর্তী নির্বাচন কোনো বার্তা দিয়ে থাকলে তা হলো, আগামী দুই বছর কিংবা ১০ বছরেও হয়তো তেমন নেতৃত্বের দেখা মিলবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জন বি জুডিস: যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ রিপাবলিক ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক।
No comments