সময়ের প্রতিবিম্ব-সংবিধান পুনর্মুদ্রণ ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি by এবিএম মূসা
সাম্প্রতিক কালে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের আদি সংবিধানে ‘ফিরে যাওয়া’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ও তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা অনেকের কাছে অস্পষ্ট। এতদসত্ত্বেও সব প্রশ্নের একটি সহজ-সরল উত্তর আছে।
তা হচ্ছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের যে মূল ভিত্তি ছিল, রাষ্ট্রপরিচালনার চারটি মূলনীতি, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। পঁচাত্তরের পর সংবিধানের প্রস্তাবনার চারটি আদর্শ থেকে যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, তা থেকে উদ্ধার পেতে হবে। বাহাত্তরে গণপরিষদে সংবিধান রচনার অনেক আগে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যশোর মুক্ত হওয়ার পর সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার চার নীতি ঘোষণা করেন। সেই চারটি ছিল গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
এই চার মূলনীতিকে বিকৃত ও বিলুপ্ত করেছিলেন পঁচাত্তরের পর ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক ও সামরিক স্বেচ্ছাচারী একনায়কেরা। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক একটি গণপরিষদ যে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করেছিল, স্বৈরশাসনের অবসানের পর আমাদের জনপ্রতিনিধিরা সেসব পুনঃস্থাপিত করতে পারেননি। প্রতিবন্ধকতা ছিল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে চার মূলনীতি রচয়িতা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২০ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এলেও জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সংসদে তাঁদের অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও চার মূলনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কতিপয় নাজুক রাজনৈতিক অবস্থান ও ধর্মীয় আবেগ মূলনীতি পুনরুদ্ধারে প্রতিবন্ধক বলে মনে করা হলো। সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করলেন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক আমাদের মহামান্য আদালত। এই মহৎ কাজটি করলেন প্রথমে উচ্চ আদালত, পরবর্তী সময়ে উচ্চতম আদালত। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা যে কাজটি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, আমাদের উচ্চতম আদালতের বিচারকেরা তা করলেন বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা নিয়ে। তাঁরা দুটি সামরিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বস্তুত আমাদের আদি সংবিধান পুনঃস্থাপন করলেন। কিন্তু স্থাপনাটি কি পুরোপুরি হয়েছে? পুনরুদ্ধার-প্রক্রিয়ায় চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠায় কি কিছু খুঁত রয়ে গেছে? এ নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করছেন। অতঃপর সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনেকগুলো ধারা, বিশেষ করে চার মূলনীতির কয়েকটি একটুখানি এদিক-ওদিক করে প্রতিস্থাপন করে সংবিধান পুস্তকটি আদালতের রায়ের অনুসরণে পুনর্মুদ্রণ করা হবে।
এখন প্রশ্ন, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে কি সত্যিই চার মূলনীতি পুরোপুরি সংযোজিত হবে? বিভ্রান্তির কারণ, আদালত যে দুটি আদেশবলে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী দ্বারা যা বাতিল করেছেন, তার ফলে অনেক বিধান কি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশনা রয়েছে? অথবা বিদ্যমান বিভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুধু জোড়া লাগিয়েছেন, সংশোধনের পথ বাতলেছেন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে ‘আপস’ পদ্ধতি বাতলেছেন। সেসব ক্ষেত্রের দুটি হলো ‘ধর্ম ও জাতীয়তা’। বাহাত্তরের আদি প্রস্তাবনা আর পঁচাত্তর-পরবর্তী উইয়ে কাটা সংবিধান পুস্তকটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। বিস্তারিত আলোচনা করব না, শুধু প্রধানমন্ত্রীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, ‘ধর্মীয় আবেগ বা অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে নবরূপে প্রকাশিত সংবিধানে এমন কোনো বিধান থাকবে না।’ অর্থাৎ আদালত ও দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আবেদন বাস্তবতার কারণে বিবেচনায় এনেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিতে ছিল বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তথা কৌশল। এই কৌশল অবলম্বনেই ‘বিএনপি’র বিসমিল্লাহও থাকবে, আওয়ামী লীগের পতাকায়ও থাকবে ‘আল্লাহু আকবর’। তবে দলীয় পরিচিতি, ধর্মীয় লেবাসযুক্ত হবে না। উভয়ের এই অবস্থানের বিরোধিতা করছি না, বরং প্র্যাগম্যাটিক তথা সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বাস্তবসম্মত মনে করি। এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম ‘আল্লাহু আকবারে’ বিশ্বাসী, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং প্রায় সব কাজের সূচনা করেন বিসমিল্লাহ বলে। তাই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর মাঝে সমন্বয় সাধন রাষ্ট্রীয় কোনো মূলনীতিবিরোধী মনে করি না। উল্লেখ্য, এই ব্যাখ্যা ইতিপূর্বেও একটি নিবন্ধে দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তবতা পাঠক সমীপে পেশ করব। ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতার মাঝে ফারাক সৃষ্টি করার রাষ্ট্রপরিচালনার এই মূলনীতির অপব্যাখ্যার অপচেষ্টা কিন্তু স্বাধীনতার পরই শুরু হয়েছিল। সেই অপচেষ্টার একটি ধূর্ত মহল বাংলাদেশে ‘মুসলিম বাংলা’ নামকরণের ধুয়া তুলেছিল। আমার নিজেরই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময়ে জনসভায় ব্যাখ্যা করতে হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে ধর্মহীনতা নয়। যার যার ধর্ম তার তার, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ কথাটির মর্মার্থ বোঝাতে হয়েছে। উপরিউক্ত বক্তব্য ব্যাখ্যার সারাংশ হচ্ছে, মূল সংবিধানে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করা হয়নি। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আদর্শটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আরেকটি ব্যাখ্যা রয়েছে ৪১(ক) অনুচ্ছেদে। ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন ও পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে একটি কৌতুককর পূর্বকথা উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরে ফিরে এসে আমাকে যখন ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিলেন, তখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদির কারণে বৈষম্যতা থাকবে না (তৃতীয়, অনুচ্ছেদ ২৮(১)’ এই দুই বিধানের সামঞ্জস্য নিয়ে একটুখানি বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম। টেলিভিশনে ও বেতারে অনুষ্ঠানের শুরুতে শুধু পবিত্র কোরআন মজিদের সূরা পঠিত হতো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনাকালে ভাবি, মানে বেগম মুজিব, একটি মজার সমাধান দিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই মিনিট পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, এক মিনিট যথাক্রমে গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পঠিত হবে এবং তা-ই করা হলো। তবে এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার ঘটে গেল। আমি মহাপরিচালকের কক্ষে বসে আছি, এক শ্মশ্রুমণ্ডিত পাগড়িধারী দেখা করতে এলেন। অদ্ভুত তাঁর আবদার শুনে বিমোহিত হলাম। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নাকি শিখদের একটি গুরুদ্বার আছে। অর্থাৎ এ দেশে যখন শিখও আছে, রেডিও-টেলিভিশনে ‘গ্রন্থসাহেব’ পাঠ করতে হবে। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম।
দ্বিতীয় মূলনীতি, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর অবস্থান এখন কী হবে নতুন ছাপানো সংবিধান পুস্তকটিতে? বাহাত্তরে লেখা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকেরা ‘বাঙালি’ বলিয়া পরিচিত হবেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানবলে শব্দটি মুছে ফেলে (দ্বিতীয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৮, অনুচ্ছেদ ৬-২) আমাদের ‘বাংলাদেশী’ পরিচয়ে ভূষিত করলেন। আমাদের মহামান্য উচ্চ আদালত বাঙালি জাতীয়তার পরিচয় আর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিচয় তথা ‘জাতীয়তাবাদ’, দুটির সমন্বয় ঘটিয়ে রায় দিয়েছেন, আমার এমনটি মনে হচ্ছে। এ নিয়েও একটি মজাদার স্মৃতি উদ্ঘাটন করছি। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানি আমল থেকে সবশেষ ১৯০৬ সালে প্রাপ্ত সর্বশেষ বাংলাদেশের পাসপোর্ট আমার সংগ্রহে আছে। প্রথম পাসপোর্টটিতে ‘জাতীয়তা’ লেখা আছে পাকিস্তানি। বাংলাদেশি পাসপোর্টটি ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের, সেবার বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার্থে লন্ডনে গিয়েছিলেন, সঙ্গে যাওয়ার জন্য এটি করিয়েছিলাম। কৌতূহলবশত দুদিন আগে সেই পাসপোর্টটি পরীক্ষা করলাম, ‘জাতীয়তার স্থলে কী লেখা আছে?’ ‘সিটিজেনশিপ’ উল্লেখে বাঙালি বা বাংলাদেশি নয়, একটি আপস করে লেখা হয়েছে, ‘সিটিজেন অব বাংলাদেশ,’ বাংলাদেশের নাগরিক। জাতীয়তা প্রশ্নটির মীমাংসায় আদালতের নির্দেশটির সঙ্গে মিল রয়েছে মনে হতে পারে।
অতঃপর ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনা নিরর্থক, কারণ ‘মুক্ত অর্থনীতির’ কল্যাণে, সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর এই সম্পত্তির সংজ্ঞা বদলে গেছে। সাম্রাজ্যবাদীরাও এখন ফিসফিস করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে। তাই সমাজতন্ত্রকে শিকেয় তুলে রেখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতিটি, ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনা করি। আমার কাছে বাহাত্তর আর কাটাছেঁড়া করা ২০০৮ সালের এপ্রিলে ও ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মুদ্রিত তিনটি সংবিধান-বই আছে। বৈদ্যনাথতলার মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।’ বাহাত্তরের সংবিধানে আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র।’ আমাদের স্বৈরশাসকেরা ১১ অনুচ্ছেদটির পরিবর্তন করেননি কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনায় অগণতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে অনুচ্ছেদটিকে পরিহাস করেছেন। স্বৈরশাসকের বিদায়ের পর জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন (১৯৯১ সালের ২৮ নম্বর আইন) আমাদের গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জনগণের শাসনাধিকার আবার আদি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে লেখা হলো, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন আমার কঠিন প্রশ্ন, সংবিধান শুধু পুনর্মুদ্রণ করেই কি সত্যিকারের ‘সংসদীয় গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে?
এই প্রশ্নটির মর্মার্থ হচ্ছে, আমাদের অতি পুরোনো ধারণা হলো সংসদীয় প্রথায় শাসনই প্রকৃত গণতন্ত্র, যদিও রাষ্ট্রপতিপদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকারও বহু দেশে কায়েম আছে। আমরা যখন সামরিক একনায়কত্ব, স্বৈরশাসনের তিক্ত স্বাদ পেলাম, তখন ‘জনগণের দ্বারা নির্বাচিত’ সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতাম। সেই ব্যবস্থাটি প্রচলন বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সহিংস ও অহিংস আন্দোলন, সংগ্রাম করলাম। ত্রিশ লাখ প্রাণ উৎসর্গ করলাম, মা-বোনের সম্ভ্রম হারালাম। বাহাত্তরের সংবিধান রচনাকারীরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথাটির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু তাতে পরিপূর্ণ প্রাণ সঞ্চার করেননি। বাস্তবে এক ব্যক্তির শাসনের আচ্ছাদনের একটি পন্থাকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কে জনগণকে উপহার দিয়েছিলেন। এই মেনে নেওয়াটা কোনো স্বৈরশাসক, আমাদের ওপর বুলেটের মাধ্যমে চাপিয়ে দেননি। আমরা স্বেচ্ছায়, ব্যালটের মাধ্যমে সানন্দে গ্রহণ করেছি। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু পরদিনই ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘সাংবিধানিক গণতন্ত্র’ সত্যিকার ধারায় প্রবাহিত হয়েছে বা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
উপরিউক্ত বক্তব্যটি আমার দেশের রাজনৈতিক সচেতন জনগণকে খোলামেলাভাবে বোঝাতে অনেক কথা বলতে হবে। এই নিবন্ধে স্থানাভাবে তা সম্ভব নয়। প্রকৃত অবস্থার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেব। বিমান নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রী-সচিব আছেন, তার পরও প্রধানমন্ত্রীকে ‘আশ্বাস’ দিতে হয়। দেশের বিদ্যমান প্রতিটি সমস্যার সমাধানের খবরে পত্রিকার পাতায় শিরোনামটি হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর’। চাঁপা রানী উত্ত্যক্তকারীদের হাতে নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে শিক্ষামন্ত্রী ফরিদপুরে যেতে কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন? আমার নিজেরই কয়েকটি অভিজ্ঞতা আছে। কোনো মন্ত্রীর কাছে কোনো ব্যক্তিগত বা সামগ্রিক সমস্যার সমাধান চাইলেই শুনতে হয়, ‘আপনাকে প্রধানমন্ত্রী সম্মান করেন, তাঁকে একবার বলুন না।’ এই হলো আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রনীতির বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে আলোচনায় আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিটির অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ ‘জনগণের প্রতিনিধি’ দ্বারা শাসিত হওয়ার অথবা ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন’ (অনুচ্ছেদ ৫৫-৩) বিধানটির পরিপন্থী নয় কি? বস্তুত জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন ধরনের ‘একনায়কত্বকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ ব্রিটেন, ভারত ও অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকরণকারী দেশগুলো সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত ‘জনপ্রতিনিধি’দের জনমত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তারপর রয়েছে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ৫৭, ৫৮ ও ৫৮-ক অনুচ্ছেদ। জনগণের নির্বাচিত সদস্য মন্ত্রী কিন্তু নির্বাচকদের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নিয়োগকর্তা, হর্তাকর্তা-বিধাতা। স্বীকার করি, দলীয় ও সরকার পরিচালনায় শৃঙ্খলাবদ্ধতার ও মন্ত্রীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এই বিধানের প্রয়োজন রয়েছে। আবার এও সত্য, এই বিধানের কারণে রাষ্ট্রপরিচালনার চারটির প্রধান মূলনীতিটি সংসদীয় গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না।
বাহাত্তরে তাড়াহুড়ো করে একটি সংবিধান প্রণয়ন জরুরি ছিল। পরবর্তীকালে সেই সংবিধানের বিকৃতি ঘটেছে, তা সংশোধনে আদালতের বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ অপরিহার্য ছিল। তার পরও এখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য চার মূলনীতি পুনরুদ্ধারে শুধু আদালতের রায় বাস্তবায়ন নয়, স্পিরিটের, মূল চেতনার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে আরও কিছু সংশোধনও প্রয়োজন। বিজ্ঞ সর্বজনশ্রদ্ধেয় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করলাম। তিনি একটি চমৎকার কথা বললেন, ‘আগে তো সংবিধানের পুরোনো রূপটি ফিরিয়ে এনে তা পুনর্মুদ্রণ করি। তারপর জাতীয় সংসদকে মূলনীতির পূর্ণ বাস্তবায়নে সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এই চার মূলনীতিকে বিকৃত ও বিলুপ্ত করেছিলেন পঁচাত্তরের পর ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক ও সামরিক স্বেচ্ছাচারী একনায়কেরা। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক একটি গণপরিষদ যে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করেছিল, স্বৈরশাসনের অবসানের পর আমাদের জনপ্রতিনিধিরা সেসব পুনঃস্থাপিত করতে পারেননি। প্রতিবন্ধকতা ছিল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে চার মূলনীতি রচয়িতা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২০ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এলেও জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সংসদে তাঁদের অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও চার মূলনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কতিপয় নাজুক রাজনৈতিক অবস্থান ও ধর্মীয় আবেগ মূলনীতি পুনরুদ্ধারে প্রতিবন্ধক বলে মনে করা হলো। সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করলেন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক আমাদের মহামান্য আদালত। এই মহৎ কাজটি করলেন প্রথমে উচ্চ আদালত, পরবর্তী সময়ে উচ্চতম আদালত। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা যে কাজটি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, আমাদের উচ্চতম আদালতের বিচারকেরা তা করলেন বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা নিয়ে। তাঁরা দুটি সামরিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বস্তুত আমাদের আদি সংবিধান পুনঃস্থাপন করলেন। কিন্তু স্থাপনাটি কি পুরোপুরি হয়েছে? পুনরুদ্ধার-প্রক্রিয়ায় চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠায় কি কিছু খুঁত রয়ে গেছে? এ নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করছেন। অতঃপর সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনেকগুলো ধারা, বিশেষ করে চার মূলনীতির কয়েকটি একটুখানি এদিক-ওদিক করে প্রতিস্থাপন করে সংবিধান পুস্তকটি আদালতের রায়ের অনুসরণে পুনর্মুদ্রণ করা হবে।
এখন প্রশ্ন, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে কি সত্যিই চার মূলনীতি পুরোপুরি সংযোজিত হবে? বিভ্রান্তির কারণ, আদালত যে দুটি আদেশবলে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী দ্বারা যা বাতিল করেছেন, তার ফলে অনেক বিধান কি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশনা রয়েছে? অথবা বিদ্যমান বিভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুধু জোড়া লাগিয়েছেন, সংশোধনের পথ বাতলেছেন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে ‘আপস’ পদ্ধতি বাতলেছেন। সেসব ক্ষেত্রের দুটি হলো ‘ধর্ম ও জাতীয়তা’। বাহাত্তরের আদি প্রস্তাবনা আর পঁচাত্তর-পরবর্তী উইয়ে কাটা সংবিধান পুস্তকটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। বিস্তারিত আলোচনা করব না, শুধু প্রধানমন্ত্রীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, ‘ধর্মীয় আবেগ বা অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে নবরূপে প্রকাশিত সংবিধানে এমন কোনো বিধান থাকবে না।’ অর্থাৎ আদালত ও দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আবেদন বাস্তবতার কারণে বিবেচনায় এনেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিতে ছিল বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তথা কৌশল। এই কৌশল অবলম্বনেই ‘বিএনপি’র বিসমিল্লাহও থাকবে, আওয়ামী লীগের পতাকায়ও থাকবে ‘আল্লাহু আকবর’। তবে দলীয় পরিচিতি, ধর্মীয় লেবাসযুক্ত হবে না। উভয়ের এই অবস্থানের বিরোধিতা করছি না, বরং প্র্যাগম্যাটিক তথা সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বাস্তবসম্মত মনে করি। এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম ‘আল্লাহু আকবারে’ বিশ্বাসী, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং প্রায় সব কাজের সূচনা করেন বিসমিল্লাহ বলে। তাই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর মাঝে সমন্বয় সাধন রাষ্ট্রীয় কোনো মূলনীতিবিরোধী মনে করি না। উল্লেখ্য, এই ব্যাখ্যা ইতিপূর্বেও একটি নিবন্ধে দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তবতা পাঠক সমীপে পেশ করব। ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতার মাঝে ফারাক সৃষ্টি করার রাষ্ট্রপরিচালনার এই মূলনীতির অপব্যাখ্যার অপচেষ্টা কিন্তু স্বাধীনতার পরই শুরু হয়েছিল। সেই অপচেষ্টার একটি ধূর্ত মহল বাংলাদেশে ‘মুসলিম বাংলা’ নামকরণের ধুয়া তুলেছিল। আমার নিজেরই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময়ে জনসভায় ব্যাখ্যা করতে হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে ধর্মহীনতা নয়। যার যার ধর্ম তার তার, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ কথাটির মর্মার্থ বোঝাতে হয়েছে। উপরিউক্ত বক্তব্য ব্যাখ্যার সারাংশ হচ্ছে, মূল সংবিধানে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করা হয়নি। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আদর্শটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আরেকটি ব্যাখ্যা রয়েছে ৪১(ক) অনুচ্ছেদে। ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন ও পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে একটি কৌতুককর পূর্বকথা উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরে ফিরে এসে আমাকে যখন ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিলেন, তখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদির কারণে বৈষম্যতা থাকবে না (তৃতীয়, অনুচ্ছেদ ২৮(১)’ এই দুই বিধানের সামঞ্জস্য নিয়ে একটুখানি বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম। টেলিভিশনে ও বেতারে অনুষ্ঠানের শুরুতে শুধু পবিত্র কোরআন মজিদের সূরা পঠিত হতো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনাকালে ভাবি, মানে বেগম মুজিব, একটি মজার সমাধান দিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই মিনিট পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, এক মিনিট যথাক্রমে গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পঠিত হবে এবং তা-ই করা হলো। তবে এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার ঘটে গেল। আমি মহাপরিচালকের কক্ষে বসে আছি, এক শ্মশ্রুমণ্ডিত পাগড়িধারী দেখা করতে এলেন। অদ্ভুত তাঁর আবদার শুনে বিমোহিত হলাম। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নাকি শিখদের একটি গুরুদ্বার আছে। অর্থাৎ এ দেশে যখন শিখও আছে, রেডিও-টেলিভিশনে ‘গ্রন্থসাহেব’ পাঠ করতে হবে। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম।
দ্বিতীয় মূলনীতি, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর অবস্থান এখন কী হবে নতুন ছাপানো সংবিধান পুস্তকটিতে? বাহাত্তরে লেখা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকেরা ‘বাঙালি’ বলিয়া পরিচিত হবেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানবলে শব্দটি মুছে ফেলে (দ্বিতীয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৮, অনুচ্ছেদ ৬-২) আমাদের ‘বাংলাদেশী’ পরিচয়ে ভূষিত করলেন। আমাদের মহামান্য উচ্চ আদালত বাঙালি জাতীয়তার পরিচয় আর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিচয় তথা ‘জাতীয়তাবাদ’, দুটির সমন্বয় ঘটিয়ে রায় দিয়েছেন, আমার এমনটি মনে হচ্ছে। এ নিয়েও একটি মজাদার স্মৃতি উদ্ঘাটন করছি। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানি আমল থেকে সবশেষ ১৯০৬ সালে প্রাপ্ত সর্বশেষ বাংলাদেশের পাসপোর্ট আমার সংগ্রহে আছে। প্রথম পাসপোর্টটিতে ‘জাতীয়তা’ লেখা আছে পাকিস্তানি। বাংলাদেশি পাসপোর্টটি ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের, সেবার বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার্থে লন্ডনে গিয়েছিলেন, সঙ্গে যাওয়ার জন্য এটি করিয়েছিলাম। কৌতূহলবশত দুদিন আগে সেই পাসপোর্টটি পরীক্ষা করলাম, ‘জাতীয়তার স্থলে কী লেখা আছে?’ ‘সিটিজেনশিপ’ উল্লেখে বাঙালি বা বাংলাদেশি নয়, একটি আপস করে লেখা হয়েছে, ‘সিটিজেন অব বাংলাদেশ,’ বাংলাদেশের নাগরিক। জাতীয়তা প্রশ্নটির মীমাংসায় আদালতের নির্দেশটির সঙ্গে মিল রয়েছে মনে হতে পারে।
অতঃপর ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনা নিরর্থক, কারণ ‘মুক্ত অর্থনীতির’ কল্যাণে, সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর এই সম্পত্তির সংজ্ঞা বদলে গেছে। সাম্রাজ্যবাদীরাও এখন ফিসফিস করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে। তাই সমাজতন্ত্রকে শিকেয় তুলে রেখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতিটি, ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনা করি। আমার কাছে বাহাত্তর আর কাটাছেঁড়া করা ২০০৮ সালের এপ্রিলে ও ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মুদ্রিত তিনটি সংবিধান-বই আছে। বৈদ্যনাথতলার মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।’ বাহাত্তরের সংবিধানে আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র।’ আমাদের স্বৈরশাসকেরা ১১ অনুচ্ছেদটির পরিবর্তন করেননি কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনায় অগণতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে অনুচ্ছেদটিকে পরিহাস করেছেন। স্বৈরশাসকের বিদায়ের পর জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন (১৯৯১ সালের ২৮ নম্বর আইন) আমাদের গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জনগণের শাসনাধিকার আবার আদি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে লেখা হলো, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন আমার কঠিন প্রশ্ন, সংবিধান শুধু পুনর্মুদ্রণ করেই কি সত্যিকারের ‘সংসদীয় গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে?
এই প্রশ্নটির মর্মার্থ হচ্ছে, আমাদের অতি পুরোনো ধারণা হলো সংসদীয় প্রথায় শাসনই প্রকৃত গণতন্ত্র, যদিও রাষ্ট্রপতিপদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকারও বহু দেশে কায়েম আছে। আমরা যখন সামরিক একনায়কত্ব, স্বৈরশাসনের তিক্ত স্বাদ পেলাম, তখন ‘জনগণের দ্বারা নির্বাচিত’ সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতাম। সেই ব্যবস্থাটি প্রচলন বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সহিংস ও অহিংস আন্দোলন, সংগ্রাম করলাম। ত্রিশ লাখ প্রাণ উৎসর্গ করলাম, মা-বোনের সম্ভ্রম হারালাম। বাহাত্তরের সংবিধান রচনাকারীরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথাটির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু তাতে পরিপূর্ণ প্রাণ সঞ্চার করেননি। বাস্তবে এক ব্যক্তির শাসনের আচ্ছাদনের একটি পন্থাকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কে জনগণকে উপহার দিয়েছিলেন। এই মেনে নেওয়াটা কোনো স্বৈরশাসক, আমাদের ওপর বুলেটের মাধ্যমে চাপিয়ে দেননি। আমরা স্বেচ্ছায়, ব্যালটের মাধ্যমে সানন্দে গ্রহণ করেছি। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু পরদিনই ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘সাংবিধানিক গণতন্ত্র’ সত্যিকার ধারায় প্রবাহিত হয়েছে বা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
উপরিউক্ত বক্তব্যটি আমার দেশের রাজনৈতিক সচেতন জনগণকে খোলামেলাভাবে বোঝাতে অনেক কথা বলতে হবে। এই নিবন্ধে স্থানাভাবে তা সম্ভব নয়। প্রকৃত অবস্থার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেব। বিমান নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রী-সচিব আছেন, তার পরও প্রধানমন্ত্রীকে ‘আশ্বাস’ দিতে হয়। দেশের বিদ্যমান প্রতিটি সমস্যার সমাধানের খবরে পত্রিকার পাতায় শিরোনামটি হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর’। চাঁপা রানী উত্ত্যক্তকারীদের হাতে নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে শিক্ষামন্ত্রী ফরিদপুরে যেতে কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন? আমার নিজেরই কয়েকটি অভিজ্ঞতা আছে। কোনো মন্ত্রীর কাছে কোনো ব্যক্তিগত বা সামগ্রিক সমস্যার সমাধান চাইলেই শুনতে হয়, ‘আপনাকে প্রধানমন্ত্রী সম্মান করেন, তাঁকে একবার বলুন না।’ এই হলো আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রনীতির বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে আলোচনায় আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিটির অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ ‘জনগণের প্রতিনিধি’ দ্বারা শাসিত হওয়ার অথবা ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন’ (অনুচ্ছেদ ৫৫-৩) বিধানটির পরিপন্থী নয় কি? বস্তুত জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন ধরনের ‘একনায়কত্বকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ ব্রিটেন, ভারত ও অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকরণকারী দেশগুলো সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত ‘জনপ্রতিনিধি’দের জনমত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তারপর রয়েছে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ৫৭, ৫৮ ও ৫৮-ক অনুচ্ছেদ। জনগণের নির্বাচিত সদস্য মন্ত্রী কিন্তু নির্বাচকদের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নিয়োগকর্তা, হর্তাকর্তা-বিধাতা। স্বীকার করি, দলীয় ও সরকার পরিচালনায় শৃঙ্খলাবদ্ধতার ও মন্ত্রীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এই বিধানের প্রয়োজন রয়েছে। আবার এও সত্য, এই বিধানের কারণে রাষ্ট্রপরিচালনার চারটির প্রধান মূলনীতিটি সংসদীয় গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না।
বাহাত্তরে তাড়াহুড়ো করে একটি সংবিধান প্রণয়ন জরুরি ছিল। পরবর্তীকালে সেই সংবিধানের বিকৃতি ঘটেছে, তা সংশোধনে আদালতের বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ অপরিহার্য ছিল। তার পরও এখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য চার মূলনীতি পুনরুদ্ধারে শুধু আদালতের রায় বাস্তবায়ন নয়, স্পিরিটের, মূল চেতনার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে আরও কিছু সংশোধনও প্রয়োজন। বিজ্ঞ সর্বজনশ্রদ্ধেয় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করলাম। তিনি একটি চমৎকার কথা বললেন, ‘আগে তো সংবিধানের পুরোনো রূপটি ফিরিয়ে এনে তা পুনর্মুদ্রণ করি। তারপর জাতীয় সংসদকে মূলনীতির পূর্ণ বাস্তবায়নে সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments