লুৎফর রহমান রনো-দুটি ঘটনা ও নারীর ক্ষমতায়ন

সম্প্রতি দুটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান কোন পর্যায়ে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অপরাধে। অন্য ঘটনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চোখের এক ডাক্তার সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন রোগিণীর সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করার


দায়ে। উলি্লখিত দুই ব্যক্তি সামাজিক, শিক্ষা ও আর্থিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজে তাই সম্মানিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। অথচ হায়, তাঁদের ধারেপাশেও একজন নারী নিরাপদ যে নয়, তা পরিষ্কার হলো। নারী মূলত কোথাও নিরাপদ নয় এ সমাজে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো বটেই, নারীর সীমাহীন দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-অসচেতনতার কারণে আমাদের দেশের কঠোর পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর জীবনে কোনো আকাঙ্ক্ষার আকাশ তো নেই-ই বরং সংকীর্ণ অন্ধকার গলি-ঘুপচি ও গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ। কথাটা উল্টোভাবে বলা যায়, নারীর অভিভাবক বা অধিকারী যে পিতা-ভ্রাতা-পতি, তাদের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্র এতই সংকীর্ণ যে তাঁরা নারীর ক্ষমতায়নকে স্বীকার করে নিতে নারাজ। ক্ষমতায়ন কথাটা অস্পষ্ট থেকে যায় অধিকাংশ কথায়-লেখায়-আলোচনায়। এনজিওগোষ্ঠীর নারী উন্নয়ন প্রকল্পের উপশিরোনাম থাকে অনেক ক্ষেত্রে 'নারীর ক্ষমতায়ন'। তারা কিভাবে নারী সমাজকে ক্ষমতায়িত করছে, তা স্পষ্ট নয়। ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে পরোক্ষভাবে স্বামী পুরুষকে সহায়তা করার মাধ্যমে, নাকি নারী-বেনিফিসিয়ারিকে ঋণগ্রস্ত করে তার মনে কিস্তি পরিশোধের ভীতি সঞ্চার করে 'ক্ষমতায়ন' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তা বোধগম্য নয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কোনোই নিয়ম-নির্দেশিকা-নিষ্ঠা বা নারী-সংবেদন সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত ডিগ্রি নিয়ে একজন নারী যখন জীবনের অপর ধাপে পা রাখে, সে কি গ্রামের অশিক্ষিত কোনো নারীর চেয়ে অধিক নিরাপদ কিংবা ক্ষমতায়িত? মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসংখ্য নারী উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করছে_তাতে নারী চিত্র চুল পরিমাণও বদলায়নি। কারণ, ওখানে পুরুষদের মন-মানসিকতা বা চেতনার দীনতা এতই নিচুমানের যে নারীর জীবনে কালো আবরণ ভেদ করে আলো পেঁৗছতে পারে না। আমাদের বড় বিদ্যাপীঠগুলোতেও নারী-ক্ষমতায়নের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কারণ, অধিকাংশ পুরুষ-শিক্ষকই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন। দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় পাওয়া গেছে। ছাত্র ও শিক্ষক উভয় পর্যায়ের অপরাধীর কথা শোনা গেছে অতীতেও। কিন্তু কী কারণে ছাত্রীদের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা কর্তৃপক্ষের! দ্বিধা কিছুটা প্রশাসনিক, বাকিটা মনস্তাত্তি্বক। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাগুক্ত শিক্ষক বরখাস্ত হওয়ার খবরে ছাত্রীরা উল্লাস করেছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মিষ্টি খেয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, দীর্ঘদিনের লালিত অভিশাপ থেকে তাদের মুক্তি ঘটেছে। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের অভিযোগ কানে নিলেও মনে নেয়নি। কাগজে লিখলেও কার্যকর করেনি। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করলেও পুরুষ হিসেবে অভিযোগটাকে তত গুরুতর মনে হয়নি। অর্থাৎ নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে স্বভাবতই অবহেলা। সম্মান দেখাতেই যেন অসম্মান বোধ করা। নারীকে সম্মান করাই হলো ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ। অপর পক্ষে প্রাগুক্ত রোগিণী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে তাঁর বন্ধু ও মিডিয়ার লোকদের ফোন করেছেন। তাঁর ফোন পেয়ে কেউ অবহেলা করেনি_সবাই ছুটে এসেছে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বাধ্য হয়েছে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সাময়িকভাবে ওই ডাক্তারকে বরখাস্ত করতে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া ও বন্ধুদের সমাজে নারী-ক্ষমতায়নের সংস্কৃতি প্রণিধানযোগ্য। অতএব, নারীর ক্ষমতায়নের স্লোগান যত্রতত্র শোনা যায়, যা একান্ত নিরর্থক। একটি বড় ডিগ্রি, বড় চাকরি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অনেক উপাদানের একটি মাত্র। সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো পরিবার। ঘরের ভেতরে মেয়েকে যথাযথ সম্মান দিলে, তা-ই বাইরে প্রতিফলিত হবে। যদি ভাইয়ের সঙ্গে বোনের পার্থক্য পৈতৃক উত্তরাধিকারের হিস্যানুসারে ঘটে, মর্যাদাও যদি ভাইয়ের অর্ধেক হয়ে যায় বোনের বেলায়; তাহলে সে ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনে সমান অংশীদার করা উচিত। এখানে ধর্মের কথা অবধারিতভাবে আসবে। ইসলাম নারীর হিস্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দেড় হাজার বছর আগে। বর্বর সমাজে সেটা ছিল বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। ভাইয়ের অংশের অর্ধেক সেই যুগে দেওয়াটাও ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু ইসলাম এর চেয়ে বেশি দিতে নিষেধ করেনি। কন্যাসন্তানকে অর্ধেকের কম বা নিঃসম্বল করতে না পারে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, সেই মহান লক্ষ্যেই এ বিধান এসেছে। কিন্তু যেহেতু নারীর অবস্থার পরিবর্তন পুরুষের অনুপাতে হচ্ছে না, তাই একবিংশ শতকে পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা উচিত। ভাই যখন বোনকে, পিতা কন্যাকে নিজেদের মতো মর্যাদার সমকক্ষ মানুষ হিসেবে ভাবতে পারবে, তখন স্বামীও স্ত্রীকে মানুষের মর্যাদা দেবে। স্রেফ ঘরের আসবাব বা আজীবন গৃহদাসীরূপে দেখবে না। সর্বাগ্রে সম্মান দিতে শিখতে হবে নিজের ঘরে, পরিবারে।
যে ছেলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে_শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় সে ছেলে তার মা-বোনকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে অভ্যস্ত নয়। এমনকি ছেলের মা তার বাবার কাছ থেকেও অনুরূপ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যবহার পেয়ে আসছে। এই পুরুষতান্ত্রিক ঘৃণ্য পরম্পরাই সর্বত্র ছেয়ে আছে। আর তা অতিক্রমের জন্য শিক্ষাকেন্দ্রের সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে। পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আখ্যান-প্রতিবেদনে পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রসাধনী-সনাতনী নারী ভাবনা থেকে বিযুক্ত হয়ে লিখিয়েদের চেতনাকে বিনির্মাণ করা ছাড়া নারী-মর্যাদার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কবিতা-গল্প-উপন্যাসে নারী চরিত্র নির্মাণের মুহূর্তে অন্তর্গত তাগিদ থাকতে হবে_প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ভাঙতে হবে এবং পুনর্নির্মাণও করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.