গতকাল সমকাল-মার্শাল চেন ই-র কবিতা আর বাংলাদেশের আঞ্চলিক বিদেশনীতি by ফারুক চৌধুরী
পঞ্চাশের দশকের শেষ দুটি বছর আর ষাটের দশকে (সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তাণ্ডবের সময়টি বাদ দিলে) মার্শাল চেন ই ছিলেন চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চীনের লংমার্চখ্যাত এই সেনাপতির অন্য একটি পরিচয়ও রয়েছে। চীনের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃকুলের মধ্যে কবি হিসেবে চেয়ারম্যান মাও সেতুয়ের পরেই তাঁর স্থান।
তাঁর ছেলে চেন হাও সু বর্তমানে চীনের গণমৈত্রী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনিও একজন স্বনামধন্য কবি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত ওই অ্যাসোসিয়েশনটির লক্ষ্য হলো বহির্বিশ্বের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের পর্যায়ে চীনের জনগণের বন্ধুত্ব স্থাপন করা। একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চীন-বাংলাদেশ গণমৈত্রী অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে সম্প্রতি তিনি ঢাকা সফর করেন।
ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত জাং শিয়ান ই, চীন-বাংলাদেশ গণমৈত্রী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনওয়ারুল আমিন ও চীনা প্রতিনিধিদল সমভিব্যহারে আমার বাসায় একটি অনানুষ্ঠানিক এবং অন্তরঙ্গ নৈশভোজে মিলিত হয়। সুন্দর সেই সন্ধ্যাটি কাটে ষাটের দশকে চীনে অবস্থানকালে তাঁর বাবা মার্শাল চেন ই-র সঙ্গে আমার নৈকট্যের স্মৃতিচারণায় মূলত কবিতা আর গল্পের ভুবনে। সেই সন্ধ্যায় চেন হাও সু তাঁর বাবার জনপ্রিয় একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশে লিখিত কবিতাটির দুটি পঙিক্তর ভাবার্থ হলো:
‘নদীর উৎসের অববাহিকায় আমার বাস
তোমার অবস্থান নিম্ন অঞ্চলে
আমরা একই নদীর স্বচ্ছ জল পান করি
আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধনের সীমা আকাশের অসীমে।’
চেন হাও সুর চিন্তায় তাঁর বাবার কবিতাটি বাংলাদেশের বেলায়ও প্রযোজ্য। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস চীনে এবং ভারত হয়ে তা বাংলাদেশে প্রবাহিত। কথাটি সত্য। তবে এও সত্য যে পররাষ্ট্রনীতি অথবা রাষ্ট্রনীতি কবিতাসভায় প্রণীত হয় না। এই অঞ্চলে ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হওয়ায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনি বাহাদুর শাহ জাফরের নিজ দেশে অন্তিমশয়নের জন্য তিন গজ জমি না পাওয়ার মর্মস্পর্মী গজল। ‘ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ যদি সত্যিকার অর্থেই ‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল একদেহে’ লীন হতো, তাহলে রবিঠাকুরের একটি পরিচিতি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে হতো আর উপমহাদেশের অবয়ব এত ক্ষতবিক্ষত হতো না। কবির ইতিহাস-দর্শন আর রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে যোজনের তফাত।
আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সংজ্ঞায় রয়েছে পারস্পরিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এগিয়ে চলা। তবে এই সম্পর্ক নিবিড় করার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনসাধারণের আর্থসামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও মঙ্গলসাধন। সে জন্যই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে আন্তজাতীয় সম্পর্কের ধরন বদলাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থলে গড়ে উঠছে অঞ্চলভিত্তিক সম্পর্ক। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যার সাফল্যের একটি প্রধান কারণ হলো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। তবে পৃথিবীর সর্বস্থলে এখনো তা সম্ভব নয়। সার্কই তার একটি প্রমাণ। সার্ক যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না, তা নয়। তবে সংস্থাটিতে খাজনার চেয়ে বাজনাই বড়। অর্জনের চেয়ে তাতে অধিকতর গুরুত্ব পায় আনুষ্ঠানিকতা। সার্কের স্থবিরতার প্রধান কারণ ভারত-পাকিস্তান বৈরী সম্পর্ক। তার ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলার পেশিশক্তি সার্কের নেই। সার্ক সেখানে নিরুপায়।
সৈনিক কবি চেন ই-র মৃত্যু হলো ৫ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। কাকতালীয়ভাবে তার এক মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলেন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহমর্মিতার ডাক। তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় বললেন, ‘আমরা যদি তা (অর্থনৈতিক সহযোগিতা) অর্জন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’
তাঁর সেই ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মে’র একজন তো হলেন দেশের বর্তমান সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূরাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। দুটি দ্রুত উন্নয়নগামী শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত আর চীনের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ক্ষমতায় আসার পর গত প্রায় দুই বছরে ভারত ও চীনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু উদ্যোগ শেখ হাসিনা নিয়েছেন। দুটি দেশই তিনি সফর করেছেন। তার বিস্তারিত বর্ণনা পাঠকের জন্য পুনরাবৃত্তিই হবে। তবে আশার বিষয়টি এই যে দুই সফরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো একটি চলমান প্রক্রিয়ার অধীন রয়েছে, তার ‘ফলোআপ’ কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এখনো নজরে পড়েনি এবং তার ফলে দুই সফরই বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনার চীন সফরে একটি নতুন উদ্যোগের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে তা হলো, বাংলাদেশ, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ভাবনা। শেখ হাসিনার চীন সফরের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সফর করলেন চীনের উপরাষ্ট্রপতি সি জিন পিং, যিনি ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হু জিন তাওয়ের উত্তরসূরি হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। মোদ্দা কথাটি হলো, এখন উচ্চতম পর্যায়েই সহযোগিতার আলোচনা চলছে। তবে সেই সহযোগিতার মাধ্যমে পারস্পরিকভাবে লাভবান হওয়া একান্তই অপরিহার্য। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা ভুটানও সফর করেছেন; এই অঞ্চলে সংযোগ উন্নততর করার জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) অভিমত প্রকাশ করেছে যে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপন করা গেলে তা বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে (এইচইউবি) রূপান্তর করবে। এসব উদ্যোগ ভবিষ্যৎমুখী ও আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মতোই যথেষ্ট ব্যাপক এবং বহুমুখী। চেন ই-র উল্লিখিত কবিতার ভাবনার জের ধরে নদীর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত হয়েও আমরা চীন আর ভারতের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র আর গঙ্গার স্বচ্ছ জল পান করতে পারি। (অবশ্য মাঝপথে বাঁধ আর পানি প্রত্যাহার সত্ত্বেও যদি যথেষ্ট পানি অবশিষ্ট থাকে!!)
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এমনই যে চীন ও ভারতের এই অঞ্চলটিতে বাংলাদেশ সীমিতভাবে হলেও দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, যা অঞ্চলটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
উল্লিখিত ‘সীমিত’ শব্দটির প্রয়োগের কারণ বিবিধ। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা সার্ককে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। এ ক্ষেত্রে চীন-ভারত বৈরিতাও তা করতে পারে। পশ্চিমের আকসাই চীনে আর পূর্বের অরুণাচল প্রদেশে, এই দুই দেশের যে সীমান্তবিরোধ রয়েছে, তার সম্মিলিত আয়তন হলো এক লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ গোটা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে সামান্য কম। তবে ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধের পর ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধীর চীন সফর থেকে শুরু করে চীন-ভারত সম্পর্কের পরিচালনায় যথেষ্ট পরিপক্বতা এসেছে। ১৯৯৩ সালের চুক্তির ফলে যার যার দখলকৃত অঞ্চলের সীমানা ধরে শান্তি বজায় রয়েছে। তা ছাড়া ১৯৯৬ সালে একটি চুক্তি হয়েছে যে সেই দখলকৃত লাইন ধরে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টির (সিবিএম) ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সশস্ত্র সংঘাত এড়াতে এ সতর্কতা। এদিকে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং কৃষি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক লেনদেন বেড়েই চলেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫০ বিলিয়ন ডলার বহু আগেই অতিক্রম করেছে। কিন্তু অন্য বিচারে চীন এখন প্রতিরক্ষা খাতে প্রতিবছর ব্যয় করছে ৭৫ বিলিয়ন ডলার আর ভারত ৩০ বিলিয়ন। দুই দেশেরই নৌবাহিনীর আকার এবং বিধ্বংসীক্ষমতা বাড়ছে, পারমাণবিক পেশি হচ্ছে দৃঢ়তর। তা ছাড়া তাদের সম্পর্কে রয়েছে পাকিস্তান ‘ফ্যাক্টর’ এবং বৃহত্তর পরিধিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফ্যাক্টর’।
বিশাল এবং ভয়াবহ এই কণ্টকাকীর্ণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলনশক্তি দুর্বল। তবে চীন ও ভারত—এই দুই দেশ নিয়ে যে উদ্যোগ হালে নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন এ অঞ্চলে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক বিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হলো আঞ্চলিক এই বিদেশনীতির বাস্তবায়নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা। তা না হলে অর্থবহভাবে এগোনো অসম্ভব। রাজনীতিতে মতভেদ তো থাকবেই, তবে বহুবিধ ক্ষেত্রে মতৈক্যের বিকল্প নেই। ভারতের পররাষ্ট্র-সম্পর্ক পরিচালনায় আমরা তা প্রত্যক্ষ করে থাকি।
মার্শাল চেন ই-র ছেলে চেন হাও সু যাওয়ার বেলায় আমার জন্য একটি কবিতা রচনা করেছেন, যার বাংলা অনুবাদ আমি বাংলাদেশ-চীন গণমৈত্রী সংঘের সৌজন্যে উপস্থাপিত করছি। কবিতাটির শিরোনাম ‘আমার শ্রদ্ধায় বাংলাদেশ’।
‘বিশাল ঝিলের জলে শাপলার ঘ্রাণ নিয়ে
অপার সবুজের বুকে ওঠে সোনালি সূর্য
মরমি কবির হূদয় গায় প্রেমের গান
উদার সৈনিক লিখেছে সাহসী ইতিহাস
বিশাল জনতা প্রাচীন প্রাচুর্যের পরিণাম
অথৈ জলরাশি উজ্জ্বল আগামীর কবিতা
সমাজের প্রগতি কালের মহাকাব্য
এশিয়ার একতায় লুকানো বিশ্বের শান্তি।’
‘এশিয়ার একতায় লুকানো বিশ্বের শান্তি।’ কবিতার এই অন্তিম পঙিক্তটি আশাজাগানিয়া। রাষ্ট্রনীতি কবিতায় উচ্চারিত হয় না—কথাটি যথার্থ। তবে টেকসই প্রগতির জন্য রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন রয়েছে স্বপ্ন আর রূপকল্পের সমন্বয় সাধনের। গণতন্ত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের নগ্ন সংঘাত নয়। গণতন্ত্র মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর অভিলাষ পূর্ণ করার প্রকৃষ্ট পন্থা। আর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক বিদেশনীতি সেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রারই একটি প্রয়োজনীয় এবং বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। একটি দুর্বল রাষ্ট্র এভাবেই সবল হয়। একটি স্থবির অবস্থান এই উপলব্ধিতেই হয় গতিশীল।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
zoaf@bdmail.net
ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত জাং শিয়ান ই, চীন-বাংলাদেশ গণমৈত্রী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনওয়ারুল আমিন ও চীনা প্রতিনিধিদল সমভিব্যহারে আমার বাসায় একটি অনানুষ্ঠানিক এবং অন্তরঙ্গ নৈশভোজে মিলিত হয়। সুন্দর সেই সন্ধ্যাটি কাটে ষাটের দশকে চীনে অবস্থানকালে তাঁর বাবা মার্শাল চেন ই-র সঙ্গে আমার নৈকট্যের স্মৃতিচারণায় মূলত কবিতা আর গল্পের ভুবনে। সেই সন্ধ্যায় চেন হাও সু তাঁর বাবার জনপ্রিয় একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশে লিখিত কবিতাটির দুটি পঙিক্তর ভাবার্থ হলো:
‘নদীর উৎসের অববাহিকায় আমার বাস
তোমার অবস্থান নিম্ন অঞ্চলে
আমরা একই নদীর স্বচ্ছ জল পান করি
আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধনের সীমা আকাশের অসীমে।’
চেন হাও সুর চিন্তায় তাঁর বাবার কবিতাটি বাংলাদেশের বেলায়ও প্রযোজ্য। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস চীনে এবং ভারত হয়ে তা বাংলাদেশে প্রবাহিত। কথাটি সত্য। তবে এও সত্য যে পররাষ্ট্রনীতি অথবা রাষ্ট্রনীতি কবিতাসভায় প্রণীত হয় না। এই অঞ্চলে ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হওয়ায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনি বাহাদুর শাহ জাফরের নিজ দেশে অন্তিমশয়নের জন্য তিন গজ জমি না পাওয়ার মর্মস্পর্মী গজল। ‘ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ যদি সত্যিকার অর্থেই ‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল একদেহে’ লীন হতো, তাহলে রবিঠাকুরের একটি পরিচিতি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে হতো আর উপমহাদেশের অবয়ব এত ক্ষতবিক্ষত হতো না। কবির ইতিহাস-দর্শন আর রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে যোজনের তফাত।
আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সংজ্ঞায় রয়েছে পারস্পরিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এগিয়ে চলা। তবে এই সম্পর্ক নিবিড় করার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনসাধারণের আর্থসামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও মঙ্গলসাধন। সে জন্যই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে আন্তজাতীয় সম্পর্কের ধরন বদলাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থলে গড়ে উঠছে অঞ্চলভিত্তিক সম্পর্ক। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যার সাফল্যের একটি প্রধান কারণ হলো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। তবে পৃথিবীর সর্বস্থলে এখনো তা সম্ভব নয়। সার্কই তার একটি প্রমাণ। সার্ক যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না, তা নয়। তবে সংস্থাটিতে খাজনার চেয়ে বাজনাই বড়। অর্জনের চেয়ে তাতে অধিকতর গুরুত্ব পায় আনুষ্ঠানিকতা। সার্কের স্থবিরতার প্রধান কারণ ভারত-পাকিস্তান বৈরী সম্পর্ক। তার ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলার পেশিশক্তি সার্কের নেই। সার্ক সেখানে নিরুপায়।
সৈনিক কবি চেন ই-র মৃত্যু হলো ৫ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। কাকতালীয়ভাবে তার এক মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলেন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহমর্মিতার ডাক। তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় বললেন, ‘আমরা যদি তা (অর্থনৈতিক সহযোগিতা) অর্জন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’
তাঁর সেই ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মে’র একজন তো হলেন দেশের বর্তমান সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূরাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। দুটি দ্রুত উন্নয়নগামী শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত আর চীনের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ক্ষমতায় আসার পর গত প্রায় দুই বছরে ভারত ও চীনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু উদ্যোগ শেখ হাসিনা নিয়েছেন। দুটি দেশই তিনি সফর করেছেন। তার বিস্তারিত বর্ণনা পাঠকের জন্য পুনরাবৃত্তিই হবে। তবে আশার বিষয়টি এই যে দুই সফরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো একটি চলমান প্রক্রিয়ার অধীন রয়েছে, তার ‘ফলোআপ’ কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এখনো নজরে পড়েনি এবং তার ফলে দুই সফরই বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনার চীন সফরে একটি নতুন উদ্যোগের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে তা হলো, বাংলাদেশ, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ভাবনা। শেখ হাসিনার চীন সফরের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সফর করলেন চীনের উপরাষ্ট্রপতি সি জিন পিং, যিনি ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হু জিন তাওয়ের উত্তরসূরি হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। মোদ্দা কথাটি হলো, এখন উচ্চতম পর্যায়েই সহযোগিতার আলোচনা চলছে। তবে সেই সহযোগিতার মাধ্যমে পারস্পরিকভাবে লাভবান হওয়া একান্তই অপরিহার্য। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা ভুটানও সফর করেছেন; এই অঞ্চলে সংযোগ উন্নততর করার জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) অভিমত প্রকাশ করেছে যে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপন করা গেলে তা বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে (এইচইউবি) রূপান্তর করবে। এসব উদ্যোগ ভবিষ্যৎমুখী ও আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মতোই যথেষ্ট ব্যাপক এবং বহুমুখী। চেন ই-র উল্লিখিত কবিতার ভাবনার জের ধরে নদীর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত হয়েও আমরা চীন আর ভারতের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র আর গঙ্গার স্বচ্ছ জল পান করতে পারি। (অবশ্য মাঝপথে বাঁধ আর পানি প্রত্যাহার সত্ত্বেও যদি যথেষ্ট পানি অবশিষ্ট থাকে!!)
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এমনই যে চীন ও ভারতের এই অঞ্চলটিতে বাংলাদেশ সীমিতভাবে হলেও দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, যা অঞ্চলটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
উল্লিখিত ‘সীমিত’ শব্দটির প্রয়োগের কারণ বিবিধ। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা সার্ককে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। এ ক্ষেত্রে চীন-ভারত বৈরিতাও তা করতে পারে। পশ্চিমের আকসাই চীনে আর পূর্বের অরুণাচল প্রদেশে, এই দুই দেশের যে সীমান্তবিরোধ রয়েছে, তার সম্মিলিত আয়তন হলো এক লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ গোটা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে সামান্য কম। তবে ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধের পর ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধীর চীন সফর থেকে শুরু করে চীন-ভারত সম্পর্কের পরিচালনায় যথেষ্ট পরিপক্বতা এসেছে। ১৯৯৩ সালের চুক্তির ফলে যার যার দখলকৃত অঞ্চলের সীমানা ধরে শান্তি বজায় রয়েছে। তা ছাড়া ১৯৯৬ সালে একটি চুক্তি হয়েছে যে সেই দখলকৃত লাইন ধরে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টির (সিবিএম) ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সশস্ত্র সংঘাত এড়াতে এ সতর্কতা। এদিকে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং কৃষি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক লেনদেন বেড়েই চলেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫০ বিলিয়ন ডলার বহু আগেই অতিক্রম করেছে। কিন্তু অন্য বিচারে চীন এখন প্রতিরক্ষা খাতে প্রতিবছর ব্যয় করছে ৭৫ বিলিয়ন ডলার আর ভারত ৩০ বিলিয়ন। দুই দেশেরই নৌবাহিনীর আকার এবং বিধ্বংসীক্ষমতা বাড়ছে, পারমাণবিক পেশি হচ্ছে দৃঢ়তর। তা ছাড়া তাদের সম্পর্কে রয়েছে পাকিস্তান ‘ফ্যাক্টর’ এবং বৃহত্তর পরিধিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফ্যাক্টর’।
বিশাল এবং ভয়াবহ এই কণ্টকাকীর্ণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলনশক্তি দুর্বল। তবে চীন ও ভারত—এই দুই দেশ নিয়ে যে উদ্যোগ হালে নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন এ অঞ্চলে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক বিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হলো আঞ্চলিক এই বিদেশনীতির বাস্তবায়নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা। তা না হলে অর্থবহভাবে এগোনো অসম্ভব। রাজনীতিতে মতভেদ তো থাকবেই, তবে বহুবিধ ক্ষেত্রে মতৈক্যের বিকল্প নেই। ভারতের পররাষ্ট্র-সম্পর্ক পরিচালনায় আমরা তা প্রত্যক্ষ করে থাকি।
মার্শাল চেন ই-র ছেলে চেন হাও সু যাওয়ার বেলায় আমার জন্য একটি কবিতা রচনা করেছেন, যার বাংলা অনুবাদ আমি বাংলাদেশ-চীন গণমৈত্রী সংঘের সৌজন্যে উপস্থাপিত করছি। কবিতাটির শিরোনাম ‘আমার শ্রদ্ধায় বাংলাদেশ’।
‘বিশাল ঝিলের জলে শাপলার ঘ্রাণ নিয়ে
অপার সবুজের বুকে ওঠে সোনালি সূর্য
মরমি কবির হূদয় গায় প্রেমের গান
উদার সৈনিক লিখেছে সাহসী ইতিহাস
বিশাল জনতা প্রাচীন প্রাচুর্যের পরিণাম
অথৈ জলরাশি উজ্জ্বল আগামীর কবিতা
সমাজের প্রগতি কালের মহাকাব্য
এশিয়ার একতায় লুকানো বিশ্বের শান্তি।’
‘এশিয়ার একতায় লুকানো বিশ্বের শান্তি।’ কবিতার এই অন্তিম পঙিক্তটি আশাজাগানিয়া। রাষ্ট্রনীতি কবিতায় উচ্চারিত হয় না—কথাটি যথার্থ। তবে টেকসই প্রগতির জন্য রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন রয়েছে স্বপ্ন আর রূপকল্পের সমন্বয় সাধনের। গণতন্ত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের নগ্ন সংঘাত নয়। গণতন্ত্র মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর অভিলাষ পূর্ণ করার প্রকৃষ্ট পন্থা। আর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক বিদেশনীতি সেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রারই একটি প্রয়োজনীয় এবং বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। একটি দুর্বল রাষ্ট্র এভাবেই সবল হয়। একটি স্থবির অবস্থান এই উপলব্ধিতেই হয় গতিশীল।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
zoaf@bdmail.net
No comments