অর্থনীতি-অঞ্চলে বাঁধা চঞ্চল টাকা by ফারুক মঈনউদ্দীন

অর্থনীতিতে যে অলস অর্থ পড়ে থাকার কথাটি প্রায়ই শোনা যায়, সেটা মূলত ব্যাংক খাতের অবিনিয়োজিত তহবিলকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বস্তুত, আজকাল কেউ আর ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে’ বেঁধে রাখেন না। অঞ্চলে বাঁধা টাকা বলতে বোঝায় ঘরের সিন্দুকে নগদ টাকা রেখে দেওয়া।


(অবশ্য ঘোষণা-অযোগ্য টাকা ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ না থাকলে অনেকেই ঘরের সিন্দুকে নগদ টাকা রেখে দিতে বাধ্য হন। চলতি দশকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের বাড়ি তল্লাশি করে গোয়েন্দা বিভাগ নগদ সাত কোটি রুপির সন্ধান পেয়েছিল, কঠোর ব্যাংক আইনের কারণে যা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সুযোগ ছিল না)। অতএব বর্তমান বাস্তবতায় ঘরের সিন্দুকে রাখা টাকাকড়ি নয়, ব্যাংকের বিতরণযোগ্য ঋণের তুলনায় আমানতের অনুপাত বেশি থাকলে সেটাই অলস অর্থ বা তহবিল।
আমরা জানি, অর্থ বা টাকাকড়ির রয়েছে তিন ধরনের ভূমিকা: বিনিময়ের মাধ্যম, হিসাবের একক এবং মূল্যের ভান্ডার। টাকার উদ্ভব না হলে পণ্যসামগ্রীর বিনিময় সহজসাধ্য হতো না, হিসাবপত্র রাখা কঠিন হয়ে থাকত এবং কোনো জিনিসের সর্বজনস্বীকৃত মূল্য নির্ধারণ করাও সম্ভব হতো না। মূল্যের ভান্ডার হিসেবে স্বীকৃত অর্থের এই ভূমিকা অর্থনীতিবিদ কেইনসের অর্থভিত্তিক অর্থনৈতিক তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মানুষের ভোগের চেয়ে আয় যখন বেশি হয়, তখনই অলস বা উদ্বৃত্ত অর্থের উদ্ভব ঘটে। এই উদ্বৃত্ত অর্থ বা তহবিলকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়া যায়, নির্দিষ্ট সুদের হিসাবে অন্যকে ধার দেওয়া যায় অথবা মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করা যায়। মানুষ যদি নগদ টাকা অঞ্চলে বেঁধে রাখে, সেখান থেকে কোনো বাড়তি আয় হয় না। বিকল্প দুটি উপায় থাকা সত্ত্বেও মানুষ এককালে হয়তো নগদ টাকা ঘরের সিন্দুকে ফেলে রাখত, কেইনসও তেমন ধারণাই করেছিলেন। মানুষের এ প্রবণতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল যে, নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ, অর্থাৎ বিনিয়োগ করা বা ধার দেওয়ার মধ্যে নিহিত ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। হাতে নগদ টাকাকড়ি থাকলে মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাবোধ থাকে, টাকাকে অন্য কোনো সম্পদে রূপান্তরিত করে রাখলে সে নিরাপত্তাবোধ থাকে না। অথচ উদ্বৃত্ত অর্থ ধার দিলে তা থেকে সুদ আকারে বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে, মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করলে সুদের চেয়ে আরও বেশি আয় হতে পারে। তবু কেইনস মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতাকে উড়িয়ে দেননি। কারণ, নগদ টাকা ধরে রাখার বিকল্প যে দুটি পন্থা আছে, সেগুলো থেকে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা ও হাতছানি থাকলেও তার মধ্যে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং লোকসানের ঝুঁকি। নগদ টাকা হাতের কাছে রাখার নিরাপত্তাবোধ সম্পর্কে মানুষের এই মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নেওয়ার কেইনসীয় ধারণার পেছনে সম্ভবত এ কারণ ছিল যে, তখনকার যুগে ব্যাংকব্যবস্থা ততটা সংহত ছিল না, সুদৃঢ় ছিল না ব্যাংকগুলোর ভিত্তি, সুলভ ছিল না ব্যাংক পরিষেবা এবং ছিল না বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং-সুবিধা।
অলস অর্থ ঘরে রেখে দেওয়ার এই মনস্তত্ত্বের পূর্বানুমান থেকেই কেইনস তাঁর সুদের হার-সম্পর্কিত মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নগদ অর্থ ব্যবহারহীনভাবে ফেলে রাখলে সেটা দিয়ে কোনো প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টি হয় না এবং অর্থনীতিতে রাখতে পারে না কোনো অবদান। সঞ্চিত অর্থের বিকল্প ব্যবহার, অর্থাৎ বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করা নিশ্চিত করা যায়, যদি বিকল্প বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চিত আয় সম্পর্কে পূর্ব-নিশ্চয়তা পরিমাপ করে দেওয়া যায়। এই পূর্ব-নিশ্চয়তার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে কেইনসের সুদের হার তত্ত্বে। তাঁর মত ছিল, ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়ার মনুষ্য-প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন। অথচ ধ্রুপদি অর্থনীতিতে সুদকে দেখা হয়েছে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে। বর্তমানে ভোগ না করে ভবিষ্যতে ভোগ করা হবে, এই ত্যাগের জন্যই সঞ্চয়কারীকে পুরস্কৃত করা উচিত—এটাই ছিল ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদদের মতবাদ। অন্যদিকে কেইনস মনে করেন, চঞ্চল টাকাকে অঞ্চলে বেঁধে না রেখে বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন। নগদ অর্থ ধরে রাখার এই মনুষ্য-প্রবৃত্তিকে কেইনস তুলে ধরেছেন তাঁর নগদপ্রিয়তা (লিকুইডিটি প্রেফারেন্স) তত্ত্বে, যার অর্থ নগদ টাকা ধরে রাখার চাহিদা। তাঁর মতে, মানুষের নগদপ্রিয়তার তিনটি উদ্দেশ্য থাকে: (১) লেনদেনের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ স্বাভাবিক লেনদেন পরিচালনা করার জন্য মানুষের নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা। যাদের হাতে টাকা থাকে, তারা যখন ইচ্ছা যেকোনো পণ্য কিনে নগদ টাকাকে পণ্যে রূপান্তরিত করতে পারে। মানুষের আয় যত বেশি হয়, লেনদেনের জন্য নগদ অর্থের চাহিদাও তত বেশি থাকে। (২) পূর্বসতর্কতার উদ্দেশ্য—আকস্মিক ব্যয় এবং জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানুষ নগদ অর্থ হাতের কাছে রাখতে চায়। (৩) ফাটকা বাজারির উদ্দেশ্য—সুদের হার কম হলে মানুষ ফাটকা বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য নগদ টাকা হাতের কাছে রাখতে চায়, যাতে কোনো বিনিয়োগপত্রের (বন্ড) দাম কমলে সেটা তৎক্ষণাৎ কিনে ফেলা যায়। এখানে একটা বিষয় সহজেই বোঝা যায় যে, নগদপ্রিয়তা সুদের হারের বিপরীতানুপাতিকভাবে ওঠানামা করে, অর্থাৎ সুদের হার কম হলে নগদপ্রিয়তা বেশি থাকে আর সুদের হার বেশি হলে তার বিপরীত।
কেইনসের মতে, ফাটকা বাজারিতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে যে তরল অর্থ হাতে মজুদ করে রাখা হয়, সেই নিষ্ক্রিয় টাকাকে সক্রিয় করে বিনিয়োগের ধারায় নিয়ে আসার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সুদকে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে না দেখে অলস টাকাকে বিনিয়োগের ধারায় সম্পৃক্ত করার প্রণোদনা হিসেবে বিবেচনা করে কেইনস সুদের স্বরূপ সন্ধানে এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ধ্রুপদি অর্থনীতিতে যখন মজুরি-খাজনা ইত্যাদির ধারণাকে সুদের সঙ্গে সমপর্যায়ে বিবেচনা করা হয়েছে, কেইনস তার বিপরীতে সুদকে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ তখনকার যুগে মানুষ যখন বিকল্প বিনিয়োগের পরিবর্তে নগদ টাকাকড়ি ঘরে রেখে দিত, সেই প্রবণতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সুদের হারকে একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে উপস্থাপন করাই ছিল কেইনসের সুদের হার তত্ত্বের মূল ভিত্তি। আজকাল ব্যাংক পরিষেবা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে ফেলে রাখে না। ফলে যেকোনোভাবেই হোক, মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষের জমাকৃত অলস অর্থ যখন ব্যাংকের সিন্দুকে কিংবা স্থিতিপত্রে উদ্বৃত্ত পড়ে থাকে, তখন আমরা সচেতন হওয়ার প্রয়াস পাই এবং দেশের অর্থনীতির নাড়ি ধরে বোঝার চেষ্টা করি এই উপসর্গের কারণ।
সুদের হার, তার উদ্ভব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই দীর্ঘ ভূমিকার কারণ আমাদের ব্যাংক খাতের তারল্য তথা অলস তহবিল। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশের আমানত এবং ঋণ উভয়ের ওপরই সুদের তুলনামূলক উচ্চ হার নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং তার ফলে সুদের হারের কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে। এতে অবশ্যই লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ী এবং শিল্পোদ্যোক্তা মহল এবং কিছুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সামান্য কিছু সঞ্চয়স্পৃহা, পরিবর্তনের মোট ফলাফলে যার অবদান অনুল্লেখযোগ্য। কিন্তু সঞ্চয়ী মানুষের স্বাভাবিক এই আয়বঞ্চিতি অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবাহিত হয়েছে, যার জন্য হয়তো আমাদের এবং সমগ্র অর্থনীতির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়নি। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই খাতটি হচ্ছে আমাদের বিকাশমান শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজারের আচমকা উচ্চকিত ভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল একই সঙ্গে উল্লসিত এবং চিন্তিত; কারণ সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বহু সঞ্চয়কারী তাঁদের সঞ্চয় নিয়ে ঢুকে পড়েছেন শেয়ারবাজারের মতো একটা অপরিচিত অনিশ্চিত রাজ্যে। এই নতুন প্রবণতার জন্য চাঙা হয়েছে শেয়ারবাজার, কিন্তু শঙ্কিত হয়েছেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে গত বছর সাধারণ সঞ্চয়কারীরা সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বর্তমান বছরে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস এবং সুদের ওপর আয়কর আরোপের পর সাধারণ মানুষের সঞ্চয়স্পৃহা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৫৮০ কোটি টাকা। সুদের নিম্ন হারের কারণে সঞ্চয়ের অর্থ ভিন্ন খাত তথা শেয়ারবাজারে প্রবাহিত হওয়া অর্থনীতির সহজ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের সঞ্চয় শেয়ারবাজারে খাটলেও সেটি থাকে ব্যাংকিং প্রবাহের মধ্যেই। ফলে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না, যা ঋণের মূল্যকে করে তোলে আরও সুলভ। অন্যদিকে শেয়ারবাজার চলমান এবং সুদৃঢ় থাকলে অর্থনীতিতে শিল্পায়নের জন্য মূলধনের বিকল্প উৎস প্রসারিত হয়। কারণ, নতুন শিল্পোদ্যোগের জন্য ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। একটা সুস্থ বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য স্থিতিশীল শেয়ারবাজার রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কিন্তু আমাদের বিকাশমান মূলধন বাজারে শেয়ারের সরবরাহের তুলনায় বহু গুণ বেশি বিনিয়োগকারীর হঠাৎ লোভের হাতছানিকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা না যায়, সেটা যেমন শেয়ারবাজারে ডেকে আনতে পারে বিপর্যয়, তেমনি নষ্ট করে দিতে পারে মানুষের আস্থা। বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ, বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং হঠাৎ লোভের হাতছানি থেকে বিরত থাকাই হবে বিকাশমান বাজারকে স্থিতিশীল রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ। বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার কার্যকর ব্যবস্থার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকেও বিভিন্ন সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যাতে যথাযথ প্রস্তুতিহীন বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারেন এবং তা করতে হবে আর বেশি কালক্ষেপণ না করে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.