নারীর প্রতি সহিংসতা-ইভ টিজিং নিয়ে আরও কিছু কথা by মোহীত উল আলম
২৯ অক্টোবর প্রথম আলোয় ইভ টিজিংয়ের ওপর সৌরভ কর্তৃক তার প্রেমিকা মৃধাতের হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে আমার কলামটি বের হলে বেশ কিছু পাঠক-পাঠিকার প্রতিক্রিয়া জানার পর বাধ্য হচ্ছি এ সম্পর্কে আমার চিন্তার আরও কিছু অংশ প্রকাশ করতে।
দেখলাম, নারী পাঠকদের প্রায় সবাই আমার লেখায় পেশকৃত বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেও, পুরুষ পাঠকদের সবাই একমত হননি। এর মধ্যে দুজন পাঠকের চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আরও কিছু বক্তব্য পেশ করা যায় দেখছি। প্রথমজন বলেছেন, যদি আমার কোনো ছেলে বা কোনো পুরুষ আত্মীয় সৌরভের মতো একই অবস্থায় উপনীত হয়, যখন সে দীর্ঘদিনের প্রেমিকা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, তখন সে কী করবে? এ যুবকের মতে, এক হাতে তালি বাজে না। সবাই ছেলেদের দোষ দেখে, মেয়েদের দোষ দেখে না। দ্বিতীয় যুবকটি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে একটি জুনিয়র মেয়ের দুই বছর ধরে প্রেম চলছে। কিন্তু দুই মাস ধরে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। তিনি টেলিফোন করলে গালাগাল করেন। তাঁর তাই মেয়েটির বিরুদ্ধে সৌরভের মতো রাগ ওঠে। তিনি কী করবেন? আমার এক বন্ধুস্থানীয় মনোরোগ চিকিৎসক প্রায় অনুরূপ ভাষায় বলেছেন যে আমরা কলামিস্টরা খুনটা হয়ে গেলে ঘটনার ব্যাপারে জানতে পারি এবং সে সম্পর্কে লিখি, কিন্তু তার আগের ঘটনাগুলো জানেন তাঁরা। তিনি বললেন, তাঁর কাছে একজন রোগী আসে যে খুব মেধাবী ছাত্র ছিল, কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এখন সে তার প্রেমিকা মেয়েটিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে এতই বদ্ধপরিকর যে উপায়ান্তর না দেখে তার আত্মীয়স্বজন তাকে চিকিৎসক বন্ধুর কাছে নিয়ে এসেছে পেশাগত চিকিৎসার জন্য। মনোরোগ চিকিৎসক বন্ধুটি বললেন, মেয়েরা বাস্তবিকই অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়র বা প্ররোচনাকারী হিসেবে কাজ করে। তারা পুরুষ বা প্রেমিককে উত্ত্যক্ত করতে করতে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসে, যাতে প্রেমিক দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। আর আমার এক নিকটাত্মীয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলেছেন, এখনকার মায়েরা আমার মায়ের মতো নয়। তাঁরা মেয়েদেরকে ছেলেদের যে চোখে দেখে সে চোখেই দেখে, বরং আরও বেশি আদরের চোখে দেখে। তিনি মায়েদের এ পরিবর্তিত ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণও দিলেন।
ওপরের বক্তব্যগুলো সবই সত্যি। যেমন এক হাতে তালি বাজে না, মেয়েরা প্ররোচনা হিসেবে কাজ করে এবং এখনকার মায়েরা আগেকার মায়েদের চেয়ে মেয়ে সন্তানের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। এগুলোকে আমি খণ্ডনও করতে চাই না। তবে দেখছি, এগুলো আমার মূল বক্তব্যকে খণ্ডন করতে পারেনি। আমার মূল বক্তব্য ছিল সব পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা সামাজিক, আর্থিক এবং ধর্মীয়ভাবে দুর্বল অবস্থায় আছে। এ দুর্বল অবস্থানকে ঢেকে রাখতে একটি রাজনৈতিক চালের সাহায্য নেওয়া হয়, যার কার্যকারিতার জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বা নন্দনতত্ত্বে নারীকে একটি সুরম্য সুবর্ণজালে আটকে রেখে তোয়াজ করার ব্যবস্থা আছে। আর যখনই নারী এ জালের স্বর্ণতন্তুগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, তখনই তার ওপর নিবর্তনমূলক আচরণ প্রয়োগ করা হয়। তখন একজন প্রথাবিরোধী পুরুষের বিপক্ষে সমাজ যে অবস্থান নেয়, একজন প্রথাবিরোধী নারীর বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়। আর ব্যক্তিগত প্রেমরাজ্যে নিবর্তনমূলক আচরণ কখনো কখনো প্রেমিকা হত্যার পর্যায়ে পরিণত হয়।
নারী-পুরুষের সমাজ-নির্দিষ্ট ব্যবধান যে শুধু শারীরিক তা নয়, অবস্থানগতভাবেও তাদের মধ্যে শক্তির তারতম্যের ফারাক আছে—এটাই ছিল আমার মূল বক্তব্য। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যেমন শক্তির ব্যবধান থাকে, তেমনি নারী-পুরুষের মধ্যেও রাজনৈতিক শক্তির ব্যবধান আছে। এটিই আমি বলতে চেয়েছিলাম। যেমন ওপরের যে দুজন যুবক বলেছেন যে নারী বা প্রেমিকা তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন যে তাঁরা সৌরভের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা পর্যন্ত চিন্তা করছেন, কিন্তু তাঁরা এ কথাটা চিন্তায় আনতে পারছেন না যে সৌরভের মতো আচরণ করার প্রবৃত্তি শুধু যে তাঁদের ইন্দ্রিয়স্ফুরিত কোনো আবেগ তা নয়, বরঞ্চ পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমাজের স্তরে স্তরে এ রকম প্রবৃত্তি জাগানোর আশকারা রয়ে গেছে বলে তাঁদের মধ্যে এমন চিন্তা আসাটা তাঁদের কাছে অনিবার্য মনে হচ্ছে। সমাজের যেকোনো অপরাধ হওয়ার পেছনে ওই সমাজের কোথাও না কোথাও—আইনশৃঙ্খলা, অভিভাবকত্ব, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা বা শিক্ষাগত দিক থেকে—এর জন্য একটা আশকারা থাকতেই হবে, তা না হলে ওই অপরাধ সংঘটিত হবে না। জিনের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকলে তা সামাজিক আশকারা থেকে আরও উদ্দীপ্ত হয়। শক্তির কথা বললাম। ওই যে যুবক তার ইন্দ্রিয় দমন করতে পারে না বলে তার পাশবিক শক্তিকে জাগ্রত হতে অনুমতি দেয় এবং ওই যুক্তিতে প্রেমিকা হত্যা করার মতো কাজ করতে পিছপা হয় না, ওই একই যুবক তো তার সমকক্ষ শক্তিশালী আরেকটি যুবকের কোনো রকমের বিরোধপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদে তাকে খুন করবে না। এক মাস্তান আরেক মাস্তানকে ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে পরস্পরের শক্তি সম্পর্কে একটি সমতাপূর্ণ ধারণা থাকবে। কিন্তু তখনই খুন-খারাবি হয়, যখন পরস্পরের শক্তির মধ্যে তারতম্য নিশ্চিত হয়। যেমন, এক বন্ধু আরেক বন্ধুর প্রেমিকা বা মোবাইল ফোন কেড়ে নিল। তখন দেখা যাবে ক্ষতিগ্রস্ত বন্ধুটি আরও কয়েকজন বন্ধুর সহযোগে প্রথমে তার শক্তি বৃদ্ধি করবে। তারপর প্রতিশোধ নেবে। মোবাইল ফোন বা প্রেমিকা-কাড়া বন্ধুটিকে তখনই সে হত্যা করবে। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে লিঙ্গান্তরভেদের কারণেই পুরুষশাসিত সমাজে প্রেমিকের যে শক্তি প্রেমিকার সে শক্তি নেই। একজন প্রেমিক নিছক তার গায়ের জোরে সরাসরি সাক্ষাতেই ইচ্ছে করলেই তার প্রেমিকাকে পরাভূত করতে পারবে (এর যে ব্যতিক্রম নেই অবশ্য তা নয়)। শারীরিক এবং সহিংস মনোভাবযুক্ত শক্তির এ সুযোগটাই প্রেমিকের অবচেতন মনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে যেন তার নিষ্ঠুর আচরণটি তার প্রবৃত্তি থেকে সৃষ্ট। কাজেই সে প্রবৃত্তিতাড়িত একজন ব্যক্তি, তার কোনো দোষ নেই। অথচ এ প্রবৃত্তির জন্ম এবং বর্ধন সমাজের পুরুষশক্তিসঞ্চারী সূত্রগুলো থেকে যে সৃষ্ট, এটা তার ধারণায় আসে না। প্রেমিক যখন বলে যে মেয়েটি অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়র হিসেবে কাজ করে তার পাশবিক শক্তিকে প্ররোচিত করেছিল, তখন এটি হচ্ছে আসলে সে ধারণারই বহিঃপ্রকাশ যে মেয়েটি আমার চেয়ে দুর্বল ছিল বলে আমি তাকে হত্যা করতে পেরেছি। অথচ একজন প্রেমিক যখন তার প্রেমিকাকে প্রবঞ্চিত করে, তখন মেয়েটি এককভাবে ইচ্ছে করলেও তার প্রেমিককে হত্যা করতে পারে না। অথচ প্রেমিকার যে প্রেমিককে হত্যা করার মতো উদগ্র পাশবিক ইচ্ছা জাগে না তা নয়, কিন্তু সে তো একক শক্তি বলে পেরে উঠবে না (ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। প্রেমিক যে অর্থে পাশবিকতার ইন্দ্রিয়শক্তিকে একটি ছুরি চালিয়ে চরিতার্থ করতে পারে, প্রেমিকা তা পারে না। সামাজিক অর্থে তার জন্য সে আশকারা নেই। মেয়েদের পেটে যত লাথি পড়ে, পুরুষের পেটে তার শতভাগের একভাগও পড়ে না মেয়েদের দ্বারা। তাই বলে কি মেয়েদেরও ইচ্ছে করে না পুরুষের পেটে লাথি মারতে?
দুটো জিনিসের কার্যকারিতা একেবারেই মাটির সমতলে থাকে, অর্থাৎ শূন্য ডিগ্রি বা গ্রাউন্ড জিরো রিয়্যালিটিতে থাকে। একটি হচ্ছে যৌনতা এবং আরেকটি হচ্ছে বিনা শারীরিক প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার ঘটনা। যেটা সৌরভ মৃধাতের বেলায় করল। বিনা শারীরিক প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড একটি নিরেট বাস্তবতা, এটা নিয়ে কোনো ওজর চলবে না। বলা যাবে না যে আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারিনি বা আমি পুরুষের আদিম প্রবৃত্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলাম। হত্যাকাণ্ডের জন্য যখন অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়রের দায় খোঁজা হয়, তখন বোঝা যায় ঘাতক-প্রেমিক আসলে সমাজে তার জন্য পুরুষ হিসেবে যে আশকারার যুক্তিমালা রয়েছে সেটা গলায় পরতে চাইছে। এখানেই আমার আপত্তি। রাষ্ট্রনীতিতে আমরা যেটাকে ‘মাইট ইজ রাইট’ বা শক্তিই অধিকার হিসেবে মানি, সেটাও আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে রচিত হয়ে চলেছে—কখনো নান্দনিক সুবচনের মোড়কে, কখনো পুরুষ ইন্দ্রিয় বা মেইল ইগোর নামে, কখনো বা নারী ছলনাময়ী, প্ররোচনাকারী বা অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়রের নামে। অর্থাৎ, আমি বলতে চাই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সম্পর্ককে শুধু ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ বা ‘আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা রচিব এ ধরণীতে’-জাতীয় নিবিড় একমেবাদ্বিতীয়ম পরিকাঠামোর মধ্যে দেখার যে প্রবণতা সমাজের মধ্যে রয়েছে, তার ফলে আসলে পুরুষতন্ত্র আরোপিত নারী-পুরুষের অবস্থানগত তারতম্যটা সুকৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়, ফলে প্রেমিকা মনে করে বুঝি তার অবস্থান প্রেমিকের সমধিক শক্তিশালী এবং প্রেমিকও মনে করে বুঝি তার জীবন-মরণ ঝুলে আছে প্রেমিকার তাকে গ্রহণ করা বা না করার ওপর। প্রকৃত অবস্থা এ মনে করার ধারণার ঠিক উল্টো। প্রেমিকা জানে না তার অসহায়ত্বের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আর প্রেমিক জানে না যে তার ভেতরে পাশবিক প্রবৃত্তি জাগানোর মতো আশকারা বা খুনের নেশা ওঠার মতো আবেগের উৎস সমাজের বহু গোপনীয় স্তরে লুকায়িত আছে। প্রেম বা ‘তথাকথিত প্রেম’ সমাজের অন্য দশটা ব্যাপার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সমাজের অন্য দশটা ব্যাপারে যদি শক্তিশালী গতিপ্রবাহসঞ্চারী সূত্রগুলোর প্রাধান্য থাকে, তা হলে তা প্রেমের ক্ষেত্রেও থাকবে। এবং আমার আত্মীয়া যে জানালেন মেয়েদের প্রতি এখনকার মায়েরা আগের মায়েদের চেয়ে বেশি মনোযোগী, সেটি সমাজের খুব একটা ছোট অংশে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত, কিন্তু বৃহত্তর সমাজে এ কথার সমর্থন পাওয়া যাবে না। আবার, প্রকারান্তরে মায়েদের মেয়েদের প্রতি অধিকতর মনোযোগ বর্ষণ প্রমাণ করে যে এ সমাজে মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি অসহায়।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
ওপরের বক্তব্যগুলো সবই সত্যি। যেমন এক হাতে তালি বাজে না, মেয়েরা প্ররোচনা হিসেবে কাজ করে এবং এখনকার মায়েরা আগেকার মায়েদের চেয়ে মেয়ে সন্তানের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। এগুলোকে আমি খণ্ডনও করতে চাই না। তবে দেখছি, এগুলো আমার মূল বক্তব্যকে খণ্ডন করতে পারেনি। আমার মূল বক্তব্য ছিল সব পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা সামাজিক, আর্থিক এবং ধর্মীয়ভাবে দুর্বল অবস্থায় আছে। এ দুর্বল অবস্থানকে ঢেকে রাখতে একটি রাজনৈতিক চালের সাহায্য নেওয়া হয়, যার কার্যকারিতার জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বা নন্দনতত্ত্বে নারীকে একটি সুরম্য সুবর্ণজালে আটকে রেখে তোয়াজ করার ব্যবস্থা আছে। আর যখনই নারী এ জালের স্বর্ণতন্তুগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, তখনই তার ওপর নিবর্তনমূলক আচরণ প্রয়োগ করা হয়। তখন একজন প্রথাবিরোধী পুরুষের বিপক্ষে সমাজ যে অবস্থান নেয়, একজন প্রথাবিরোধী নারীর বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়। আর ব্যক্তিগত প্রেমরাজ্যে নিবর্তনমূলক আচরণ কখনো কখনো প্রেমিকা হত্যার পর্যায়ে পরিণত হয়।
নারী-পুরুষের সমাজ-নির্দিষ্ট ব্যবধান যে শুধু শারীরিক তা নয়, অবস্থানগতভাবেও তাদের মধ্যে শক্তির তারতম্যের ফারাক আছে—এটাই ছিল আমার মূল বক্তব্য। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যেমন শক্তির ব্যবধান থাকে, তেমনি নারী-পুরুষের মধ্যেও রাজনৈতিক শক্তির ব্যবধান আছে। এটিই আমি বলতে চেয়েছিলাম। যেমন ওপরের যে দুজন যুবক বলেছেন যে নারী বা প্রেমিকা তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন যে তাঁরা সৌরভের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা পর্যন্ত চিন্তা করছেন, কিন্তু তাঁরা এ কথাটা চিন্তায় আনতে পারছেন না যে সৌরভের মতো আচরণ করার প্রবৃত্তি শুধু যে তাঁদের ইন্দ্রিয়স্ফুরিত কোনো আবেগ তা নয়, বরঞ্চ পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমাজের স্তরে স্তরে এ রকম প্রবৃত্তি জাগানোর আশকারা রয়ে গেছে বলে তাঁদের মধ্যে এমন চিন্তা আসাটা তাঁদের কাছে অনিবার্য মনে হচ্ছে। সমাজের যেকোনো অপরাধ হওয়ার পেছনে ওই সমাজের কোথাও না কোথাও—আইনশৃঙ্খলা, অভিভাবকত্ব, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা বা শিক্ষাগত দিক থেকে—এর জন্য একটা আশকারা থাকতেই হবে, তা না হলে ওই অপরাধ সংঘটিত হবে না। জিনের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকলে তা সামাজিক আশকারা থেকে আরও উদ্দীপ্ত হয়। শক্তির কথা বললাম। ওই যে যুবক তার ইন্দ্রিয় দমন করতে পারে না বলে তার পাশবিক শক্তিকে জাগ্রত হতে অনুমতি দেয় এবং ওই যুক্তিতে প্রেমিকা হত্যা করার মতো কাজ করতে পিছপা হয় না, ওই একই যুবক তো তার সমকক্ষ শক্তিশালী আরেকটি যুবকের কোনো রকমের বিরোধপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদে তাকে খুন করবে না। এক মাস্তান আরেক মাস্তানকে ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে পরস্পরের শক্তি সম্পর্কে একটি সমতাপূর্ণ ধারণা থাকবে। কিন্তু তখনই খুন-খারাবি হয়, যখন পরস্পরের শক্তির মধ্যে তারতম্য নিশ্চিত হয়। যেমন, এক বন্ধু আরেক বন্ধুর প্রেমিকা বা মোবাইল ফোন কেড়ে নিল। তখন দেখা যাবে ক্ষতিগ্রস্ত বন্ধুটি আরও কয়েকজন বন্ধুর সহযোগে প্রথমে তার শক্তি বৃদ্ধি করবে। তারপর প্রতিশোধ নেবে। মোবাইল ফোন বা প্রেমিকা-কাড়া বন্ধুটিকে তখনই সে হত্যা করবে। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে লিঙ্গান্তরভেদের কারণেই পুরুষশাসিত সমাজে প্রেমিকের যে শক্তি প্রেমিকার সে শক্তি নেই। একজন প্রেমিক নিছক তার গায়ের জোরে সরাসরি সাক্ষাতেই ইচ্ছে করলেই তার প্রেমিকাকে পরাভূত করতে পারবে (এর যে ব্যতিক্রম নেই অবশ্য তা নয়)। শারীরিক এবং সহিংস মনোভাবযুক্ত শক্তির এ সুযোগটাই প্রেমিকের অবচেতন মনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে যেন তার নিষ্ঠুর আচরণটি তার প্রবৃত্তি থেকে সৃষ্ট। কাজেই সে প্রবৃত্তিতাড়িত একজন ব্যক্তি, তার কোনো দোষ নেই। অথচ এ প্রবৃত্তির জন্ম এবং বর্ধন সমাজের পুরুষশক্তিসঞ্চারী সূত্রগুলো থেকে যে সৃষ্ট, এটা তার ধারণায় আসে না। প্রেমিক যখন বলে যে মেয়েটি অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়র হিসেবে কাজ করে তার পাশবিক শক্তিকে প্ররোচিত করেছিল, তখন এটি হচ্ছে আসলে সে ধারণারই বহিঃপ্রকাশ যে মেয়েটি আমার চেয়ে দুর্বল ছিল বলে আমি তাকে হত্যা করতে পেরেছি। অথচ একজন প্রেমিক যখন তার প্রেমিকাকে প্রবঞ্চিত করে, তখন মেয়েটি এককভাবে ইচ্ছে করলেও তার প্রেমিককে হত্যা করতে পারে না। অথচ প্রেমিকার যে প্রেমিককে হত্যা করার মতো উদগ্র পাশবিক ইচ্ছা জাগে না তা নয়, কিন্তু সে তো একক শক্তি বলে পেরে উঠবে না (ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। প্রেমিক যে অর্থে পাশবিকতার ইন্দ্রিয়শক্তিকে একটি ছুরি চালিয়ে চরিতার্থ করতে পারে, প্রেমিকা তা পারে না। সামাজিক অর্থে তার জন্য সে আশকারা নেই। মেয়েদের পেটে যত লাথি পড়ে, পুরুষের পেটে তার শতভাগের একভাগও পড়ে না মেয়েদের দ্বারা। তাই বলে কি মেয়েদেরও ইচ্ছে করে না পুরুষের পেটে লাথি মারতে?
দুটো জিনিসের কার্যকারিতা একেবারেই মাটির সমতলে থাকে, অর্থাৎ শূন্য ডিগ্রি বা গ্রাউন্ড জিরো রিয়্যালিটিতে থাকে। একটি হচ্ছে যৌনতা এবং আরেকটি হচ্ছে বিনা শারীরিক প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার ঘটনা। যেটা সৌরভ মৃধাতের বেলায় করল। বিনা শারীরিক প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড একটি নিরেট বাস্তবতা, এটা নিয়ে কোনো ওজর চলবে না। বলা যাবে না যে আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারিনি বা আমি পুরুষের আদিম প্রবৃত্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলাম। হত্যাকাণ্ডের জন্য যখন অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়রের দায় খোঁজা হয়, তখন বোঝা যায় ঘাতক-প্রেমিক আসলে সমাজে তার জন্য পুরুষ হিসেবে যে আশকারার যুক্তিমালা রয়েছে সেটা গলায় পরতে চাইছে। এখানেই আমার আপত্তি। রাষ্ট্রনীতিতে আমরা যেটাকে ‘মাইট ইজ রাইট’ বা শক্তিই অধিকার হিসেবে মানি, সেটাও আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে রচিত হয়ে চলেছে—কখনো নান্দনিক সুবচনের মোড়কে, কখনো পুরুষ ইন্দ্রিয় বা মেইল ইগোর নামে, কখনো বা নারী ছলনাময়ী, প্ররোচনাকারী বা অ্যাজেন প্রভোক্যাটেয়রের নামে। অর্থাৎ, আমি বলতে চাই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সম্পর্ককে শুধু ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ বা ‘আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা রচিব এ ধরণীতে’-জাতীয় নিবিড় একমেবাদ্বিতীয়ম পরিকাঠামোর মধ্যে দেখার যে প্রবণতা সমাজের মধ্যে রয়েছে, তার ফলে আসলে পুরুষতন্ত্র আরোপিত নারী-পুরুষের অবস্থানগত তারতম্যটা সুকৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়, ফলে প্রেমিকা মনে করে বুঝি তার অবস্থান প্রেমিকের সমধিক শক্তিশালী এবং প্রেমিকও মনে করে বুঝি তার জীবন-মরণ ঝুলে আছে প্রেমিকার তাকে গ্রহণ করা বা না করার ওপর। প্রকৃত অবস্থা এ মনে করার ধারণার ঠিক উল্টো। প্রেমিকা জানে না তার অসহায়ত্বের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আর প্রেমিক জানে না যে তার ভেতরে পাশবিক প্রবৃত্তি জাগানোর মতো আশকারা বা খুনের নেশা ওঠার মতো আবেগের উৎস সমাজের বহু গোপনীয় স্তরে লুকায়িত আছে। প্রেম বা ‘তথাকথিত প্রেম’ সমাজের অন্য দশটা ব্যাপার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সমাজের অন্য দশটা ব্যাপারে যদি শক্তিশালী গতিপ্রবাহসঞ্চারী সূত্রগুলোর প্রাধান্য থাকে, তা হলে তা প্রেমের ক্ষেত্রেও থাকবে। এবং আমার আত্মীয়া যে জানালেন মেয়েদের প্রতি এখনকার মায়েরা আগের মায়েদের চেয়ে বেশি মনোযোগী, সেটি সমাজের খুব একটা ছোট অংশে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত, কিন্তু বৃহত্তর সমাজে এ কথার সমর্থন পাওয়া যাবে না। আবার, প্রকারান্তরে মায়েদের মেয়েদের প্রতি অধিকতর মনোযোগ বর্ষণ প্রমাণ করে যে এ সমাজে মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি অসহায়।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments