অস্থিতিশীলতা বাড়ল পাকিস্তানের রাজনীতিতে by ডিক্ল্যান ওয়ালস

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর দেওয়া একটি রায়ে সেখানকার তিন বছরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। নতুন করে সেখানকার রাজনীতির হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরীর দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই রায় বিচার বিভাগ ও রাজনীতির মধ্যে বিতর্ক তৈরি করল আবারও।


তবে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এই বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগও পেয়েছে। সেখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল অ্যালমিদা বলেছেন, এটা শুরুতে জোরালো কিছু ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু এখন হয়েছে ব্যাপকতর। যার ধাক্কা গিয়ে লেগেছে প্রধানমন্ত্রীর গায়ে।
বিচারপতি চৌধুরীর এই রায়ের পেছনে প্রেসিডেন্ট জারদারি উপলক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৯ সাল থেকেই এই দুজনের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এটা হয়েছিল বিচারপতি চৌধুরীকে পুনর্বহাল করতে বাধা প্রদান করার কারণে। বস্তুত তাঁরা দুজন মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন তখন থেকেই। আর গিলানির এই পরিণতির পেছনে কাজ করেছে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের দুর্নীতির তদন্তের সহযোগিতা না করায়।
মঙ্গলবারের এই রায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর একে নীরব অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, শাসক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এমনো হতে পারে আগামী বসন্তে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, সেই নির্বাচনও এগিয়ে আনতে হতে পারে।
বিচারপতি চৌধুরীর নিজের অবস্থানের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা সুবিধা হতে পারে। তাঁর পরিবারের এক সদস্যের বিরুদ্ধে সপ্তাহকালেরও কম আগে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বিলিয়নার এক প্রপার্টি ডেভেলপারের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে। এমন অভিযোগ আসার পর বিচারপতি চৌধুরীর দুর্নীতিবিরোধী যে জনপ্রিয়তা তাতে চির ধরেছিল। স্বাভাবিকভাবে মঙ্গলবারের এই রায় ঘোষণা তাঁর এই সুনামহানিকর পরিস্থিতি থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণার এই রায় নিয়ে হয়তো ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত শান্ত বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে। পিপলস পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল কামার জামান কাইরা দলীয় সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন শান্ত থাকেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তান পিপলস পার্টি কোনো অবস্থায়ই এই বিষয়টিকে রাস্তার রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চায় না। তারা চায় না রাজনীতির সঙ্গে আদালতের বিরোধ তৈরি হোক। তিনি এও মনে করিয়ে দেন, এই মুহূর্তে উত্তেজনা প্রশমন প্রয়োজন। এই নীরবতা কিংবা শান্ত থাকার ইচ্ছা প্রেসিডেন্ট জারদারির রাজনীতিতে টিকে থাকার একটা পথ বলে বিবেচিত হতে পারে। আর এই টিকে থাকার জন্য জারদারি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ব্যক্তি গিলানিকে হারাতেও রাজি আছেন।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল অ্যালমিদা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জারদারি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত টিকে থাকার কথা চিন্তা করছেন। এটা তাঁর রাজনৈতিক কৌশল। এদিকে ইউসুফ রাজা গিলানি প্রেসিডেন্ট জারদারি এবং বিচারপতি চৌধুরীর ক্রসফায়ারের শিকার হলেন। তাঁর এই পদচ্যুতির বিষয়টির সূত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে, তিনি প্রেসিডেন্ট জারদারির দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেননি। যা ছিল আদালতের নির্দেশ।
গিলানি এই নির্দেশ পালন করছিলেন না। তাঁর বক্তব্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে জারদারি এই অভিযোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারী। দুবছর অপেক্ষার পর আদালত ইউসুফ রাজা গিলানিকে আলটিমেটাম দেন। বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে তিনি যাতে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন। তা না হলে তিনি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। গিলানির সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিল; প্রথমত, আদালতের রায় অমান্য করা এবং দ্বিতীয়ত, আদালতের রায় অনুযায়ী সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা। তিনি প্রথম পথটিই বেছে নিলেন।
আদালতেই জিজ্ঞাসিত হয়েছে। সংসদ যদি আদালতের এখতিয়ার খাটো করে দেয় তাহলে কী হবে এই রায়ের? বিচারপতি চৌধুরী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন, আদালতের রায় বদলে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। একমাত্র আপিল হলে সেখানে পরিবর্তন হতেও পারে।
প্রধান বিরোধী দলের নেতা নওয়াজ শরিফ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটাই হচ্ছে আদালতের আসল গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। জিইও টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এখন সময় এসেছে আগাম নির্বাচন ঘোষণার।
প্রেসিডেন্ট জারদারির জনপ্রিয়তাও এখন হ্রাস পেয়েছে অনেক। বিশেষ করে দেশের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে মানুষ এখন তটস্থ হয়ে আছে। এই অবস্থায় তাঁকে আগামী নির্বাচনের কথা ভাবতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে জনবহুল পাঞ্জাবে। বিদ্যুতের দাবিতে বড় বড় অনেক শহরেই এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। বহু জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতে মাত্র মাসছয়েক সময় আছে এর মধ্যে কি তারা পারবে বিদ্যুতের বিশাল সমস্যা সমাধান করতে?
বুধবার সকালে পাকিস্তান টেলিভিশন সংবাদ প্রচার করে, বস্ত্রমন্ত্রী মখদুম সাহাবুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে (ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি মনোনীত হয়েছেন)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের নামও শোনা যাচ্ছিল। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট রাশিয়া সফর বাতিল করেছেন।

লেখক : সাংবাদিক
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে
ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.