দুর্যোগ-বন্যা সতর্কীকরণের আধুনিকায়ন কত দূর? by মমিনুল ইসলাম মঞ্জু

পানির উচ্চতা ডেঞ্জার লেভেল পার না হলে বন্যা বলে স্বীকার করেন না পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে বন্যা সতর্কবার্তা মানুষের কাজে আসে না সমতলে অবস্থিত বাংলাদেশে বন্যা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এবারও শোনা যাচ্ছে বন্যার পদধ্বনি। কিন্তু বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা রয়ে গেছে মান্ধাতা আমলেই।
বাস্তবতা এ রকম, ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে ওয়াটার লেভেল মাপার জন্য ওয়াটার গেজ স্কেল (পানির সমতল মাপকাঠি) বসানো হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। সে সময়কার সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা এবং নদীর রিডিউস লেভেল ধরে ডেঞ্জার লেভেল (বিপদসীমা) নির্ধারণ করা হয় ২৭ দশমিক ৮৯ মিটার।
এখন আর ওয়াটার গেজ স্কেলটি নুনখাওয়ায় নেই। এক যুগেরও আগে এ স্কেলটি প্রায় ৪ কিলোমিটার ভাটিতে সরিয়ে এনে যাত্রাপুর বাজারের পাশে দুধকুমার নদীর একটি চ্যানেলে বসানো হয়েছে। এখানকার পানি বাড়া-কমার তথ্য নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানিবিজ্ঞান বিভাগ ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়া পয়েন্টের হিসাব এখনও দিয়ে যাচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র তা প্রচারও করছে নিয়মিতভাবে।
ইতিপূর্বে এখানে বন্যার সময় চারদিক পানিতে ছয়লাব হলেও পানির উচ্চতা কখনও ডেঞ্জার লেভেল পার হয়নি। এ কারণে সরকারি নথিপত্রে এ অববাহিকায় বন্যা হওয়ায় কোনো রেকর্ড নেই। কেননা পানির উচ্চতা ডেঞ্জার লেভেল পার না হলে বন্যা বলে স্বীকার করেন না পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে বন্যা বলতে যা বোঝায় তার পূর্বাভাস এবং সতর্কবার্তা এখানকার মানুষের কাজে আসে না। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে না। শুধু এ পয়েন্টই নয়, দেশের নদ-নদীগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো ওয়াটার গেজ ও ডেঞ্জার লেভেল নিয়ে কমবেশি একই ধরনের অসঙ্গতি বিরাজ করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নথিপত্রে বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে ১৫০টি নদীর পানির উচ্চতা ৩৪৯টি স্টেশনের মাধ্যমে মাপা হয়। নদ-নদীগুলোর ওয়াটার ডিসচার্জ মাপা হয় ১১১টি স্টেশনের মাধ্যমে। এগুলোর মধ্যে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর ৮৬টি মনিটরিং স্টেশনের পানি বাড়া-কমার তথ্য সংগ্রহ করে এবং ৫২টির তথ্য প্রচার করছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে নদ-নদীগুলোর পানির উচ্চতা মাপার জন্য রয়েছে ওয়াটার গেজ স্কেল। দেশের প্রথম ওয়াটার গেজ স্কেল বসানো হয়েছিল ১৮৮৭ সালে গঙ্গা নদীতে রাজশাহীর বোয়ালিয়ার রামপুরে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় বসানো হয় ১৯১০ সালে। সারদায় ১৯২৬, তালবাড়িয়ায় ১৯৬০, সেনগ্রামে ১৯৬২ এবং গোলাপনগরে ১৯৬৩ সালে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার নুনখাওয়া, চিলমারী ও কুমারগঞ্জে ১৯৫৭, সিরাজগঞ্জে ১৯৩০, কাজীপুরে ১৯৬৩ এবং মথুরায় ১৯৬৫ সালে। এভাবে ১৮৮৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সময়ে তিস্তার উত্তর খড়িবাড়ী, ডালিয়া, গাড্ডিমারী, কালীগঞ্জ ও কাউনিয়ায় এবং ধরলার পাটগ্রাম, তালুক শিমুলবাড়ী ও কুড়িগ্রাম ধরলা ফেরিঘাটসহ করতোয়া, বাঙ্গালী, বড়াল, বুড়ি খোকা চিকি, ডাহুক, যমুনা, কাটাখালী, মহানন্দা, সুরমা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, পুনর্ভবা প্রভৃতি নদ-নদীতে ওয়াটার গেজ স্কেল বসানো হয়েছে। সর্বশেষ ওয়াটার গেজ বসানো হয় ১৯৭৩ সালে পাবনার আটঘরিয়া এলাকায় বড়াল নদীতে।
এ ছাড়া ১৯৯০-৯৫ সালের মধ্যে জাইকার সহায়তায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও দুধকুমারসহ ৩০টি পয়েন্টে ২ ধরনের টেলি মিটারিং অটোগেজ বসানো হয়েছিল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির পরিমাপ রেকর্ডের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বেজ স্টেশনে পাঠানো যেত। এর মধ্যে ১৯টিই এখন অকেজো।
পাশাপাশি পানির উচ্চতার মাপ সংগ্রহ ও পাঠানোর জন্য ৭০টির মতো গুরুত্বপূর্ণ টেলি কমিউনিকেশন স্টেশন আছে। আগে ওয়্যারলেস সেট দিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হতো। এগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। গেজ রিডার (সমতলের মাপ পাঠক) প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৬টায় পাঁচবার পানির উচ্চতার রিডিং নেন। এর মধ্যে প্রতিদিন শুধু ভোর ৬টার রিডিং টেলি কমিউনিকেশন স্টেশনে পাঠান। অন্য রিডিংগুলো পাঠান পরদিন। ফলে সারাদিনের পানি বাড়া-কমার খবর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে থাকে না।
এসব সীমাবদ্ধতার কারণে যথাযথ সতর্কীকরণ মানুষ পাচ্ছে না। প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের বিকল্প নেই।

মমিনুল ইসলাম মঞ্জু : কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
সমকাল

No comments

Powered by Blogger.