লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের সমীকরণ by এম আবদুল হাফিজ
নির্বাচনী প্রচারাভিযানে প্রার্থী বারাক ওবামা স্বভাবতই ছিলেন সুউচ্চ নৈতিকতার সুউচ্চ বেদিতে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত হলে তিনি বহির্বিশ্বে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে ইতি টানবেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংঘাতগুলোর মধ্য থেকে ইরাকে তিনি চলমান যুদ্ধ গুটিয়ে নেবেন।
একটি 'যৌক্তিক যুদ্ধ' আখ্যায়িত করে আফগানিস্তান সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল, যুদ্ধের একটি সফল পরিণতির ভেতর দিয়ে তিনি সেখানে একটি গণতান্ত্রিক ফলাফলের উদ্ভব ঘটাবেন। জর্জ বুশের দানবসদৃশ লক্ষ্য বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন আঙ্গিক দেওয়া সম্পর্কে ওবামার প্রতিক্রিয়া ছিল কায়রো সফর, যেখানে তিনি আরব মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের এক নতুন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করার কথা বলেছিলেন। নির্বাচনী যুদ্ধে ভোটের মিনতির জন্য যা করা দরকার_ তার সবই তিনি করেছিলেন। তারও মধ্যে যেসব নৈতিক উপাদান থাকে ক্ষমতারোহণের পর রিয়েল পলিটিকের (ৎবধষ ঢ়ড়ষরঃরপশ) ধাক্কায় তার সামান্যই এখন রয়ে গেছে।
কিন্তু ওবামার প্রতিশ্রুতি এবং পারফরম্যান্সের দূরত্ব এত বেশি যে, তা রিয়েল পলিটিকের প্রত্যাশিত প্রতিকূল প্রভাবেরও অনেক বেশি। এত বেশি যে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া তছনছ। ওয়াশিংটনের ইসরায়েলি লবি এই প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আফগানিস্তানেও একটি সম্ভাব্য আপস-সমঝোতার ব্যাপারে ওবামা বারবার তার সমরনায়কদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছেন।
এখন ওবামার প্রতিশ্রুতিমালায় আরও ভাঙন ধরাতে লিবিয়া আরেক ডাইমেনশন, যা তার আগামী দিনের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রভাবান্বিত করবে। অথচ এখানে জাতীয় স্বার্থ বা ঘধঃরড়হধষ ওহঃবৎবংঃ-এর কোনো প্রতিবন্ধকতা তার জন্য নেই। নেই আল কায়দার কোনো বিবেচনা। শুধু লিবিয়ার জ্বালানি সম্পদ এবং সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের দাবিই ওবামাকে একটি ত্বরিত কর্মসম্পাদন ও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, একজন প্রতিশোধপরায়ণ গাদ্দাফি হয়তো পরাজিতপ্রায় বিদ্রোহীদের কঠিন শাস্তি দিতেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় আরও অনেক সহিংস শাসক আছেন, যারা তাদের বেসামরিক জনগণকে একই রকম কাঠিন্যের মুখোমুখি করেন। কিন্তু কই, তাদের নিয়ে তো ওবামার উদ্বেগ নেই।
ঘটনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ওবামার লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। দুটি দেশেরই শাসনভার এখন এমন নেতৃত্বের হাতে ন্যস্ত, যাদের জন্য অতীত দিনের সাম্রাজ্যবাদী স্বর্ণযুগ এক প্রকার নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে_ যদিও ওবামার আমেরিকার জন্য এমন কোনো নস্টালজিয়ার সৃষ্টি হয় না। প্রেসিডেন্ট সারকোজির ফ্রান্সকে পশ্চিমা শক্তিপুঞ্জের শীর্ষে আনার প্রচেষ্টা অন্তত ইউরোপে শুধু স্বপ্নই, যা কখনও বাস্তবে ঘটবে না। তারই এক পূর্বসূরি সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উৎকণ্ঠা ছিল তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বকে নিয়েছে। তার বিপরীতে সারকোজির ভূমধ্যসাগরীয় ইউরোপীয় অঞ্চলের স্বপ্ন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক উচ্চাভিলাষ লালন করে।
কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের সম্ভাবনা কতখানি? কেননা ইতিমধ্যে তার পুনর্নির্বাচনের আসা কিছু বাধাগ্রস্ত হবে যদি ফ্রান্সে জেনোফবিক (ীবহড়ঢ়যড়নরপ) ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফরাসি ডানপন্থিদের ভোটে একটি বিরাট ভাগ বসাতে পারে, যার সম্ভাবনা কম নয়। লিবিয়ায় যদি সরকার উৎখাতই হয়, তা কিন্তু ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই প্রবণতাকে পাল্টে দিতে পারে।
এছাড়াও ন্যাটো লিবিয়াকে বোমাবর্ষণে ক্ষতবিক্ষত করবে এবং দেশটিকে ১৯১১ সালের বা তারও আগের সামরিক অবস্থানে পাঠাবে। অতঃপর ফরাসি সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের জন্যও তো রাস্তা খুলে যাবে। লিবিয়ায় যে অনুগত সরকারের কথা ভাবছে ফরাসিরা তাদের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বেচবে সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স। ইতিমধ্যে ব্রিটেনও লিবিয়াকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিযোগিতায় থাকতে ঘঐঝ এবং শিক্ষাব্যবস্থার বিতর্কিত ব্যয় সংকোচনে লিপ্ত হয়েছে। অত্যন্ত নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থাকে এড়াতে ব্রিটেনের জন্য অনেক পথ খোলা নেই। সরকার উৎখাত তো কোনো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এর জন্য অনেক অর্থ ছড়াতে-ছিটাতে হয়।
ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের একটি উগ্রবাদী চক্র যারা নব্য সাম্রাজ্যবাদের চর্চা করে তাদের মধ্যেও ডেভিড ক্যামেরন নেহাতই আনাড়ি। ক্যামেরন হয়তো আশা করে আছেন, সারকোজির সঙ্গে লিবিয়ার রেজিম চেঞ্জের বা বিভক্ত লিবিয়া থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে লব্ধ অর্থ দু'হাতে তারা লুটবেন। কিন্তু এর সবকিছু নির্ভর করবে তাদের হিসাব-নিকাশ পরিকল্পনামাফিক হবে কি-না। বিদ্রোহীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বিমান সমর্থন ছাড়াও যথেষ্ট অস্ত্রের সরবরাহ পাচ্ছে। এদিকে গাদ্দাফি সমর্থকরাও অস্ত্র প্রাপ্তিতে খুব পিছিয়ে নেই। এতে করে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের সম্ভাবনা। সংঘর্ষ দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানবিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বর্গীয় জ্যোতি বা নির্যাস ততদিন স্থায়ী হবে না এবং তা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যেসব আরব দেশও বিদেশি হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছে তারাও বুঝতে পারবে, পুরো এপিসোডটিই সাম্রাজ্যবাদীদের একটি লুণ্ঠনমূলক পরিকল্পনা ও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কাছে সহজে অর্জন করার মতো সুযোগ-শিকার। কথিত আরব উত্থানের বসন্ত ইতিমধ্যেই তার কিছু সরলতা হারিয়েও ফেলেছে। এখন তা সামরিক হস্তক্ষেপের পুনর্জন্মের ধাত্রীতে দ্রুত রূপান্তরিত হতে চলেছে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও
কলাম লেখক
কিন্তু ওবামার প্রতিশ্রুতি এবং পারফরম্যান্সের দূরত্ব এত বেশি যে, তা রিয়েল পলিটিকের প্রত্যাশিত প্রতিকূল প্রভাবেরও অনেক বেশি। এত বেশি যে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া তছনছ। ওয়াশিংটনের ইসরায়েলি লবি এই প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আফগানিস্তানেও একটি সম্ভাব্য আপস-সমঝোতার ব্যাপারে ওবামা বারবার তার সমরনায়কদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছেন।
এখন ওবামার প্রতিশ্রুতিমালায় আরও ভাঙন ধরাতে লিবিয়া আরেক ডাইমেনশন, যা তার আগামী দিনের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রভাবান্বিত করবে। অথচ এখানে জাতীয় স্বার্থ বা ঘধঃরড়হধষ ওহঃবৎবংঃ-এর কোনো প্রতিবন্ধকতা তার জন্য নেই। নেই আল কায়দার কোনো বিবেচনা। শুধু লিবিয়ার জ্বালানি সম্পদ এবং সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের দাবিই ওবামাকে একটি ত্বরিত কর্মসম্পাদন ও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, একজন প্রতিশোধপরায়ণ গাদ্দাফি হয়তো পরাজিতপ্রায় বিদ্রোহীদের কঠিন শাস্তি দিতেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় আরও অনেক সহিংস শাসক আছেন, যারা তাদের বেসামরিক জনগণকে একই রকম কাঠিন্যের মুখোমুখি করেন। কিন্তু কই, তাদের নিয়ে তো ওবামার উদ্বেগ নেই।
ঘটনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ওবামার লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। দুটি দেশেরই শাসনভার এখন এমন নেতৃত্বের হাতে ন্যস্ত, যাদের জন্য অতীত দিনের সাম্রাজ্যবাদী স্বর্ণযুগ এক প্রকার নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে_ যদিও ওবামার আমেরিকার জন্য এমন কোনো নস্টালজিয়ার সৃষ্টি হয় না। প্রেসিডেন্ট সারকোজির ফ্রান্সকে পশ্চিমা শক্তিপুঞ্জের শীর্ষে আনার প্রচেষ্টা অন্তত ইউরোপে শুধু স্বপ্নই, যা কখনও বাস্তবে ঘটবে না। তারই এক পূর্বসূরি সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উৎকণ্ঠা ছিল তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বকে নিয়েছে। তার বিপরীতে সারকোজির ভূমধ্যসাগরীয় ইউরোপীয় অঞ্চলের স্বপ্ন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক উচ্চাভিলাষ লালন করে।
কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের সম্ভাবনা কতখানি? কেননা ইতিমধ্যে তার পুনর্নির্বাচনের আসা কিছু বাধাগ্রস্ত হবে যদি ফ্রান্সে জেনোফবিক (ীবহড়ঢ়যড়নরপ) ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফরাসি ডানপন্থিদের ভোটে একটি বিরাট ভাগ বসাতে পারে, যার সম্ভাবনা কম নয়। লিবিয়ায় যদি সরকার উৎখাতই হয়, তা কিন্তু ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই প্রবণতাকে পাল্টে দিতে পারে।
এছাড়াও ন্যাটো লিবিয়াকে বোমাবর্ষণে ক্ষতবিক্ষত করবে এবং দেশটিকে ১৯১১ সালের বা তারও আগের সামরিক অবস্থানে পাঠাবে। অতঃপর ফরাসি সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের জন্যও তো রাস্তা খুলে যাবে। লিবিয়ায় যে অনুগত সরকারের কথা ভাবছে ফরাসিরা তাদের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বেচবে সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স। ইতিমধ্যে ব্রিটেনও লিবিয়াকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিযোগিতায় থাকতে ঘঐঝ এবং শিক্ষাব্যবস্থার বিতর্কিত ব্যয় সংকোচনে লিপ্ত হয়েছে। অত্যন্ত নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থাকে এড়াতে ব্রিটেনের জন্য অনেক পথ খোলা নেই। সরকার উৎখাত তো কোনো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এর জন্য অনেক অর্থ ছড়াতে-ছিটাতে হয়।
ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের একটি উগ্রবাদী চক্র যারা নব্য সাম্রাজ্যবাদের চর্চা করে তাদের মধ্যেও ডেভিড ক্যামেরন নেহাতই আনাড়ি। ক্যামেরন হয়তো আশা করে আছেন, সারকোজির সঙ্গে লিবিয়ার রেজিম চেঞ্জের বা বিভক্ত লিবিয়া থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে লব্ধ অর্থ দু'হাতে তারা লুটবেন। কিন্তু এর সবকিছু নির্ভর করবে তাদের হিসাব-নিকাশ পরিকল্পনামাফিক হবে কি-না। বিদ্রোহীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বিমান সমর্থন ছাড়াও যথেষ্ট অস্ত্রের সরবরাহ পাচ্ছে। এদিকে গাদ্দাফি সমর্থকরাও অস্ত্র প্রাপ্তিতে খুব পিছিয়ে নেই। এতে করে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের সম্ভাবনা। সংঘর্ষ দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানবিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বর্গীয় জ্যোতি বা নির্যাস ততদিন স্থায়ী হবে না এবং তা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যেসব আরব দেশও বিদেশি হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছে তারাও বুঝতে পারবে, পুরো এপিসোডটিই সাম্রাজ্যবাদীদের একটি লুণ্ঠনমূলক পরিকল্পনা ও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কাছে সহজে অর্জন করার মতো সুযোগ-শিকার। কথিত আরব উত্থানের বসন্ত ইতিমধ্যেই তার কিছু সরলতা হারিয়েও ফেলেছে। এখন তা সামরিক হস্তক্ষেপের পুনর্জন্মের ধাত্রীতে দ্রুত রূপান্তরিত হতে চলেছে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও
কলাম লেখক
No comments