চরাচর-ঈসা খাঁর এগারসিন্ধুর দুর্গ by সাইফুল ইসলাম খান
সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকেই রাজ্য শাসন, বিশেষ করে অন্য রাজা বা জমিদারদের বহিরাক্রমণ প্রতিরোধের জন্য রাজা বা জমিদাররা দুর্গ গড়ে তুলতেন। সাধারণত রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসব দুর্গ গড়ে তোলা হতো। তখনকার দুর্গগুলো মূলত এখনকার ক্যান্টনমেন্টের মতো কাজ করত।
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্ধুর এমনই একটি দুর্গ। বাংলার বারো ভূঁইয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ঈসা খাঁর দুর্গ এটা। বাংলার ভাটি রাজা হিসেবে খ্যাত দুর্ধর্ষ ঈসা খাঁর অনেক দুর্গের অন্যতম ছিল এগারসিন্ধুর দুর্গ। বারো ভূঁইয়ার মধ্যে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য ও সাহসিকতায় ঈসা খাঁ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈসা খাঁর দাদার নাম কালীদাস গজদানী, আর বাবা সুলাইমান। অন্য জমিদার কর্তৃক তাঁর বাবা নিহত হলে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ঈসা খাঁ যৌবনপ্রাপ্ত হন এবং বাবার হারানো জমিদারি পুনরুদ্ধার করেন। ১৫৭৬ সালে মোগল সম্রাট আকবরের আনুগত্য অস্বীকার করে তিনি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং ঢাকা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার অংশবিশেষ ছিল তাঁর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। ঈসা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। কিন্তু মোগল সম্রাট আকবরের সৈন্যবাহিনী যাতে তাঁর রাজ্যে ঢুকতে না পারে, সে জন্য তিনি তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্গ গড়ে তোলেন। দুর্গগুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জের এগারসিন্ধুর দুর্গটি বিভিন্ন কারণে প্রসিদ্ধ। মোগল সম্রাট আকবরের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তিনি এগারসিন্ধুর দুর্গটি গড়ে তোলেন। রাজধানীর বাইরে এটা ছিল তাঁর সবচেয়ে সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য দুর্গর্র্। মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে এখানেই ঈসা খাঁর মুখোমুখি তরবারিযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সেনাপতি মানসিংহ পরাজিত হন। এগারসিন্ধুর দুর্গের দালান-কোঠার অনেকটা ধ্বংস হয়ে গেলেও এখানে দুটি পুরনো মসজিদ এখনো টিকে আছে। এর মধ্যে একটি মসজিদের নাম সাদী মসজিদ। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে, ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে, নির্মিত হয় এটি। চারটি আট কোনাকার মিনারযুক্ত বিরাট গম্বুজওয়ালা এই মসজিদটি বর্গাকার। এরপর ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে শাহ মোহাম্মদের মসজিদ নামে আরো অধিকতর সুন্দর আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদের তোরণ ছিল চমৎকার পাকা দোচালা ঘর। মসজিদের ঠিক পূর্ব পাশে দুর্গের অংশবিশেষ এখনো আছে। পোড়ামাটির ইট-বালি-সুরকি দিয়ে নির্মিত এই দুর্গাবশেষ এখনো ঈসা খাঁর শক্তি ও প্রতাপ স্মরণ করিয়ে দেয়। সময় চলে তার নিজ গতিতে। কিন্তু এগারসিন্ধুর দুর্গের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, এই এখানেই বাংলার শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানদের একজন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে। মানসিংহের মতো সেনাপতিকে পরাজিত করেছিলেন এই স্থানে। বারো ভূঁইয়ার মধ্যে ঈসা খাঁ ছিলেন সবচেয়ে তেজস্বী, সাহসী ও প্রতাপশালী। বলিষ্ঠ শারীরিক গঠনের কারণে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা। এগারসিন্ধুর দুর্গে মুখোমুখি যুদ্ধে মানসিংহের পরাজয় ঈসা খাঁর বীরত্বের পরিচয় বহন করে। বীর ঈসা খাঁ ছিলেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর বীরত্বের স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত এগারসিন্ধুর দুর্গ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালির বীরত্ব ও স্বাধীন চেতনার কথা।
সাইফুল ইসলাম খান
সাইফুল ইসলাম খান
No comments