বিশেষ সাক্ষাৎকার-দেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের খপ্পরে চলে যায় by কে এম সফিউল্লাহ
পঁচাত্তরের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর। সেনাবাহিনীতে পর পর যে দুটি অভ্যুত্থান ঘটে, তার ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় পরবর্তীকালে রাজনীতিতে। এখনো অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। ৭ নভেম্বর সামনে রেখে আমরা মুখোমুখি হই দুই সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের।
তাঁদের সাক্ষাৎকার দুটিতে সেই সময়ের ঘটনার কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো ৩ নভেম্বরের ঘটনা কি ১৫ আগস্টের প্রতিক্রিয়া ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখলের জন্য তিনি কতিপয় জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেছেন। এ ঘটনায় সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা ছিল না। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীর বেইস অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। সবার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল। সেই উদ্বেগ থেকেই সম্ভবত তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় আমি আর সেনাপ্রধানের পদে ছিলাম না। ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করে সেনাপ্রধানের বাসভবনেই অন্তরীণ রাখা হয়।
প্রথম আলো তাঁর পদক্ষেপ সফল না হওয়ার কারণ কী ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ অনেকেই বলেন, সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের সমর্থন ছিল না। এই প্রচারণা সত্য নয়। আমার ধারণা, অভ্যুত্থানের পর নিজের হাতে তাঁর ক্ষমতা নেওয়া উচিত ছিল। তিনি সেটি নেননি। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করছিলেন। ফলে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পায়। খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে সেনানিবাসের ভেতরে রাখা ঠিক হয়নি। সেনানিবাসের বাইরে থাকলে ৭ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবীরা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পেতেন না।
জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে শাফায়েত জামিল, কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদা, কর্নেল নুরুজ্জামান প্রমুখের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল এবং তিনি তাঁদের কাজেও লাগিয়েছেন। খালেদকে আরও দ্রুতগতিতে সবকিছু করা উচিত ছিল।
প্রথম আলো ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কারা অবস্থান নিচ্ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ প্রতিবিপ্লবী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারা চেয়েছিল জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে। এ কারণেই জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এই অপশক্তিই সেনানিবাসের ভেতরে-বাইরে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালায়। কিন্তু তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বাইরের কারও প্ররোচনায় অভ্যুত্থান ঘটাননি। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের ভূমিকা কী ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে, এটা ঠিক। তাঁরা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাহেরের অনুসারীরা প্রচলিত সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী ধারায় একটি বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরাও জিয়াকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। জিয়া শেষ পর্যন্ত তাদের ফাঁদেই পা দিলেন। জিয়াউর রহমানের পরবর্তী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম দেখলেই এটা স্পষ্ট। নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করতেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ নিতেও দ্বিধা করেননি।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও জওয়ানদের সমর্থন ছিল বলে প্রচার করা হয়।
কে এম সফিউল্লাহ সেনাবাহিনী সব সময় চেইন অব কমান্ড মেনে চলে। অধস্তনেরা সব সময় ঊর্ধ্বতনদের আদেশ পালন করে থাকে। ৭ নভেম্বরও সে রকম ঘটনাই ঘটেছে। ঊর্ধ্বতনদের আদেশ না মানলে তাদের বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হয়। শাস্তি পেতে হয়। শাস্তির ভয়েও অনেকে বিরোধিতা করেনি। জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ ও ক্ষমতা সংহত করতেই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনাটি কখন জানতে পারেন?
কে এম সফিউল্লাহ ২৪ আগস্ট থেকেই আমি সেনাপ্রধানের বাড়িতে বন্দী। কিন্তু ৭ নভেম্বর একদল সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ান আমার বাড়িতে এসে বলল, ‘স্যার, আমাদের সঙ্গে চলেন।’ আমি তাদের বললাম, যখন একবার সামরিক পোশাক খুলেছি, তখন আর এই পোশাক পরব না। শুনেছি, সেই সময়ে জওয়ানরা অনেক সেনা কর্মকর্তাকে হেনস্তা করেছে। ওই দিন স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ষা নাই’। ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদার ভাইদের ওপরে র্যাংক নাই।’ অফিসারদের বাড়িতে হামলা বা হত্যা সম্পর্কে সেদিন কিছু জানতে পারিনি। পরে শুনেছি, একদল জওয়ান উসকানিমূলক স্লোগান দিয়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওরা হত্যা করেছে। দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে আরও রক্তপাত ও প্রাণহানি হোক, তা চাইনি বলেই আমি ওদের ডাকে সাড়া দিইনি।
প্রথম আলো আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্তি পেলেন কখন?
কে এম সফিউল্লাহ ১৫ আগস্টের পরই খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকে বললেন, দেশের জন্য তো আপনি তো অনেক কিছু করেছেন। এবার দেশের বাইরে আপনার সেবা চাই। আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই আপনার বাইরে যাওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি তাঁর কথায় রাজি হইনি। এরপর জেনারেল ওসমানীও বললেন, ‘তুমি সরকারের প্রস্তাব নাকচ করো না। তাতে তোমার ক্ষতি হবে।’ ওসমানী ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি বারবার আমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিই।
প্রথম আলো পরবর্তী রাজনীতিতে ৭ নভেম্বরের ঘটনা কী রকম প্রভাব ফেলেছিল? সেই প্রভাব কি ইতিবাচক ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ ৭ নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থান আমাদের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা
করা হয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাঁরা বেঁচে থাকলে দেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের খপ্পরে পড়ত না।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো ৩ নভেম্বরের ঘটনা কি ১৫ আগস্টের প্রতিক্রিয়া ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখলের জন্য তিনি কতিপয় জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেছেন। এ ঘটনায় সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা ছিল না। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীর বেইস অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। সবার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল। সেই উদ্বেগ থেকেই সম্ভবত তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় আমি আর সেনাপ্রধানের পদে ছিলাম না। ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করে সেনাপ্রধানের বাসভবনেই অন্তরীণ রাখা হয়।
প্রথম আলো তাঁর পদক্ষেপ সফল না হওয়ার কারণ কী ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ অনেকেই বলেন, সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের সমর্থন ছিল না। এই প্রচারণা সত্য নয়। আমার ধারণা, অভ্যুত্থানের পর নিজের হাতে তাঁর ক্ষমতা নেওয়া উচিত ছিল। তিনি সেটি নেননি। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করছিলেন। ফলে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পায়। খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে সেনানিবাসের ভেতরে রাখা ঠিক হয়নি। সেনানিবাসের বাইরে থাকলে ৭ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবীরা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পেতেন না।
জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে শাফায়েত জামিল, কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদা, কর্নেল নুরুজ্জামান প্রমুখের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল এবং তিনি তাঁদের কাজেও লাগিয়েছেন। খালেদকে আরও দ্রুতগতিতে সবকিছু করা উচিত ছিল।
প্রথম আলো ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কারা অবস্থান নিচ্ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ প্রতিবিপ্লবী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারা চেয়েছিল জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে। এ কারণেই জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এই অপশক্তিই সেনানিবাসের ভেতরে-বাইরে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালায়। কিন্তু তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বাইরের কারও প্ররোচনায় অভ্যুত্থান ঘটাননি। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের ভূমিকা কী ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে, এটা ঠিক। তাঁরা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাহেরের অনুসারীরা প্রচলিত সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী ধারায় একটি বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরাও জিয়াকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। জিয়া শেষ পর্যন্ত তাদের ফাঁদেই পা দিলেন। জিয়াউর রহমানের পরবর্তী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম দেখলেই এটা স্পষ্ট। নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করতেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ নিতেও দ্বিধা করেননি।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও জওয়ানদের সমর্থন ছিল বলে প্রচার করা হয়।
কে এম সফিউল্লাহ সেনাবাহিনী সব সময় চেইন অব কমান্ড মেনে চলে। অধস্তনেরা সব সময় ঊর্ধ্বতনদের আদেশ পালন করে থাকে। ৭ নভেম্বরও সে রকম ঘটনাই ঘটেছে। ঊর্ধ্বতনদের আদেশ না মানলে তাদের বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হয়। শাস্তি পেতে হয়। শাস্তির ভয়েও অনেকে বিরোধিতা করেনি। জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ ও ক্ষমতা সংহত করতেই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনাটি কখন জানতে পারেন?
কে এম সফিউল্লাহ ২৪ আগস্ট থেকেই আমি সেনাপ্রধানের বাড়িতে বন্দী। কিন্তু ৭ নভেম্বর একদল সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ান আমার বাড়িতে এসে বলল, ‘স্যার, আমাদের সঙ্গে চলেন।’ আমি তাদের বললাম, যখন একবার সামরিক পোশাক খুলেছি, তখন আর এই পোশাক পরব না। শুনেছি, সেই সময়ে জওয়ানরা অনেক সেনা কর্মকর্তাকে হেনস্তা করেছে। ওই দিন স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ষা নাই’। ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদার ভাইদের ওপরে র্যাংক নাই।’ অফিসারদের বাড়িতে হামলা বা হত্যা সম্পর্কে সেদিন কিছু জানতে পারিনি। পরে শুনেছি, একদল জওয়ান উসকানিমূলক স্লোগান দিয়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওরা হত্যা করেছে। দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে আরও রক্তপাত ও প্রাণহানি হোক, তা চাইনি বলেই আমি ওদের ডাকে সাড়া দিইনি।
প্রথম আলো আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্তি পেলেন কখন?
কে এম সফিউল্লাহ ১৫ আগস্টের পরই খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকে বললেন, দেশের জন্য তো আপনি তো অনেক কিছু করেছেন। এবার দেশের বাইরে আপনার সেবা চাই। আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই আপনার বাইরে যাওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি তাঁর কথায় রাজি হইনি। এরপর জেনারেল ওসমানীও বললেন, ‘তুমি সরকারের প্রস্তাব নাকচ করো না। তাতে তোমার ক্ষতি হবে।’ ওসমানী ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি বারবার আমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিই।
প্রথম আলো পরবর্তী রাজনীতিতে ৭ নভেম্বরের ঘটনা কী রকম প্রভাব ফেলেছিল? সেই প্রভাব কি ইতিবাচক ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ ৭ নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থান আমাদের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা
করা হয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাঁরা বেঁচে থাকলে দেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের খপ্পরে পড়ত না।
No comments