গোধূলির ছায়াপথে-প্রথম আলোর যুগপূর্তি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
মনে করার চেষ্টা করছি, যখন আমি বারো বছরের কিশোর। আট থেকে বারোর দিনগুলো যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। পেছনের দিকে তাকানোর নেই অবকাশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে এক দেশ থেকে আরেক দেশ। এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল। পরিবর্তনের দোলাচলে। সঙ্গে কিছুই নেই স্মৃতি ছাড়া।
বলরামপুর গ্রামের কালজানি নদীর তীরে, বাঁশবনের আড়ালে শনশন বাতাসের গুঞ্জরণে জীবনের প্রথম প্রবাহ, পুকুরের শীতল পানিতে বড়শি দিয়ে মাছের অন্বেষণে স্বপ্নগুলোকে পেছনে ফেলে এলাম। নতুন পরিবেশে আম, জাম, কাঁঠালের পাতাকে ঘিরে আবার তার অন্বেষণ।
প্রথম আলোর যুগপূর্তির প্রথম দিন থেকে পাঠক, বিগত চার বছর লেখক, কলামিস্ট ছয় মাস। প্রশ্ন, প্রথম আলোয় কেন? মুহাম্মদের নাম [সা.] পড়েছেন যাঁরা, উত্তর পেয়ে গেছেন। ১৪ বছর আগে বইটি লিখি আমেরিকার শিকাগো শহরে বসে। প্রথম পরিচ্ছেদ: ‘প্রথম আলো’, যা আমার কাছে সূর্যালোকেরও বেশি, অন্তরে ঐশী আলোর বিচ্ছুরণ। উত্তরটি রবিঠাকুরের চার-পাঁচটি গানের কলির সঙ্গে পঠনীয়।
পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা, অক্ষরে অক্ষরে সত্য। একাধিক খবরের কাগজ ক্রয় ব্যয়সাপেক্ষ। মহার্ঘ আটটি মুদ্রা কবুল করবেন শুধু সমঝদার। কাগজটি কেনার জন্য কেউ চাপ দিচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে গিন্নি ও কর্তার মধ্যে কিছু বচসা। অপছন্দ অপর দিকে ধাবিত হওয়ার সুযোগ বর্তমান, দেশে কাগজের আকাল পড়েনি। দুই দিন পরেই উনি চালান তাঁর কাছে, সকালে উঠেই যাঁর চিৎকার: ‘কাগজ আছে, কাগজ’। ওনার ক্ষুধা পুরোনো কাগজটি, যেটির ব্যবহার চলবে ঠোঙা হিসেবে।
কাগজে যা লিখিত, সেদিনের পর আর কে পড়বে? প্রতিদিন লিখছি মনের কথা, যার দাগ পড়ছে একটু করে পাঠকের মনে, সহজেই যা মুছে যাবে না। কারণ, দাগগুলো সত্যের, প্রগতির, আলোর। যাঁরা ভালো, আলোর সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁরা।
প্রথম আলোর কী ভালো? যুগপূর্তির বারোটি অধ্যায়, প্রতিদিন বেরোচ্ছে, সংগ্রহযোগ্য বলে আমার অভিমত। আজকের (২ নভেম্বর) কাগজে বেরিয়েছে এক যুগের একাদশতম নিবন্ধ, সুমনা শারমীন যেখানে লিখছেন: ‘একিউট স্ট্রোক সিনড্রোমে’ আক্রান্ত পাঁচ বছরের শিশু অনামিকার ‘আনন্দ-বেদনার কাব্য’। কোনো উপন্যাসের কোনো অধ্যায়ের চেয়ে তা আকর্ষণীয় ও বরণীয় নয়?
হারিয়ে গেলাম সেই খবরে, যেখানে মুন্সিগঞ্জের পদ্মা নদীতে ২০০ যাত্রী নিয়ে বিকল হয়ে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম ফোনটি আসে প্রথম আলোর বার্তা বিভাগে। কেন তাঁরা ফোন করেননি ফায়ার সার্ভিসে অথবা বিআইডব্লিউটিসিতে? উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশুটির কথা মনে পড়ল, যার কারণে আমার নাতি আলভি কয়েক দিন ভাত খেতে পারেনি। দুঃসহ দিনের ঘটনা, কী, কেন, কোথায়, কীভাবে, তার সঙ্গে ছিল মানবিক হূদয় নিংড়ানো আকুতি, যা শুধু চোখেই পানি আনে না, হূদয়কেও করে সমানুভূতিতে আচ্ছন্ন। একাত্মবোধ করি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৃক্ষপ্রেমিক কার্তিক পরামানিকের সঙ্গে, ভুলিনি, ‘বিশাল বিশাল বৃক্ষগুলো, যেন একেকটি কার্তিকনামা’।
ফ্ল্যাটের কার্নিশে যে দুঃখী হুতুম পেঁচা অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, আমি তাকে ভালো না বেসে পারি না। সুমনা শারমীন সেই পেঁচার দুঃখ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। প্রথম আলোর পাঠকেরা যে মানবিক পাঠক, বুঝতে পারি ই-মেইলের ডক্টর সেলিম আনসারীর পরিবার থেকে পাঠানো হয় বার্তাটি [১৬ মে, ২০০১, নারীমঞ্চে]। ...Our resources are small, but still we want to help her. We are all human beings, and we should at least give some respect to the humanity...
জীবনের ধন আসলে কী মাঝেমধ্যে ভাবি। কয়েকটি মুহূর্তের ছবি। ১ নভেম্বর ডোমারে আব্বাসউদ্দীন স্মৃতিবাসরে একজন ভক্ত ছোট্ট একটি পেপার কাটিং নিয়ে হাজির, বহু বছর আগে তরুণতর আমি কোথায় বক্তৃতা করছি, নিচে লেখা: গাছ ভালোবাসুন, গাছ আপনাকে সারা জীবন তারুণ্যের ডাক দেবে। লোকটির কাছে কাটিংটির মূল্য, ওটি তার কাছে ধন, কারণ সে গাছ ভালোবাসে। গাছকে মূল্য দিয়েছি বলে আমিও মূল্য পেলাম। বহুদিন আগের একটি মলিন কাটিং আমাকে অনেক কথা শিখিয়ে গেল।
১২ বছরের কিশোরটিই রয়ে গেলাম। মনের সুন্দর দিকটি ওই বয়সেই সুন্দর। তাকে বাড়তে না দিলেই ভালো। সূর্যের প্রথম আলোর বর্ণচ্ছটা সারা দিনের সবচেয়ে মূল্যবান আলোকরশ্মি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব। mabbasi@dhaka.net
প্রথম আলোর যুগপূর্তির প্রথম দিন থেকে পাঠক, বিগত চার বছর লেখক, কলামিস্ট ছয় মাস। প্রশ্ন, প্রথম আলোয় কেন? মুহাম্মদের নাম [সা.] পড়েছেন যাঁরা, উত্তর পেয়ে গেছেন। ১৪ বছর আগে বইটি লিখি আমেরিকার শিকাগো শহরে বসে। প্রথম পরিচ্ছেদ: ‘প্রথম আলো’, যা আমার কাছে সূর্যালোকেরও বেশি, অন্তরে ঐশী আলোর বিচ্ছুরণ। উত্তরটি রবিঠাকুরের চার-পাঁচটি গানের কলির সঙ্গে পঠনীয়।
পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা, অক্ষরে অক্ষরে সত্য। একাধিক খবরের কাগজ ক্রয় ব্যয়সাপেক্ষ। মহার্ঘ আটটি মুদ্রা কবুল করবেন শুধু সমঝদার। কাগজটি কেনার জন্য কেউ চাপ দিচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে গিন্নি ও কর্তার মধ্যে কিছু বচসা। অপছন্দ অপর দিকে ধাবিত হওয়ার সুযোগ বর্তমান, দেশে কাগজের আকাল পড়েনি। দুই দিন পরেই উনি চালান তাঁর কাছে, সকালে উঠেই যাঁর চিৎকার: ‘কাগজ আছে, কাগজ’। ওনার ক্ষুধা পুরোনো কাগজটি, যেটির ব্যবহার চলবে ঠোঙা হিসেবে।
কাগজে যা লিখিত, সেদিনের পর আর কে পড়বে? প্রতিদিন লিখছি মনের কথা, যার দাগ পড়ছে একটু করে পাঠকের মনে, সহজেই যা মুছে যাবে না। কারণ, দাগগুলো সত্যের, প্রগতির, আলোর। যাঁরা ভালো, আলোর সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁরা।
প্রথম আলোর কী ভালো? যুগপূর্তির বারোটি অধ্যায়, প্রতিদিন বেরোচ্ছে, সংগ্রহযোগ্য বলে আমার অভিমত। আজকের (২ নভেম্বর) কাগজে বেরিয়েছে এক যুগের একাদশতম নিবন্ধ, সুমনা শারমীন যেখানে লিখছেন: ‘একিউট স্ট্রোক সিনড্রোমে’ আক্রান্ত পাঁচ বছরের শিশু অনামিকার ‘আনন্দ-বেদনার কাব্য’। কোনো উপন্যাসের কোনো অধ্যায়ের চেয়ে তা আকর্ষণীয় ও বরণীয় নয়?
হারিয়ে গেলাম সেই খবরে, যেখানে মুন্সিগঞ্জের পদ্মা নদীতে ২০০ যাত্রী নিয়ে বিকল হয়ে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম ফোনটি আসে প্রথম আলোর বার্তা বিভাগে। কেন তাঁরা ফোন করেননি ফায়ার সার্ভিসে অথবা বিআইডব্লিউটিসিতে? উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশুটির কথা মনে পড়ল, যার কারণে আমার নাতি আলভি কয়েক দিন ভাত খেতে পারেনি। দুঃসহ দিনের ঘটনা, কী, কেন, কোথায়, কীভাবে, তার সঙ্গে ছিল মানবিক হূদয় নিংড়ানো আকুতি, যা শুধু চোখেই পানি আনে না, হূদয়কেও করে সমানুভূতিতে আচ্ছন্ন। একাত্মবোধ করি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৃক্ষপ্রেমিক কার্তিক পরামানিকের সঙ্গে, ভুলিনি, ‘বিশাল বিশাল বৃক্ষগুলো, যেন একেকটি কার্তিকনামা’।
ফ্ল্যাটের কার্নিশে যে দুঃখী হুতুম পেঁচা অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, আমি তাকে ভালো না বেসে পারি না। সুমনা শারমীন সেই পেঁচার দুঃখ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। প্রথম আলোর পাঠকেরা যে মানবিক পাঠক, বুঝতে পারি ই-মেইলের ডক্টর সেলিম আনসারীর পরিবার থেকে পাঠানো হয় বার্তাটি [১৬ মে, ২০০১, নারীমঞ্চে]। ...Our resources are small, but still we want to help her. We are all human beings, and we should at least give some respect to the humanity...
জীবনের ধন আসলে কী মাঝেমধ্যে ভাবি। কয়েকটি মুহূর্তের ছবি। ১ নভেম্বর ডোমারে আব্বাসউদ্দীন স্মৃতিবাসরে একজন ভক্ত ছোট্ট একটি পেপার কাটিং নিয়ে হাজির, বহু বছর আগে তরুণতর আমি কোথায় বক্তৃতা করছি, নিচে লেখা: গাছ ভালোবাসুন, গাছ আপনাকে সারা জীবন তারুণ্যের ডাক দেবে। লোকটির কাছে কাটিংটির মূল্য, ওটি তার কাছে ধন, কারণ সে গাছ ভালোবাসে। গাছকে মূল্য দিয়েছি বলে আমিও মূল্য পেলাম। বহুদিন আগের একটি মলিন কাটিং আমাকে অনেক কথা শিখিয়ে গেল।
১২ বছরের কিশোরটিই রয়ে গেলাম। মনের সুন্দর দিকটি ওই বয়সেই সুন্দর। তাকে বাড়তে না দিলেই ভালো। সূর্যের প্রথম আলোর বর্ণচ্ছটা সারা দিনের সবচেয়ে মূল্যবান আলোকরশ্মি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব। mabbasi@dhaka.net
No comments