শিক্ষা-মনার গ্যারেজ ও সাধারণ শিক্ষা by মোহীত উল আলম

একদিন মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডের পাশে একটি গ্যারেজে কিছুক্ষণের জন্য বসেছিলাম। আমার গাড়ির মেরামতের কাজ চলছিল। দোকানের মালিকের নাম মনা (মনোয়ার), ৩০-৩২ বছরের যুবক। তার সঙ্গের হেলপাররা ২০ থেকে নিচের দিকে। যে ছেলেটি আমাকে চা এনে খাওয়াল তার বয়স দশও হবে না।


মনার গ্যারেজটা ব্যস্ত, একসঙ্গে সাত-আটটা গাড়ির মেরামতের কাজ চলছে। পুরো অঞ্চলই গ্যারেজের দোকানে ভর্তি। আর প্রতিটা গ্যারেজে কাজ করছে এ রকম অল্প বয়স্ক ছেলেরা। মনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার দোকানে এত ছেলে সে পেল কোত্থেকে। সে সস্নেহে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ওরা সবাই তার ছোট ভাই। বললাম, ওরা স্কুলে যায় না? মনা বলল, ওরা স্কুলে যেতে চায় না।
আমি প্রথমে চিন্তা করলাম, এদের মতো ছেলেরা যত দিন শিক্ষাগ্রহণ করতে না পারবে, তত দিন বাংলাদেশে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে বলা যায় না। এদের কাছেও তো শিক্ষা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আবার চিন্তা করলাম, গাড়ি মেরামতের কাজে নিয়োজিত বালক এবং কিশোরদের যে শিক্ষা, এটা তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও পাবে তার তো উপায় নেই। কিন্তু তাদের এ শিক্ষাটাকে যদি শিক্ষা বলি, তা হলে এরা তো অশিক্ষিত নয়। বছরখানেক আগে বদরুদ্দীন উমরের একটি কলামে পড়েছিলাম যে তিনি যখন কৃষক রাজনীতি করছিলেন তখন তাঁকে এক কৃষক বলেছিলেন যে কৃষকদের অশিক্ষিত বলা ঠিক নয়। কারণ, ধান উত্পাদনের যে শিক্ষা তাদের আছে, সেটা বই-পড়া শিক্ষা না হলেও একটি শিক্ষা।
তখন মনে মনে একটা চিত্র আঁকলাম। ধরলাম যে এ ছেলেগুলো সব কারখানা ফেলে স্কুলে ভর্তি হলো। কিন্তু তাদের দারিদ্র্য তাদের নাম-কা-ওয়াস্তে কোনো স্কুলে পড়তে মাত্র সাহায্য করবে, যেখানে হয়তো তারা গুল্লি খেলবে কিংবা মারামারিতে জড়িয়ে পড়বে। কারণ নিম্নবিত্তেরা আমাদের সমাজে যেসব স্কুলে যেতে পারে সেসব স্কুলের পরিবেশ অতিশয় নোংরা ও শিক্ষাবিমুখ। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলেরগুলোর ভৌত সুবিধাদির মানও অতিশয় নিম্নমানের। স্কুলের পরিবেশ, সঙ্গে তাদের বাসার পরিবেশ, থাকার জায়গার পরিবেশ কিছুই তাদের পড়ালেখা শিখতে সাহায্য করবে না। পক্ষান্তরে তারা যে গাড়ি মেরামতের কাজ শিখে একদিন মিস্ত্রি হয়ে নিজের একটি কারখানা শুরু করত বা অন্যের কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত তাতেও পড়বে বাধা। যদি এ রকম হতো যে গাড়ি মেরামতের স্কুল বা টেকনিক্যাল স্কুলের ব্যাপক প্রসার হয়েছে এবং সেখানে এই ছেলেদের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে, তা হলে হয়তো তাদের জীবনকে অর্থময় করা যেত।
আবার এর বিপরীত চিত্রটা আঁকলাম। ধরি যে এদের জন্য পড়াশোনার কোনো ব্যবস্থা হলো না। তা হলে এরা গাড়ি মেরামতের কাজে শিক্ষিত হলেও সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রে থেকে যাবে অশিক্ষিত। অন্যান্য ক্ষেত্রে এদের নিরক্ষরতা বা শিক্ষার অভাবের সুযোগ নিয়ে অন্যরা তাদের শ্রমকে হরণ করে মুনাফা লুটবে। যেভাবে হাতি, ঘোড়া বা বলদের মালিক তাদের নিজ নিজ পশুকে খাটিয়ে রিক্তশক্তি করে তারপর ভাগাড়ে পাঠায়। শ্রমজীবীদের শ্রম শোষণের যে রীতির ওপর বিরাট মার্ক্সীয় তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে, তার কাঁচামাল হচ্ছে মনার কারখানায় কাজ করা এ শিশু-কিশোর শ্রমিকেরা, তথা বাংলাদেশের নিঃস্ব শ্রমিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। অর্থাত্ শোষিত শ্রমিকগোষ্ঠী পশুর মতো কায়িক শ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকে। সাধারণ শিক্ষার অভাবে এদের মধ্যে সহজাত বুদ্ধির বাইরে অর্জিত বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না। ফলে এরা তুলনামূলক বা বৈষম্যমূলক পর্যবেক্ষণসৃত বিচারবোধ তৈরি করতে পারে না। অপকারকারী এবং উপকারীর মধ্যে প্রভেদ বুঝতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, এরা যে শোষিত হচ্ছে সেটাও এরা বুঝতে পারে না। তদুপরি সাধারণ শিক্ষার অভাবে এরা সামাজিক অপতত্পরতার সহজ হাতিয়ার হয়। রাজনৈতিক অরাজকতা, ভাঙচুর, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ বা এ জাতীয় নাশকতামূলক কাজে যেমন এদের নিশ্চিত অংশগ্রহণ থাকে। অর্থাত্ সাধারণ লেখাপড়ায় অশিক্ষিত জনগণ সামাজিক অব্যবস্থাকে উদগ্র করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তা হলে এদের কাজের অভিজ্ঞতার দ্বারা যেটা ওরা অর্জন করছে, সেটা যেমন জরুরি একটা বাস্তব শিক্ষা, তেমনি এদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে ন্যায়-অন্যায় বোধ তৈরি হওয়াও প্রয়োজন। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সে রকম একটা নমনীয় ব্যবস্থা থাকা উচিত, যার ফলে শ্রমিক ও কারিগরেরা সাধারণ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়।
এ প্রসঙ্গে শিশুশ্রমের ওপর বিধিনিষেধের প্রশ্নটাও এসে যায়। বাংলাদেশে বহু আইন যেমন মানা হয় না, এটাও মানা হয় না। কিন্তু নির্মমতা হলো, যে ভদ্রঘরের শিশুসন্তান স্কুলে যাচ্ছে, তার ব্যাগ বহন করছে তারই বয়সী এক গরিব শিশু। এ দৃশ্য আমরা প্রতিনিয়ত দেখি এবং মেনে নিয়েছি। শিশুশ্রমের সঙ্গে দারিদ্র্য এবং শিক্ষার যোগাযোগ সরাসরি। তাই শিক্ষার কথা বলা মানে দারিদ্র্য লাঘবের কথা বলা, এবং প্রকারান্তরে শিশুশ্রমের বিলুপ্তির কথা বলা।
উপরিউক্ত কথার আলোকে শিক্ষার গুরুত্ব যে ব্যক্তিগত জীবন ও সমষ্টিগত জীবনে কী রকম প্রবল হতে পারে তার একটি প্রসঙ্গ এখানে টানব। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের কথা সবাই জানেন। প্রধান চরিত্র প্রসপেরো দ্বীপবাসী ক্যালিবানকে দাস হিসেবে রাখে এবং একপর্যায়ে তাকে ভাষা শেখায়। নাটকের এক দৃশ্যে যখন প্রসপেরোর বিরুদ্ধে ক্যালিবান তেতে ওঠে তখন সে বলে যে, ‘তোমার ভাষা শিখে আমার এ লাভ হয়েছে যে তোমার (প্রসপেরোর) ভাষায় আমি তোমাকে গালি দিতে পারছি।’ ভাষাটা তাই এখানে প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু এর প্রকৃষ্ট একটি প্রসঙ্গ পাই আমেরিকার প্রথম যুগের কৃষ্ণকায় লেখক ফ্রেডারিক ডগলাসের আত্মজীবনীতে।
দাস হিসেবেই জন্মেছিলেন ফ্রেডারিক ডগলাস (১৮১৮—১৮৯৫) আমেরিকার মেরিল্যান্ডে। তাঁর মা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গিনী, বাবা শ্বেতাঙ্গ হলেও অচিহ্নিত বা অপরিচিত ছিল। অকথিত নির্যাতনের জীবনযাপন করেছিলেন ডগলাস। কিন্তু ১৮৪৫ সালে তাঁর ১২৫ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী ন্যারেটিভ অব দ্য লাইফ অব ফ্রেডারিক ডগলাস: অ্যান অ্যামেরিকান স্লেইভ বের হলে সাড়া পড়ে যায়। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে ডগলাস বর্ণনা করছেন একটি চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। তখন তিনি বালক। তাঁর নতুন শ্বেতাঙ্গিনী মনিবা, মিসেস অউলড যার নাম, তার প্রতি মায়াবশত তাকে ভাষা (ইংরেজি) শেখাতে চাইলেন। তখন মিসেস অউলডের স্বামী তাকে বারণ করলেন এ বলে যে ‘তুমি যদি একজন নিগারকে এক ইঞ্চি সুবিধা দাও, তা হলে সে এক গজ চাইবে। শিক্ষা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিগ্রোকে পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলে। শিক্ষা তাকে সচেতন করে তুলবে এবং ফলে সে অসন্তুষ্ট (ডিসকন্টেন্ট) হতে থাকবে।’
আড়ি পেতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ কথোপকথন শুনে জীবনের পরম সত্যটি ডগলাস হূদয়ঙ্গম করেন যে যে-শক্তির বলে সাদারা কালোদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছে, সেটি হলো শিক্ষা। শিক্ষা হলো আলোর বাহন। এ আলোটাই সাদা মনিবেরা তাদের নিগ্রো ভৃত্যদের দিতে অস্বীকার করছিল। শেক্সপিয়ার বা ড্যানিয়েল ডিফো (রবিনসন ক্রুসোর লেখক) মনে করেছিলেন (যেহেতু তাঁরা শ্বেতাঙ্গ লেখক ছিলেন) সাদা মনিবেরা তাঁদের নেইটিভ ভৃত্যদের ভাষা এবং নীতিবোধ শিখিয়ে সভ্যতার স্পর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে আমেরিকার প্রেক্ষাপটে দেখছি, আসলে সাদা মনিবেরা ভাষার অধিকারটাই নিগ্রোদের দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনার পর ডগলাস লিখছেন তাঁর অনুভূতির কথা: ‘আমি তখন বুঝলাম, যা এত দিন আমি বুঝতে পারিনি, যে কী মূল শক্তিবলে শ্বেতাঙ্গরা কালো মানুষদের গোলাম করে রেখেছে। এটা একটা বিরাট অনুধাবন হলো আমার জন্য। আমি এটাকে খুব মূল্য দিলাম। ফ্রম দ্যাট মোমেন্ট আই আন্ডারস্টুড দ্য পাথওয়ে ফ্রম স্লেভারি টু ফ্রিডম (অর্থাত্, তখন থেকে আমি বুঝতে পারলাম, দাসত্ব থেকে স্বাধীনতার পথে রাস্তা কোনটা।’
তখন থেকে ডগলাস চুরি করে নানা উপায়ে ইংরেজি ভাষাটা শিখলেন এবং কালক্রমে নিজেকে স্বশিক্ষিত করলেন ও লেখক হয়ে গেলেন। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা মুক্তির সনদ হিসেবে কাজ করবে। ডগলাসের জীবনে যেমন তা করেছে (তিনি দাসত্ব থেকে পালিয়ে যান), আমাদের মনার গ্যারেজের ছেলেরা এবং এ রকম লাখ লাখ ছেলেমেয়ের জীবন যেন শিক্ষা মানবতার মুক্তির সনদ হয়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ‘এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা।’
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.