শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার দখলের রক্তাক্ত লড়াই
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে টেন্ডার দখলের রক্তাক্ত লড়াই চলিয়া আসিতেছে দীর্ঘদিন যাবত্। এই লড়াইয়ে অনেকেই হতাহত হইয়াছে। অকালে ঝরিয়া পড়িয়াছে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনির মতো সম্ভাবনাময় ও নিরপরাধ বহু তাজা প্রাণ। সর্বোপরি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হইয়াছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষা কার্যক্রম। টেন্ডারবাজি বা চাঁদাবাজির মতো অশুভ তত্পরতার সহিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা না থাকিলেও বরাবরই তাহাদেরকেই ইহার কুফল ভোগ করিতে হইয়াছে। সেই সাথে কালিমালিপ্ত হইয়াছে ছাত্র সমাজের ভাবমূর্তি। গত শনিবার গভীর রাত্রে ও রবিবার সকালে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজে সংঘটিত ঘটনাটিও ইহার ব্যতিক্রম নহে। সোমবারের ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইহার বিশদ বিবরণ তুলিয়া ধরা হইয়াছে। জানা যায়, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে ৩ জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হইয়াছে। আহত হইয়াছে আরও অন্তত ২৫ জন। লুটপাট চালানো হইয়াছে কলেজের ৪টি হলের ২০টি কক্ষে। শিক্ষার্থীদের সনদপত্র ও মূল্যবান কাগজপত্রে অগ্নিসংযোগের অভিযোগও উঠিয়াছে। সংঘর্ষে মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হইয়াছে। ব্যবহূত হইয়াছে আগ্নেয়াস্ত্র। রীতিমতো যুদ্ধই বটে! কিন্তু কিসের জন্য এই আত্মঘাতী যুদ্ধ? এই যুদ্ধের আপাত লক্ষ্য আধিপত্য বিস্তার হইলেও মূল লক্ষ্য যে লক্ষ লক্ষ টাকার টেন্ডার দখল তাহাও সবিস্তারে তুলিয়া ধরা হইয়াছে সংবাদপত্রে। স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত বাধিয়াছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও কিছু কিছু মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঘটিয়াছে। কিন্তু এখন যাহা ঘটিতেছে তাহার মূলে রহিয়াছে নিরেট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধি ও আধিপত্য বিস্তার। ইহার সহিত কোনো প্রকার নীতি-আদর্শের বিন্দুমাত্র সম্পর্কও খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, আমাদের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস খুবই গৌরবোজ্জ্বল। মহান ভাষা আন্দোলন হইতে মুক্তিযুদ্ধ অবধি স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাপথে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের অবদান বিস্মৃত হইবার নহে। তাই কিছুদিন আগেও ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির ক্রমবর্ধমান দাপট দেখিয়া অনেকে উদ্বিগ্ন হইতেন। ইহা লইয়া বিস্তর আলোচনা-সমালোচনাও হইত। কিন্তু এখন এই ব্যাপারে কেহই উচ্চবাচ্য করেন না। কারণ বিষয়টি গা সহা হইয়া গিয়াছে। ছাত্র রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হইয়া দাঁড়াইয়াছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। আর এই ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আশীর্বাদের বিষয়টিও কাহারও অবিদিত নহে। সর্বোপরি, ছাত্রদের টেন্ডার দখলের এই মরিয়া মনোভাবের পিছনে চরম দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তার ভূমিকাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুফল অনেক। ইহার কিছু কিছু সীমাবদ্ধতাও যে আছে তাহাও অনস্বীকার্যই বলা চলে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকাই মুখ্য। জনগণকে লইয়াই তাহাদের কারবার। জনসমর্থনই তাহাদের ক্ষমতার মূল ভিত্তি। এই জনসমর্থন ধরিয়া রাখিবার জন্য অনেক ক্ষেত্রে কর্মী-সমর্থকদের বহু অন্যায় আবদারও তাহাদের মানিয়া লইতে হয়। দিতে হয় নানা সুযোগ-সুবিধা। দলীয় নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা বন্টনের এই রেওয়াজ কমবেশি সকল গণতান্ত্রিক দেশেই লক্ষ্য করা যায়। তবে তাহারও একটি সীমারেখা আছে। সেই সীমা লঙ্ঘিত হইলেই বিপর্যয় দেখা দেয়। উন্নত দেশগুলি এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু উপর্যুপরি অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমাদের টনক নড়ে নাই। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে ছাত্র সংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী শক্তি হিসাবে বিবেচিত হইয়া আসিতেছে। আর এই সুযোগ বা দুর্বলতাকে কাজে লাগাইয়া বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে যাহা চলিতেছে তাহার লাগাম টানিয়া ধরা না গেলে ইহার পরিণাম যে কাহারো জন্য শুভ হইবে না তাহা সহজে অনুমেয়।
No comments