প্রাকৃতিক দুর্যোগ-হাইতির শিক্ষা by ফিদেল কাস্ত্রো

১২ জানুয়ারি কিউবায় তখন সন্ধ্যা ছয়টা। আর হাইতিতে ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। টেলিভিশনে প্রচার হলো এক প্রবল ভূমিকম্পের সংবাদ। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার সেই ভূমিকম্প প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সে। এই ভূকম্পনের উত্পত্তি রাজধানী থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে।


পোর্ট অ প্রিন্সের ৮০ শতাংশ মানুষ অস্থায়ী ও মাটির তৈরি নাজুক ঘরে বাস করে।
বিরতিহীন কয়েক ঘণ্টা ধরে ভূমিকম্পের সংবাদ প্রচার চলল। বহু দালানকোঠা, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় ধসে যাওয়ার সংবাদ নিশ্চিত করা হলো কিউবার টেলিভিশনে। বর্ণনায় উঠে এল মানুষের মর্মান্তিক অবস্থার ছবি। আহত ব্যক্তিরা রাস্তায় চিকিত্সা-সহায়তার জন্য আর্তনাদ করছিল; তাদের চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, সেই ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে তাদের স্বজনেরা।
এই সংবাদ আমাদের সবার জন্য ছিল আকস্মিক। হাইতিতে ঘন ঘন হারিকেন ও ভয়াবহ বন্যা হওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশ এমন বড় মাপের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে, তা আমাদের জানা ছিল না। এই শহরটিতে ২০০ বছর আগে এমনই এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটেছিল, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ তথ্যটি সামনে এল। তখন এখানে থাকত মাত্র কয়েক হাজার মানুষ।
মাঝরাতের সময়ও হতাহতের আনুমানিক সংখ্যার কোনো উল্লেখ দেখা যাচ্ছিল না। জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান হাইতির চলমান ঘটনাবলির বিষয়ে আলোচনা করেন এবং সাহায্যের জন্য জরুরি দল পাঠানোর ঘোষণা দেন। বিভিন্ন দেশের সেনাদের সমন্বয়ে জাতিসংঘ বাহিনী মিনাসটাহ (ইউনাইটেড নেশনস স্টেবিলাইজেশন মিশন ইন হাইতি) সেখানে মোতায়েন করা ছিল। তাই কয়েকটি দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা নিজ দেশের সেনা মারা গেছে কি না, সে বিষয়ে উত্কণ্ঠিত ছিলেন।
বুধবার সকালে বিপুলসংখ্যক মানুষের হতাহতের খবর আসতে শুরু করে। এমনকি জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান জানায়, হাইতিতে তাদের কয়েকটি দালান ধসে গেছে। এ কথা নিজে খুব বেশি কিছু অর্থ তৈরি করে না, কিন্তু এর হয়তো অনেক মানে হতে পারে।
টেলিভিশন কেন্দ্রগুলোতে নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল—নানা ভাষ্যে তা ৩০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত। বিধ্বংসী সব ছবি পাওয়া যাচ্ছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দুনিয়াব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। অনেক দেশের সরকার এই বিপর্যয়ে আন্তরিক সাড়া দিয়ে তাদের সম্পদ অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই শোকাবহ ঘটনা বহু মানুষকে সত্যিকারে আলোড়িত করেছে। কিন্তু তাদের স্বল্পসংখ্যকই হয়তো ভেবে দেখার অবসর পেয়েছে, কেন হাইতি এমন গরিব। কেন বিদেশে বসবাসরত সদস্যদের পাঠানো অর্থের ওপর সংসার চালানোর জন্য নির্ভর করে প্রায় অর্ধেকের মতো হাইতিবাসী?
হাইতিই প্রথম দেশ, যেখানে চার লাখ আফ্রিকাবাসীকে দাস হিসেবে পাচার করে ইউরোপীয়রা। তারা চিনি ও কফি চাষ বিষয়ে ৩০ হাজার শ্বেতাঙ্গ দাস মালিকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এভাবে তারা এই গোলার্ধের প্রথম বড় মাপের সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করে; অনতিক্রম্য গৌরবের কথা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা যেখানে লেখা আছে। এ বিষয়ে কেউ একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ, দেশটির মানবসম্পদকে ভয়ংকর সব কাজে এক শতাব্দীর বেশি সময় নিযুক্ত রাখা, সামরিক হস্তক্ষেপ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুট—এসবের সম্মিলনে আজকের হাইতি সৃষ্টি হয়েছে।
এই ঐতিহাসিক দৃষ্টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হতো না, যদি হাইতি আমাদের সময়ের লজ্জা না হতো। আর তা এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে পৃথিবীর বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শোষণ ও লুণ্ঠনের শিকার হয়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের একই ধরনের নানা ঘাটতি আছে, যদিও হয়তো তাদের অবস্থা হাইতির মতো এতটা খারাপ নয়।
হাইতির মতো পরিস্থিতি পৃথিবীর কোথাও হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এমনতর বা এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির শহর অনেক। অন্যায্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার কারণে এমন হয়েছে। বিশ্বের সামনে হাইতি শুধু ভূমিকম্পই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী ঘটতে পারে তারও এক মলিন প্রতিচ্ছবি।
যেসব রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান তাদের নাগরিক ও কর্মী হারিয়েছে, তাদের উদ্দেশে শুধু এতটুকুই বলব: এ ক্ষেত্রে জীবন বাঁচানো ও এসব দীর্ঘ পীড়িত মানুষের যন্ত্রণা দূর করতে সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালানো হবে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। হাইতির রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে আমরা একমত পোষণ না-ই করতে পারি, কিন্তু সেখানে ঘটা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আমার মনে হয় হাইতির জন্য এখন বাস্তবসম্মত ও স্থায়ী সমাধান খোঁজার সময় এসেছে। গরিব ও অবরুদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও কিউবা স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে হাইতির অধিবাসীদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৪০০ চিকিত্সক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিনা মূল্যে হাইতির জনগণকে সেবা দিচ্ছেন। আমাদের চিকিত্সকেরা দেশটির ৩৩৭টি কমিউনের মধ্যে ২২৭টিতে প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, হাইতির প্রায় ৪০০ তরুণ কিউবায় চিকিত্সাশাস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁরা এখন কিউবার নতুন পাঠানো চিকিত্সকদের সঙ্গে জীবন রক্ষায় কাজ করতে হাইতি গেছেন। এভাবে বিশেষ কোনো চেষ্টা ছাড়াই এক হাজার চিকিত্সক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে কাজে লাগানো সম্ভব।
গ্রানমা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।

No comments

Powered by Blogger.