দেখার ভেতরে বাইরেঃ ‘ভ্যান-ট্যান আইন' by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
এই ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে আমি যশোরে ছিলাম। যশোরের চৌরাস্তার মধুর রেস্তোরাঁর আড্ডা, সেই আমার ছাত্রজীবন থেকেই। এখনও আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজন বন্ধু নিয়মিত বসে। ফলে যশোর গেলেই—বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা-আড়াইটা পর্যন্ত ওখানে উপস্থিত থাকতে না পারলে—সেদিনটা যেন বিষণ্ন হয়ে যায়।
১২ তারিখ বিকেলে ঢাকায় রওনা হবো—তবু ১১টার আড্ডায় ঠিকই হাজির হলাম। আড্ডা জমে উঠেছে, এমন সময় একজন পরিচিত রিকশাভ্যান চালক বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় আমাদের সামনে এসে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা ভাইজান, ভ্যানট্যান আইনডা কী?’ আমরা সবাই হতবাক। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম—‘ভ্যানট্যান আইন? সেটা আবার কী? কোথায় শুনলে?’ সে তার দুশ্চিন্তা নিয়েই বললো, ‘এইতো সবাই কচ্ছে (বলছে) ১৪ তারিখে নাকি ভ্যানট্যান আইন দে (দিয়ে) কী করবে!’ ১৪ তারিখ শুনেই বুঝে ফেললাম, ভ্যালেন্টাইন ডে-কে সে ‘ভ্যানট্যান আইন দে’ বানিয়ে ফেলেছে। সবাই প্রায় একযোগে হো-হো করে হেসে ফেললাম। সে বিপন্ন মুখে বলে উঠলো,—‘হাসতেছেন ক্যান? গরিব মানুষ, ভ্যানট্যান চালায়ে খাই; কী আইন হয়েছে—সেই আইন দে কোনো অসুবিধা করবে কি না ...।’ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললাম—‘হু, অসুবিধা তো হতেই পারে। তোমার ভ্যানে তো আবার প্যাসেঞ্জার টানো।’ সে এবার অতি বিপন্ন হয়ে পড়ল। বললো, ‘তাতো টানি। তা, মানুষ উঠানো কি নিষেধ হয়ে যাবেনে?’ অন্য বন্ধুদের ইশারায় থামিয়ে বললাম, ‘শোন মোবাশ্বের, মানুষ উঠানো নিষেধ হবে না—তবে ওইদিন যে সে প্যাসেঞ্জার তুলতি পারবা না ভ্যানে। সব জোড়ায় জোড়ায় তুলতি হবে। সেই জোড়া আবার বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রী হলে হবে না।’ সে যেন একটু অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘কি কন, স্বামী-ইস্তিরি ছাড়া জুড়ায়-জুড়ায় প্যাসেঞ্জার কনে পাব?’ আমাদের চিরকুমার বন্ধু জীবন বোসকে দেখিয়ে বললাম, ‘এই যে তোমার জীবন দা,—ওকি বিয়ে করেছে?’ সে হেসে বললো, ‘তা আর কল্লেন (করলেন) কই?’ বললাম, ‘ব্যাস, তোমার জীবন দা’কে ধরো। ও যদি একটা অ-বিয়েতো মেয়েকে নিয়ে সারা দিন তোমার রিকশায় ঘোরে—তা হলেই তোমার আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তবে দু’জনের হাতেই কিন্তু লাল গোলাপ ফুল থাকতে হবে আর দু’জন যেন গায়ে গা-লাগিয়ে জড়াজড়ি করে বসে থাকে।’ এবার সবটাই তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো। সে বলল, ‘দুর, কি যে কন।’ অতঃপর তাকে মূল বিষয়টা বুঝিয়ে, আশ্বস্ত করে, চা খাইয়ে বিদায় করা হলো। সে যাওয়ার পর বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবলাম—আমাদের সবকিছুই কি বেনিয়াদের দখলে চলে যাবে? আমাদের কিছু গাড়ল বুদ্ধিজীবীকে কিনে তারা এক এক সময় এক এক হুজুগ তুলে ধান্ধা করবে, আর সেই ধান্ধার শিকার হয়ে আমাদের তরুণ সমাজ নিত্যনতুন আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার গলিতে পথ হারাতে থাকবে? পাশ্চাত্যের দাসদের কবলে পড়ে তাদের যত ভণ্ড-নষ্ট সংস্কৃতির বিকৃত জৌলুসে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটবে—যার সঙ্গে তার নিজের দেশ-মাটি এবং সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই!
সেদিন থেকে কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। মনে পড়ছে—ব্রিটিশ ভারতে একটা শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল, যাদের বলা হতো এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এদের অধিকাংশের জন্ম ব্রিটিশ লম্পটদের যৌন লালসার শিকার এদেশী মেয়েদের গর্ভে। অবশ্য বহু ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত হয়ে ওইসব মেয়েরা বিয়ে নামক একটা তামাশাকে অবলম্বন করে নিত। তাদের সন্তানরা পিতৃ রাজত্বের আনুকূল্যে আছে ভেবে নিজেদের একটা পৃথক শ্রেণী হিসেবে গণ্য করত। তাদের সংস্কৃতির ধাঁচও হয়ে গিয়েছিল শঙ্কর প্রকৃতির। তারা যে অঞ্চলে বাস করত সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি তাদের ছিল তীব্র অবজ্ঞা। পরে ব্রিটিশ যখন এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হলো, তখন দেখা গেল—এই এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে নিয়ে গেল না তাদের পিতৃপুরুষরা। ব্রিটিনে জায়গা হলো না তাদের, আর এদেশী সমাজ থেকে তারা তো স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আগেই। আমাদের এ দেশে এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তেমন দেখা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ ভারতের যে শহরে তারা আছে, তাদের ছিন্নমূল অবস্থা দেখে আজ সমবেদনা জানানোরও কেউ নেই।
আমাদের দেশে জন্মগত কারণে না হলেও পাশ্চাত্য পদলেহনের অন্ধমোহে তৈরি হচ্ছে একশ্রেণীর ‘ইংলা’ প্রজাতি। যারা বাংলাকে ইংরেজি উচ্চারণে বলার বালখিল্য অপচেষ্টা করে চলেছে—আর ইংরেজি উচ্চারণ শিখছে আমেরিকান অন্ধকার জগতের নষ্ট ছেলেমেয়েদের ব্যাকরণহীন উচ্চারণ থেকে। মূলত এরা বাংলা এবং ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোমত শেখেনি। অথচ মনে-প্রাণে তারা আমেরিকান আদর্শে (?) উজ্জীবিত বলে নিজেদের মনে করে। একসময় যেমন নিজেদের ব্রিটিশ আদর্শে দীক্ষিত বলে মনে করত এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। আজ আমেরিকা বিশ্ব মোড়ল। ভুললে চলবে না—যে একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। বিশ্বব্যাপী সেই ক্ষমতা ও শক্তি এখন বড়ই নিভন্ত। এমন অবস্থা আমেরিকারও যে কখনও হবে না—তা কে বলতে পারে? আজকের ‘ইংলা’ প্রজাতি যারা নিজেদের ‘বাংরিকান’ বলে ভাবতে প্রলুব্ধ হচ্ছে—এক দিন তাদের অবস্থাও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো হবে। দুঃখ হচ্ছে এই যে এরা জন্মগতভাবে শঙ্কর নয়—এরা আমাদেরই সন্তান। এদের ‘ভ্যালেন্টাইন—যে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভ্যানট্যানআইন’ তা এরা ভুলে গেলে এক দিন সাধারণ মানুষও তাদের ভুলে যাবে। চিনতে পারবে না শেকড়হীন এসব পরগাছাকে। এই ভাষার মাসে কে জানে, উন্মূল এই প্রজাতির কোনো রকম বোধোদয় হবে কিনা!
লেখক : কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সেদিন থেকে কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। মনে পড়ছে—ব্রিটিশ ভারতে একটা শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল, যাদের বলা হতো এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এদের অধিকাংশের জন্ম ব্রিটিশ লম্পটদের যৌন লালসার শিকার এদেশী মেয়েদের গর্ভে। অবশ্য বহু ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত হয়ে ওইসব মেয়েরা বিয়ে নামক একটা তামাশাকে অবলম্বন করে নিত। তাদের সন্তানরা পিতৃ রাজত্বের আনুকূল্যে আছে ভেবে নিজেদের একটা পৃথক শ্রেণী হিসেবে গণ্য করত। তাদের সংস্কৃতির ধাঁচও হয়ে গিয়েছিল শঙ্কর প্রকৃতির। তারা যে অঞ্চলে বাস করত সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি তাদের ছিল তীব্র অবজ্ঞা। পরে ব্রিটিশ যখন এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হলো, তখন দেখা গেল—এই এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে নিয়ে গেল না তাদের পিতৃপুরুষরা। ব্রিটিনে জায়গা হলো না তাদের, আর এদেশী সমাজ থেকে তারা তো স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আগেই। আমাদের এ দেশে এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তেমন দেখা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ ভারতের যে শহরে তারা আছে, তাদের ছিন্নমূল অবস্থা দেখে আজ সমবেদনা জানানোরও কেউ নেই।
আমাদের দেশে জন্মগত কারণে না হলেও পাশ্চাত্য পদলেহনের অন্ধমোহে তৈরি হচ্ছে একশ্রেণীর ‘ইংলা’ প্রজাতি। যারা বাংলাকে ইংরেজি উচ্চারণে বলার বালখিল্য অপচেষ্টা করে চলেছে—আর ইংরেজি উচ্চারণ শিখছে আমেরিকান অন্ধকার জগতের নষ্ট ছেলেমেয়েদের ব্যাকরণহীন উচ্চারণ থেকে। মূলত এরা বাংলা এবং ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোমত শেখেনি। অথচ মনে-প্রাণে তারা আমেরিকান আদর্শে (?) উজ্জীবিত বলে নিজেদের মনে করে। একসময় যেমন নিজেদের ব্রিটিশ আদর্শে দীক্ষিত বলে মনে করত এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। আজ আমেরিকা বিশ্ব মোড়ল। ভুললে চলবে না—যে একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। বিশ্বব্যাপী সেই ক্ষমতা ও শক্তি এখন বড়ই নিভন্ত। এমন অবস্থা আমেরিকারও যে কখনও হবে না—তা কে বলতে পারে? আজকের ‘ইংলা’ প্রজাতি যারা নিজেদের ‘বাংরিকান’ বলে ভাবতে প্রলুব্ধ হচ্ছে—এক দিন তাদের অবস্থাও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো হবে। দুঃখ হচ্ছে এই যে এরা জন্মগতভাবে শঙ্কর নয়—এরা আমাদেরই সন্তান। এদের ‘ভ্যালেন্টাইন—যে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভ্যানট্যানআইন’ তা এরা ভুলে গেলে এক দিন সাধারণ মানুষও তাদের ভুলে যাবে। চিনতে পারবে না শেকড়হীন এসব পরগাছাকে। এই ভাষার মাসে কে জানে, উন্মূল এই প্রজাতির কোনো রকম বোধোদয় হবে কিনা!
লেখক : কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments