চারদিক-জ্যোতি বসুর বাড়িতে একদিন by স্বপন কুমার দাস
চলে গেলেন জ্যোতি বসু। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটল একটি বর্ণাঢ্য জীবনের। এই তো গত শুক্রবার ঘুরে এলাম বারদী থেকে। বারদী—জ্যোতি বসুর স্মৃতিধন্য। ঢাকা থেকে বারদীর দূরত্ব সাকল্যে ৩৫ কিলোমিটার হবে। কিন্তু এ পথটুকু পাড়ি দিতে একাধিক বাহন পাল্টাতে হয়।
ঝক্কিঝামেলাও অনেক। গুলিস্তান মোড় থেকে মাঝেমধ্যে সরাসরি বারদী যাওয়ার বাস পাওয়া যায় বটে, তবে সে বাস কিছু দূর যাওয়ার পরই যথারীতি লোকাল হয়ে যায়। তখন সারাটা পথ ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা করে যেতে হয়। কখনো তা হাতাহাতির পর্যায়ে যায়। এমনি এক সিটিং-লোকাল বাসে চেপে বারদী এসে পৌঁছাই। উদ্দেশ্য, জ্যোতি বসুর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বারদীর বাড়িটি দেখার।
পথে পথে যানজট-জনজট মোকাবিলা করে বারদী পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এসে বাস থামে বারদীর ব্রহ্মচারী নামে খ্যাত শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের পূর্ব পাশে। সেখান থেকে রিকশায় চেপে রওনা দিই। ভাড়া ১০ টাকা। পিচঢালা সরু পথে রিকশা চলা শুরু করে। রিকশাচালকের নাম আলী হোসেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করি, জ্যোতি বসুর অসুস্থতার খবর কি আপনি জানেন? আলী হোসেন বলেন, ‘হ্যাঁ, জানি। তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন।’ আলী হোসেন আরও বলেন, এ গ্রামের মানুষ জ্যোতি বসু আর বাবার (লোকনাথ ব্রহ্মচারী) জন্য গর্বিত। তাঁদের কারণেই গ্রামটি আজ বিখ্যাত। এ গ্রামের বহু লোক কলকাতায় গিয়ে জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে এসেছে। বারদী থেকে কেউ জ্যোতি বসুর বাড়িতে গেলে তিনি কুশল বিনিময় করেন, আদর-আপ্যায়ন করেন। রিকশাচালক আলী হোসেনের কথা শুনে বিস্মিত হই।
বারদীর আশ্রম থেকে জ্যোতি বসুর পৈতৃক ভিটার দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। পাঁচ-সাত মিনিট পরই আমরা এসে পৌঁছি বাড়ির ফটকের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ওই ফটক দিয়ে ঢুকে পা রাখি বাড়ির আঙিনায়। আম, তেঁতুল, তাল ও সুপারিগাছের ঘেরাটোপে বন্দী বেশ উঁচু একটি দোতলা বাড়ি। এটাই জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি। শৈশবে মায়ের কোলে চড়ে তিনি এ গ্রামে এসেছেন এবং এ বাড়িতে থেকেছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও তিনি এ গ্রামে এসেছেন। বাড়িটি দেখে গেছেন। এ গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর বহু স্মৃতি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, কিংবদন্তিতুল্য বাম রাজনীতিক জ্যোতি বসুর পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী গ্রামে। তবে জ্যোতি বসুর জন্ম কলকাতায় (৮ জুলাই ১৯১৪ইং), হ্যারিসন রোডের (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) একটি বাড়িতে। জ্যোতি বসুর ঠাকুরদার কর্মস্থল ছিল আসামের ধুবলিতে। তাঁর বাবা ও কাকারা বেড়ে উঠেছেন ধুবলিতে, লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। তবে পূর্বপুরুষদের বাস্তুভিটা বারদীতে তাঁদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে, দুর্গাপূজার সময় তাঁরা সবাই বারদীতে আসতেন। এখানে ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপূজা করতেন। তা ছাড়া জ্যোতি বসুর মা শ্রীমতি হেমলতা বসুও বারদীর মেয়ে ছিলেন। সে হিসেবে বারদী জ্যোতি বসুর মাতুলালয়ও বটে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বারদীতে তাঁদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন। লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন, কলকাতা ফিরে এসে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও থেকেছেন। কিন্তু বারদীকে কখনো বিস্মৃত হননি। তাই দেশ ভাগের দীর্ঘ ৪১ বছর পর ১৯৮৭ সালের ১ মার্চ তিনি সস্ত্রীক বারদীতে বেড়াতে আসেন। এরপর আবার বারদীতে আসেন ১৯৯৭ সালের ২৭ নভেম্বর। সেবার সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাসগুপ্ত। এখানে এসে তিনি বরাবরের মতো বাড়িটি ঘুরেফিরে দেখেন। অদূরে শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে যান এবং প্রসাদ নেন। এভাবেই তিনি বারদীর সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন।
বারদীতে জ্যোতি বসুর বসতভিটার পরিমাণ দেড় বিঘা। তবে বাড়িটি ছয় কাঠার ওপর নির্মিত। মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু বেদির ওপর বাড়িটি নির্মিত। বাড়িটির নাম হেমলতা ভবন। এর নিচতলায় দুটি এবং দোতলায় তিনটি কক্ষ আছে। বাড়ির ভেতর দিয়ে ওপরে ওঠার পাকা সিঁড়িটি ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাদ থেকে গ্রামের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। গ্রীষ্মকালে অদূরে মেঘনা নদী থেকে ভেসে আসা দক্ষিণা বাতাসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। বাড়িটি দক্ষিণমুখী হলেও এর দক্ষিণের প্রবেশপথ এখন নিশ্চিহ্ন। তাই এখন পেছনের পথ দিয়েই বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। পূর্ব দিকের পুকুর ঘাটটি বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে। পুকুরটির পাড় ভেঙে বর্ষাকালে এর জল বাড়িটিকে স্পর্শ করে। ফলে বাড়িটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জ্যোতি বসু তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বারদীতে তাঁর আগমন প্রসঙ্গে লিখেছেন। তাতে তিনি বারদীর তাঁদের সব সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারকে দান করার কথা উল্লেখ করেছেন। তাই বাড়িটি দখলমুক্ত করে জ্যোতি বসুর ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে একে একটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা যায়। গড়ে তোলা যায় এখানে চমত্কার একটি ভ্রমণকেন্দ্র।
আজ সবার মতো বারদীর সবাই জেনে গেছে, জ্যোতি বসু আর নেই। শোকের আবহ বিরাজ করছে বারদীতে।
জ্যোতি বসুর স্মৃতিধন্য বাড়িটি সংরক্ষণ করা হলে এই শোক কাটিয়ে নতুন করে তাঁকে নিয়ে ভাবতে পারবে বারদীবাসী।
পথে পথে যানজট-জনজট মোকাবিলা করে বারদী পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এসে বাস থামে বারদীর ব্রহ্মচারী নামে খ্যাত শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের পূর্ব পাশে। সেখান থেকে রিকশায় চেপে রওনা দিই। ভাড়া ১০ টাকা। পিচঢালা সরু পথে রিকশা চলা শুরু করে। রিকশাচালকের নাম আলী হোসেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করি, জ্যোতি বসুর অসুস্থতার খবর কি আপনি জানেন? আলী হোসেন বলেন, ‘হ্যাঁ, জানি। তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন।’ আলী হোসেন আরও বলেন, এ গ্রামের মানুষ জ্যোতি বসু আর বাবার (লোকনাথ ব্রহ্মচারী) জন্য গর্বিত। তাঁদের কারণেই গ্রামটি আজ বিখ্যাত। এ গ্রামের বহু লোক কলকাতায় গিয়ে জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে এসেছে। বারদী থেকে কেউ জ্যোতি বসুর বাড়িতে গেলে তিনি কুশল বিনিময় করেন, আদর-আপ্যায়ন করেন। রিকশাচালক আলী হোসেনের কথা শুনে বিস্মিত হই।
বারদীর আশ্রম থেকে জ্যোতি বসুর পৈতৃক ভিটার দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। পাঁচ-সাত মিনিট পরই আমরা এসে পৌঁছি বাড়ির ফটকের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ওই ফটক দিয়ে ঢুকে পা রাখি বাড়ির আঙিনায়। আম, তেঁতুল, তাল ও সুপারিগাছের ঘেরাটোপে বন্দী বেশ উঁচু একটি দোতলা বাড়ি। এটাই জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি। শৈশবে মায়ের কোলে চড়ে তিনি এ গ্রামে এসেছেন এবং এ বাড়িতে থেকেছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও তিনি এ গ্রামে এসেছেন। বাড়িটি দেখে গেছেন। এ গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর বহু স্মৃতি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, কিংবদন্তিতুল্য বাম রাজনীতিক জ্যোতি বসুর পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী গ্রামে। তবে জ্যোতি বসুর জন্ম কলকাতায় (৮ জুলাই ১৯১৪ইং), হ্যারিসন রোডের (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) একটি বাড়িতে। জ্যোতি বসুর ঠাকুরদার কর্মস্থল ছিল আসামের ধুবলিতে। তাঁর বাবা ও কাকারা বেড়ে উঠেছেন ধুবলিতে, লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। তবে পূর্বপুরুষদের বাস্তুভিটা বারদীতে তাঁদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে, দুর্গাপূজার সময় তাঁরা সবাই বারদীতে আসতেন। এখানে ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপূজা করতেন। তা ছাড়া জ্যোতি বসুর মা শ্রীমতি হেমলতা বসুও বারদীর মেয়ে ছিলেন। সে হিসেবে বারদী জ্যোতি বসুর মাতুলালয়ও বটে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বারদীতে তাঁদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন। লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন, কলকাতা ফিরে এসে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও থেকেছেন। কিন্তু বারদীকে কখনো বিস্মৃত হননি। তাই দেশ ভাগের দীর্ঘ ৪১ বছর পর ১৯৮৭ সালের ১ মার্চ তিনি সস্ত্রীক বারদীতে বেড়াতে আসেন। এরপর আবার বারদীতে আসেন ১৯৯৭ সালের ২৭ নভেম্বর। সেবার সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাসগুপ্ত। এখানে এসে তিনি বরাবরের মতো বাড়িটি ঘুরেফিরে দেখেন। অদূরে শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে যান এবং প্রসাদ নেন। এভাবেই তিনি বারদীর সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন।
বারদীতে জ্যোতি বসুর বসতভিটার পরিমাণ দেড় বিঘা। তবে বাড়িটি ছয় কাঠার ওপর নির্মিত। মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু বেদির ওপর বাড়িটি নির্মিত। বাড়িটির নাম হেমলতা ভবন। এর নিচতলায় দুটি এবং দোতলায় তিনটি কক্ষ আছে। বাড়ির ভেতর দিয়ে ওপরে ওঠার পাকা সিঁড়িটি ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাদ থেকে গ্রামের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। গ্রীষ্মকালে অদূরে মেঘনা নদী থেকে ভেসে আসা দক্ষিণা বাতাসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। বাড়িটি দক্ষিণমুখী হলেও এর দক্ষিণের প্রবেশপথ এখন নিশ্চিহ্ন। তাই এখন পেছনের পথ দিয়েই বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। পূর্ব দিকের পুকুর ঘাটটি বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে। পুকুরটির পাড় ভেঙে বর্ষাকালে এর জল বাড়িটিকে স্পর্শ করে। ফলে বাড়িটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জ্যোতি বসু তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বারদীতে তাঁর আগমন প্রসঙ্গে লিখেছেন। তাতে তিনি বারদীর তাঁদের সব সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারকে দান করার কথা উল্লেখ করেছেন। তাই বাড়িটি দখলমুক্ত করে জ্যোতি বসুর ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে একে একটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা যায়। গড়ে তোলা যায় এখানে চমত্কার একটি ভ্রমণকেন্দ্র।
আজ সবার মতো বারদীর সবাই জেনে গেছে, জ্যোতি বসু আর নেই। শোকের আবহ বিরাজ করছে বারদীতে।
জ্যোতি বসুর স্মৃতিধন্য বাড়িটি সংরক্ষণ করা হলে এই শোক কাটিয়ে নতুন করে তাঁকে নিয়ে ভাবতে পারবে বারদীবাসী।
No comments