গদ্যকার্টুন-সংবর্ধনা কথাটার মানে কেন অতিবৃদ্ধি by আনিসুল হক

সংবর্ধনা কথাটা এসেছে বর্ধন থেকে। বর্ধন মানে বৃদ্ধি। সংবর্ধনা মানে অতিবৃদ্ধি, বাড়ানো। এটা অভিধানে লেখা আছে। এ ছাড়া সংবর্ধনার আরেকটা মানে আছে। তা হলো, সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা। সংবর্ধনা কথাটা শুরু হয়েছে সং দিয়ে। যদিও সম্+বর্ধনা থেকে সংবর্ধনা, তবু কথাটার সামনের সং শব্দটা মনে হয় বেশ তাত্পর্যপূর্ণ।


সংবর্ধনা যাকে দেওয়া হয়, তাকে বেশ সং সং লাগে। সং কথাটার অর্থ কৌতুককর বেশধারী, কৌতুককারী, বিদূষক, ভাঁড়।
বাংলাদেশ এখন সহজেই গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান নিতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ এখন সংবর্ধনার দেশ। এই দেশে প্রতিদিন বিচিত্র উপলক্ষে বিভিন্নজনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়ে থাকে। এসব সংবর্ধনা হয় প্রাণঢালা। প্রাণঢালা মানে প্রাণ ঢেলে দেওয়া, নাকি প্রাণ থেকে ঢেলে দেওয়া, সেটা আমার জানা নেই।
কৃতী ছাত্র সংবর্ধনা, কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলকে সংবর্ধনা ইত্যাদি আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য, এটা আমরা করে থাকি ভালোকে আরও ভালো করতে উত্সাহিত করতে, অন্যদেরও সফলদের অনুসরণে অনুপ্রাণিত করতে।
কিন্তু গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে কী কী কারণে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে অতি সামান্য কয়েকটা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা কামালকে সংবর্ধনা। কারণ কী? কারণ হলো, তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪৬টি তোরণ বানিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে একজন সংসদ সদস্যকে। কারণ কী? তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
৩৩ কিলোমিটার-জুড়ে ২১টি তোরণ, ৪৭৬টি মোটরসাইকেল, শতাধিক মাইক্রো নিয়ে বরণ করা হয়েছে নাটোরের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে। তাঁর কীর্তি কী? তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন।
মেহেরপুরের আওয়ামী লীগের এক সাংসদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে মাস দুয়েক আগে। তাঁর কীর্তি কী? তিনিও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে না হোক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে। কাজেই তাঁর মেহেরপুরে আগমন উপলক্ষে পুরো শহরকে সাজানো হয়েছিল নতুন সাজে। দেড় হাজার মোটরসাইকেল, ৭০০ বাস-ট্রাক দিয়ে লোক আনিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাপ্স। কম হলো না? যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ফিরেছেন, তাঁর কি আরেকটু বেশি কিছু পাওনা ছিল না?
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বরিশাল প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বানানো হয়েছিল শতাধিক তোরণ। কারণ তিনি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিভাবক, আট বছর পর তিনি অভিভাবকত্ব করতে জেলায় ফিরতে পারলেন।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, এই বিশাল বিরল কৃতিত্বের জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে যশোর বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামকে।
এটা অবশ্য লেটেস্ট ট্রেন্ড। সম্প্রতি বিএনপির কাউন্সিল হয়ে গেছে। এরপর কমিটি ঘোষিত হচ্ছে। কমিটিতে যাঁরা স্থান করে নিতে পেরেছেন আপন যোগ্যতা ও নিষ্ঠাবলে, তিনি কেবল নিজের মুখোজ্জ্বল করেননি, এলাকার মানুষের মুখও উজ্জ্বল করেছেন। কাজেই তাঁদের এলাকায় এলাকায় দেওয়া হচ্ছে ব্যাপক সংবর্ধনা। শুধু বিএনপির কমিটিতে নয়, ছাত্রদলের কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার গৌরব মহল্লাবাসীর মধ্যে বিলিয়ে দিতে আয়োজিত হচ্ছে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
এমন দেশে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর শেষে ফিরবেন, আর তখন তাঁর পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হবে বলে প্রকাশ্য ঘোষণাও এসেছে বিরোধী নেত্রীর কাছ থেকে, এই অবস্থায় তাঁকে যে বিমানবন্দরেই ব্যাপক সংবর্ধনার মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হবে, সে আর আশ্চর্য কী। এটা তো কেবল সংবর্ধনা নয়, রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনও।
আর সংবর্ধনা কথাটার মানেই হলো অতিবৃদ্ধি। সে রক্ষত্রে একটু বাড়াবাড়ি হবেই, আর তা করতে গেলে ঢাকা শহরের মানুষজন যদি ঘণ্টা তিনেক যানজটে আটকা পড়েই থাকেন, সেটাকে তাঁদের হাসিমুখেই নেওয়া উচিত।
এবার আপনাদের আমি অন্য একটা গল্প শোনাব। কোপেনহেগেনে ডিসেম্বর ২০০৯-এ অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন সফল হয়েছে, এটা কেউই দাবি করবে না। এমনকি ডেনমার্ক সরকারও করবে না। আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, এই রকম একটা চুক্তি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো হতাশ। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির সবচেয়ে বড় শিকার যখন বাংলাদেশ।
এই সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই গিয়েছিলেন, বস্তুত সারা পৃথিবী থেকেই হাজার হাজার মানুষ গিয়েছিল সম্মেলনে। কেউ গেছেন রথ দেখতে, কেউ গেছেন কলা বেচতে। ওইখানে মোটামুটি কয়েক প্রকারের মানুষ গিয়েছিলেন। এক দল ছিলেন, যাঁরা দরকষাকষিতে অংশ নিচ্ছিলেন, এঁরা প্রধানত সরকারি আমলা, বাংলাদেশ থেকে যেমন গিয়েছিলেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, কয়েকজন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, পরবর্তীকালে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ও সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী সেই দলে যোগ দেন। একদল ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও, পরিবেশবিদ—এঁরা গিয়েছিলেন পরিস্থিতি দেখতে আর সরকারি প্রতিনিধিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। গিয়েছিল শিশুরা, গিয়েছিল তরুণেরা, এমনকি সাতক্ষীরার এক মহিলাও গিয়েছিলেন দুর্গত হিসেবে। এনজিওকর্মীরাই কোপেনহেগেনে বড় বড় সমাবেশ করেছেন, এমনকি সম্মেলনস্থলে ঢিলও মেরেছিলেন। গিয়েছিলেন আমার মতো সাংবাদিকেরা। আমাদের কাজ ছিল দেখা এবং লেখা।
বাংলাদেশ থেকে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য ছাড়া বাকিদের করার তেমন কিছু ছিল না। যেমন গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য, তাঁদের নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী অবশ্য ব্যস্ত ছিলেন সংবাদ সম্মেলন করতে এবং ডেনমার্কের পার্লামেন্ট ভবনে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একটা যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা ইত্যাদি নিয়ে। বাকিরা নেতাকে অনুসরণ করেছেন। মূল দরকষাকষির জায়গায় তাঁদের করারও কিছু ছিল না, করার ব্যাপারে তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন না। যাই হোক সম্মেলন শেষ হয়ে গেল। সবাই যাঁর যাঁর মতো ব্যর্থ মনোরথে যাঁর যাঁর দেশে ফিরে গেলেন।
এবং নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এবার নিচের খবরটা পড়ুন:
বরগুনার বেতাগী উপজেলা পরিষদ এলাকার বিভিন্ন স্থাপনায় ঝুলছে নানা রঙের ব্যানার। সারা শহরে যেন সাজ সাজ রব।... তিনি উপজেলায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার পথে ছিল ৮৪টি তোরণ।
...‘সাংসদ গোলাম সবুর সম্প্রতি জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কোপেনহেগেন সফর করায় এ সুধী সমাবেশ ও সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।’ (প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৯)
এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, সংবর্ধনা শব্দটির মানে কেন অতিবৃদ্ধি বা বাড়ানো। সং কথাটা নিয়ে সংলাপ না হয় নাই রচনা করলাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.