বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য by মাহফুজ উল্লাহ
নয় দশক আগে ভূমিলক্ষ্মী প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘তখন দুর্ভিক্ষের দিনে চাষী আপন জমিজমা ফেলিয়া অনায়াসে চালিত হইত, প্রজা পত্তন করা কঠিন হইত। এখন চাষী প্রাণপণে জমি আঁকড়াইয়া থাকে, কেননা জমির দাম বিস্তর বাড়িয়া গিয়াছে। অথচ চাষী বলিতেছে, জমিতে তাহার অভাব মিটে না।
তাহার একটা মস্ত কারণ এই যে, চাষীর অভাব অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। ছাতা, জুতা, কাপড়, আসবাব তাহার দ্বারের কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, বুঝিয়াছে সেগুলি নইলে নয়। সেই সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশের খরিদ্দার আসিয়া তাহার দ্বারে ঘা দিয়াছে। তাহার ফসল জাহাজ বোঝাই হইয়া সমুদ্র পারে চলিয়া যাইতেছে। তাই দেশে চাষের জমি পড়িয়া থাকা অসম্ভব হইয়াছে, অথচ সমস্ত জমি চষিয়াও সমস্ত প্রয়োজন মিটিতেছে না। জমিও পড়িয়া রহিল না, ফসলের দরও বাড়িয়া চলিল, অথচ সম্বত্সর দুই বেলা পেট ভরিবার মতো খাবার জোটে না, আর চাষী ঋণে ডুবিয়া থাকে, ইহার কারণ কী ভাবিয়া দেখিতে হইবে। এমন কেন হয়—যখনি দুবত্সর আসে অমনি দেখা যায় কাহারো ঘরে উদ্বৃত্ত কিছুই নাই। কোন এক ফসল নষ্ট হইলেই আর এক ফসল না ওঠা পর্যন্ত হাহাকারের অন্ত থাকে না।’
এই উপলব্ধির আরও আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার আনন্দমঠ গ্রন্থে বলেছেন, অভাবের তাড়নায় কৃষক জমিজমা, বউ, মেয়ে বিক্রি করে দেশান্তরী হয়। এরও আগে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালুর পরপর ১৭৯৯ সালে ‘হাফতম’ (সপ্তম রেগুলেশন) আইন বলে ভূস্বামীরা খাজনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনে প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন, এমনকি বাস্তুহারা করার অধিকার লাভ করে। এ ধরনের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে পরবর্তী পর্যায়ে ১৮৫৫-৫৭ সময়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৯-৬১ সময়ে নীল বিদ্রোহ, ১৮৭২-৭৫ সময়ে বাকেরগঞ্জ খাজনা বৃদ্ধি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ১৮৭৩ সালে জমিদারদের লাগামহীন খাজনা বৃদ্ধির প্রবণতার বিরুদ্ধে পাবনা জেলায় বিদ্রোহ প্রভৃতি ঘটনা ঘটে। একদিকে নির্যাতন, অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষকের দুর্গতির কারণেই ১৮৮৭-৯০ ও ১৮৯৬-৯৭ সময়ে পূর্ববাংলায় ও বাংলাদেশসহ সারা ভারতে আকাল ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯২৯-৩৫ সময়ে মহামন্দার কারণে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর ১৯৩৩ সালে দ্য বেঙ্গল বোর্ড অব ইকনমিক ইনকোয়ারি তথ্য প্রকাশ করে যে, তখন বাংলার গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৭৭ ভাগ মহাজন ও ভূস্বামীদের কাছে ঋণগ্রস্ত। এই পরিবারগুলো মূলত ছিল কৃষক পরিবার।
কৃষকের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্টের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত করা হয়। এদেশের কৃষক সমাজের জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী, তার মননে পরিবর্তন আনয়নকারী অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু মোটা দাগে যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা কৃষকের অবস্থা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যে কারণে এই দীর্ঘ সূচনা, তা হচ্ছে—বিগত দু’শ বছরের বেশি পথ পরিক্রমায় কৃষকের জীবনে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? তার ঋণগ্রস্ততার কি উন্নতি হয়েছে? বর্তমানে মোট জাতীয় উত্পাদনের শতকরা ২৬ ভাগ কৃষি থেকে এলেও কৃষকের জীবন ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে গুণগত পরিবর্তন হয়নি। শুধু কৃষকের শৃঙ্খলের চেহারা বদলেছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর বাংলাদেশের কৃষকের ঋণগ্রস্ততা সম্পর্কে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখের একটি দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠায় এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কৃষিঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় আসামি হয়ে সারা দেশের এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৬ জন কৃষক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বোরোর এ ভরা মৌসুমে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ খেলাপের অভিযোগে এসব কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বাংলাদেশ বাংক সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে পোশাক শিল্পের ২৭০টি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের এক হাজার ত্রিশ কোটি টাকার মামলা স্থগিত রাখতে ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ পৌনে দুই লাখ কৃষকের মাত্র ৪৫৬ কোটি টাকা ঋণের ঘটনায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিঋণ পেতে কৃষককে প্রতি হাজারে ১০০ টাকা ঘুষ দিতে হয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের, আরও ১০০ টাকা নেয় দালালরা। মাত্র ৮০০ টাকা পায় জমির দলিল জমা দেয়া কৃষক।... বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন ২৪ হাজার ৪৬২ জন। এছাড়া জনতা ব্যাংকে ১৯ হাজার ৮৯৪ জন, অগ্রণী ব্যাংকে ২৬ হাজার ২৮৭ জন, রূপালী ব্যাংকে দুই হাজার ৯৪৭ জন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ৯১ হাজার ৫১৪ জন এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ১৮ হাজার ৪৪২ জন ঋণখেলাপি। এসব কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর সুদ-আসলে মোট পাওনার পরিমাণ ৪৫৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। নওগাঁর পোরশা উপজেলার কৃষক আয়নাল হোসেন জানান, ১৯৮৪ সালে ২৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন পরিশোধ না করায় এখন সুদে-আসলে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। আয়নাল বলেন, ‘এখন দিনে কাজ করতে পারলেও গ্রেফতারের ভয়ে রাতে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকি।’ একই ধরনের মন্তব্য জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত যশোরের কৃষক মোসলেম উদ্দিনের। তিনি জানান, এলাকায় ঋণখেলাপি অনেক কৃষকের বাড়িতে প্রায়ই পুলিশ আসছে। কেউ কেউ টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারলেও অধিকাংশই প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একই ধরনের মন্তব্য নাটোরের কৃষক প্রতিনিধি আসলা, সাভারের আবুল কাশেম, দোহারের মুন্সী আবদুর রউফসহ অনেকের। বগুড়ার ধুনট থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াছিন কৃষিঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাওয়ার কথা স্বীকার করে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবিক কারণে অনেককে গ্রেফতার করা হয় না। থানায় ডেকে এবং অভিযুক্ত কৃষকের বাড়ি গিয়ে ঋণ পরিশোধের তাগিদ দেয়া হয়। এতে কাজ না হলে গ্রেফতার করা হয়। এ পর্যন্ত ৮-১০ কৃষক গ্রেফতার হয়েছেন। ধুনট থানার নির্বাহী কর্মকর্তা ও সার্টিফিকেট অফিসার আবদুল্লাহ হারুন বলেন, দিন দিন মামলার সংখ্যা বাড়লেও আশানুরূপ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কারণ ৮০ শতাংশ কৃষকেরই ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা ব্যাংকগুলোকে কৃষকের সব ঋণ পুনঃতফসিল করে দিতে চিঠি দিয়েছি। ৫ থেকে ১০ শতাংশ ঋণ পরিশোধের মাধ্যমেই কৃষকের ঋণ যাতে পুনঃতফসিল করে নেয়া হয় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ ঋণ পুনঃতফসিল হলেই কৃষক নতুন করে ঋণের আওতার মধ্যে আসবে এবং চাষাবাদ করে পুরনো ঋণসহ ফেরত দিতে সক্ষম হবে। তবে ব্যাংকগুলো এ নির্দেশ কতটুকু বাস্তবায়ন করছে তা শিগগিরই আমরা খতিয়ে দেখব।’... বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আসামি কৃষকদের প্রত্যেকেই পরিশোধ করার মনোবৃত্তি নিয়েই ঋণ নিয়েছিলেন। এর প্রমাণ মেলে আসামি কৃষকদের প্রত্যেকেরই সম্পত্তির দলিলপত্র জমা রাখায়। তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন—বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং অভাব-অনটনের কারণে ঋণ ফেরত দিতে পারেননি। উপরন্তু ব্যাংক কর্মকর্তা ও দালালদের খপ্পর তো রয়েছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো এ বছর প্রায় এগার হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করলেও খেলাপি কৃষকরা এ ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। একই সঙ্গে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তারা সরকারের সহায়তাও নিতে যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিসংখ্যান ও কৃষকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেখে থাকবেন। নিজে না পড়লেও জনসংযোগ দফতরের কল্যাণে এ প্রতিবেদন তার দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা। প্রশ্ন সেখানেই। ড. আতিউর রহমান সজ্জন ব্যক্তি, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই গরিব ও প্রান্তিক চাষী এবং মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলছেন। আগেও তিনি এসব কথা বলতেন এবং নিজের বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ছিল সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি।
এই যে কৃষকের নামে হাজার হাজার মামলা সে সমস্যা সমাধানে, কৃষককে ঋণের বেড়াজাল ও অন্যায় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে ড. আতিউর রহমান এখন কী করবেন? ঋণের অত্যাচারের বাইরেও বাংলাদেশের কৃষক গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার কারণে বাড়তি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। তার ফসল নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে জীবনযাপনের সমস্যা। এ বিষয়টিও সরকার বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে বলে মনে হয় না। এই বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, কৃষককে ব্যাংকিং সুবিধা দেয়ার জন্য হারিকেন জ্বালিয়ে হলেও রাতে ব্যাংক খোলা রাখতে হবে। কারণ দিনের বেলা কাজ ফেলে ব্যাংকে আসতে কৃষকের সমস্যা হয়।
এখন জানতে ইচ্ছা করে, কৃষকের জীবনের বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত বঞ্চনার অবসান না ঘটিয়ে হারিকেনের আলোয় কি তার জীবনের অন্ধকার মুছে দেয়া যাবে?
লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশবিদ
এই উপলব্ধির আরও আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার আনন্দমঠ গ্রন্থে বলেছেন, অভাবের তাড়নায় কৃষক জমিজমা, বউ, মেয়ে বিক্রি করে দেশান্তরী হয়। এরও আগে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালুর পরপর ১৭৯৯ সালে ‘হাফতম’ (সপ্তম রেগুলেশন) আইন বলে ভূস্বামীরা খাজনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনে প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন, এমনকি বাস্তুহারা করার অধিকার লাভ করে। এ ধরনের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে পরবর্তী পর্যায়ে ১৮৫৫-৫৭ সময়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৯-৬১ সময়ে নীল বিদ্রোহ, ১৮৭২-৭৫ সময়ে বাকেরগঞ্জ খাজনা বৃদ্ধি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ১৮৭৩ সালে জমিদারদের লাগামহীন খাজনা বৃদ্ধির প্রবণতার বিরুদ্ধে পাবনা জেলায় বিদ্রোহ প্রভৃতি ঘটনা ঘটে। একদিকে নির্যাতন, অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষকের দুর্গতির কারণেই ১৮৮৭-৯০ ও ১৮৯৬-৯৭ সময়ে পূর্ববাংলায় ও বাংলাদেশসহ সারা ভারতে আকাল ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯২৯-৩৫ সময়ে মহামন্দার কারণে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর ১৯৩৩ সালে দ্য বেঙ্গল বোর্ড অব ইকনমিক ইনকোয়ারি তথ্য প্রকাশ করে যে, তখন বাংলার গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৭৭ ভাগ মহাজন ও ভূস্বামীদের কাছে ঋণগ্রস্ত। এই পরিবারগুলো মূলত ছিল কৃষক পরিবার।
কৃষকের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্টের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত করা হয়। এদেশের কৃষক সমাজের জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী, তার মননে পরিবর্তন আনয়নকারী অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু মোটা দাগে যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা কৃষকের অবস্থা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যে কারণে এই দীর্ঘ সূচনা, তা হচ্ছে—বিগত দু’শ বছরের বেশি পথ পরিক্রমায় কৃষকের জীবনে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? তার ঋণগ্রস্ততার কি উন্নতি হয়েছে? বর্তমানে মোট জাতীয় উত্পাদনের শতকরা ২৬ ভাগ কৃষি থেকে এলেও কৃষকের জীবন ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে গুণগত পরিবর্তন হয়নি। শুধু কৃষকের শৃঙ্খলের চেহারা বদলেছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর বাংলাদেশের কৃষকের ঋণগ্রস্ততা সম্পর্কে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখের একটি দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠায় এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কৃষিঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় আসামি হয়ে সারা দেশের এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৬ জন কৃষক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বোরোর এ ভরা মৌসুমে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ খেলাপের অভিযোগে এসব কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বাংলাদেশ বাংক সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে পোশাক শিল্পের ২৭০টি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের এক হাজার ত্রিশ কোটি টাকার মামলা স্থগিত রাখতে ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ পৌনে দুই লাখ কৃষকের মাত্র ৪৫৬ কোটি টাকা ঋণের ঘটনায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিঋণ পেতে কৃষককে প্রতি হাজারে ১০০ টাকা ঘুষ দিতে হয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের, আরও ১০০ টাকা নেয় দালালরা। মাত্র ৮০০ টাকা পায় জমির দলিল জমা দেয়া কৃষক।... বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন ২৪ হাজার ৪৬২ জন। এছাড়া জনতা ব্যাংকে ১৯ হাজার ৮৯৪ জন, অগ্রণী ব্যাংকে ২৬ হাজার ২৮৭ জন, রূপালী ব্যাংকে দুই হাজার ৯৪৭ জন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ৯১ হাজার ৫১৪ জন এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ১৮ হাজার ৪৪২ জন ঋণখেলাপি। এসব কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর সুদ-আসলে মোট পাওনার পরিমাণ ৪৫৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। নওগাঁর পোরশা উপজেলার কৃষক আয়নাল হোসেন জানান, ১৯৮৪ সালে ২৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন পরিশোধ না করায় এখন সুদে-আসলে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। আয়নাল বলেন, ‘এখন দিনে কাজ করতে পারলেও গ্রেফতারের ভয়ে রাতে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকি।’ একই ধরনের মন্তব্য জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত যশোরের কৃষক মোসলেম উদ্দিনের। তিনি জানান, এলাকায় ঋণখেলাপি অনেক কৃষকের বাড়িতে প্রায়ই পুলিশ আসছে। কেউ কেউ টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারলেও অধিকাংশই প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একই ধরনের মন্তব্য নাটোরের কৃষক প্রতিনিধি আসলা, সাভারের আবুল কাশেম, দোহারের মুন্সী আবদুর রউফসহ অনেকের। বগুড়ার ধুনট থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াছিন কৃষিঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাওয়ার কথা স্বীকার করে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবিক কারণে অনেককে গ্রেফতার করা হয় না। থানায় ডেকে এবং অভিযুক্ত কৃষকের বাড়ি গিয়ে ঋণ পরিশোধের তাগিদ দেয়া হয়। এতে কাজ না হলে গ্রেফতার করা হয়। এ পর্যন্ত ৮-১০ কৃষক গ্রেফতার হয়েছেন। ধুনট থানার নির্বাহী কর্মকর্তা ও সার্টিফিকেট অফিসার আবদুল্লাহ হারুন বলেন, দিন দিন মামলার সংখ্যা বাড়লেও আশানুরূপ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কারণ ৮০ শতাংশ কৃষকেরই ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা ব্যাংকগুলোকে কৃষকের সব ঋণ পুনঃতফসিল করে দিতে চিঠি দিয়েছি। ৫ থেকে ১০ শতাংশ ঋণ পরিশোধের মাধ্যমেই কৃষকের ঋণ যাতে পুনঃতফসিল করে নেয়া হয় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ ঋণ পুনঃতফসিল হলেই কৃষক নতুন করে ঋণের আওতার মধ্যে আসবে এবং চাষাবাদ করে পুরনো ঋণসহ ফেরত দিতে সক্ষম হবে। তবে ব্যাংকগুলো এ নির্দেশ কতটুকু বাস্তবায়ন করছে তা শিগগিরই আমরা খতিয়ে দেখব।’... বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আসামি কৃষকদের প্রত্যেকেই পরিশোধ করার মনোবৃত্তি নিয়েই ঋণ নিয়েছিলেন। এর প্রমাণ মেলে আসামি কৃষকদের প্রত্যেকেরই সম্পত্তির দলিলপত্র জমা রাখায়। তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন—বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং অভাব-অনটনের কারণে ঋণ ফেরত দিতে পারেননি। উপরন্তু ব্যাংক কর্মকর্তা ও দালালদের খপ্পর তো রয়েছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো এ বছর প্রায় এগার হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করলেও খেলাপি কৃষকরা এ ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। একই সঙ্গে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তারা সরকারের সহায়তাও নিতে যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিসংখ্যান ও কৃষকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেখে থাকবেন। নিজে না পড়লেও জনসংযোগ দফতরের কল্যাণে এ প্রতিবেদন তার দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা। প্রশ্ন সেখানেই। ড. আতিউর রহমান সজ্জন ব্যক্তি, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই গরিব ও প্রান্তিক চাষী এবং মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলছেন। আগেও তিনি এসব কথা বলতেন এবং নিজের বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ছিল সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি।
এই যে কৃষকের নামে হাজার হাজার মামলা সে সমস্যা সমাধানে, কৃষককে ঋণের বেড়াজাল ও অন্যায় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে ড. আতিউর রহমান এখন কী করবেন? ঋণের অত্যাচারের বাইরেও বাংলাদেশের কৃষক গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার কারণে বাড়তি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। তার ফসল নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে জীবনযাপনের সমস্যা। এ বিষয়টিও সরকার বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে বলে মনে হয় না। এই বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, কৃষককে ব্যাংকিং সুবিধা দেয়ার জন্য হারিকেন জ্বালিয়ে হলেও রাতে ব্যাংক খোলা রাখতে হবে। কারণ দিনের বেলা কাজ ফেলে ব্যাংকে আসতে কৃষকের সমস্যা হয়।
এখন জানতে ইচ্ছা করে, কৃষকের জীবনের বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত বঞ্চনার অবসান না ঘটিয়ে হারিকেনের আলোয় কি তার জীবনের অন্ধকার মুছে দেয়া যাবে?
লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশবিদ
No comments