আঞ্চলিক সহযোগিতা-বাংলাদেশ-ভারতের নতুন সমীকরণ by কুলদীপ নায়ার

কাকতালীয় হলেও শুভ লক্ষণ যে দিল্লিতে এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করেন। এসব আলোচনার কেন্দ্রে ছিল উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ যখন তাদের সম্পর্ককে আরও নিবিড় করছে, তখন ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের বেলায় সৃষ্টি হয়েছে আরও দূরত্ব।


শেখ হাসিনার সফরের সুযোগ সৃষ্টি করতে মনমোহন সিং সরকারের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। অন্যদিকে নাকের ডগায় তিন দিনব্যাপী ভারত-পাকিস্তান বৈঠক চললেও তা প্রায় নজরেই আসেনি। গণমাধ্যম সাধারণত ক্ষমতাসীন মহলের দ্বারা প্রভাবিত হলেও এবার তাদের অবস্থান কিছুটা ভালো ছিল। সে কারণেই সরকারি সফর যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, বেসরকারি পর্যায়ের ভারত-পাকিস্তান আলোচনা ততটা গুরুত্ব ও মনোযোগ পায়নি। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই দেশগুলোর প্রতিনিধিরা নিজ নিজ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে সরকারি লেবেল না থাকলে কোনো কিছুই ততটা গুরুত্ব পায় না।
শেখ হাসিনার সফরটি এমন সময়ে হয়েছে, যখন তিনি তাঁর দেশের চাহিদাগুলো এবং সেগুলো মেটানোয় ভারতের সামর্থ্যের পর্যালোচনা করেছেন। শেখ হাসিনা নিজে থেকে কিছু চাননি কিন্তু এটা আপাতভাবে পরিষ্কার যে, তাঁর দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে না পারলে তাঁর জনপ্রিয়তা নেমে যাবে। ইতিমধ্যে সেটা কমেছে বলে প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতি শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অবদান হলো, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে শক্তিশালী করা। এর ওপর দাঁড়িয়েই তিনি গত নির্বাচনে লড়াই করেন এবং জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশ আসন অর্জন করেন। অন্যদিকে এ থেকেও ভারতও অনেক লাভবান হয়েছে। প্রতিবেশী দেশে মৌলবাদ দুর্বল হওয়া ভারতের জন্য সুবিধাজনক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন, যিনি ভারতবিরোধী কোনো গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না।
ঢাকা উলফা নেতাদের দিল্লির কাছে সমর্পণ করলে উভয় দেশের সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বাস্তবত, সাম্প্রতিক আলোচনায় শেখ হাসিনা পরিষ্কার করে বলেছেন যে তাঁর দেশে কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না। এ ঘটনাই সমীকরণ পাল্টে দিল।
কথিত রয়েছে যে শেখ হাসিনা তাঁর চাহিদা-তালিকা পেশ করার আগেই মনমোহন সিং নাকি বলেছেন, তাঁকে কিছু চাইতে হবে না। বাংলাদেশের যা কিছু প্রয়োজন, ভারত তা আপনা থেকেই সাধ্যমতো পূরণের চেষ্টা করবে।
বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দ্বিগুণ করা হয়েছে। ভারত এই আশ্বাস দিয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে বিতর্কিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুেকন্দ্র বিষয়ে ভারত কিছু করবে না। এবারের সফরের সময় ভারত বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর ট্রানজিট-সুবিধাও চায়নি।
কাবুল থেকে ঢাকা পর্যন্ত এ অঞ্চল চায় সন্ত্রাসবাদের অবসান। ইসলামাবাদ হয়তো তালেবানবিরোধী অভিযানে নয়াদিল্লির অংশগ্রহণ চাইত, কিন্তু মুম্বাই হত্যাযজ্ঞের পর এর কোনো সুযোগ আর রইল না।
মনমোহন সিং আর শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের ইউসুফ রাজা গিলানি এবং আফগানিস্তানের হামিদ কারজাইয়ের একযোগে কাজ করা সবার স্বার্থেই দরকার। ভারত-পাকিস্তান বৈঠকের সময় পাকিস্তানি বক্তারা খোলাখুলিভাবে তাঁদের দেশে সন্ত্রাসবাদের বিপর্যয় নিয়ে কথা বলেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে শুরু করা দরকার। এর মানে এটা নয় যে, মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ীদের বিচার করার প্রচেষ্টায় ঢিলা দেবে ভারত। এর মানে হলো, নয়াদিল্লির শীতল আচরণ বদলে গেলে উভয় দেশ হয়তো আবার কাছাকাছি যেতে পারবে।
ভারতের সঙ্গে আলোচনায় ‘না’ বলার যে মনোভাব পাকিস্তানের দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির মেতে ওঠা উচিত নয় বা বলা উচিত নয় যে তাঁরা ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করবেন। তাঁর হয়তো রাজনৈতিকভাবে নিজেকে চাঙা করার দরকার রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ভাষা ব্যবহার তাঁকে আরও বেশি করে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বিরাট একটি ব্যাপার।
এটা খুবই অদ্ভুত যে পাকিস্তান বুঝতে পারছে না দিল্লিতে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বুঝলে, ভারতীয় সেনাপ্রধান দীপক কাপুরের উক্তিকে অত গুরুত্বের সঙ্গে নিত না। দীপক কাপুর বলেছিলেন, ভারতের হয়তো চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। এই উক্তি যতই দায়দায়িত্বহীন হোক, এর অর্থ পাকিস্তানের জন্য নতুন হুমকি নয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়াকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
জেনারেল কাপুর জেনারেল কায়ানি নন। দুটি দেশের শাসনব্যবস্থা আলাদা। জেনারেল কাপুরের ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কোনো কিছু বলার অধিকার নেই। তিনি অবসর নিতে যাচ্ছেন। শিগগিরই তাঁর উত্তরসূরির নাম ঘোষণা করবে ভারত।
উইয়ের ঢিবিকে পাহাড় হিসেবে দেখে ও দেখিয়ে পাকিস্তান হয়তো রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। এর ফলে আরও বেগবান হলো উভয় দেশের মধ্যকার অন্তহীন অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাসকে পারস্পরিক আস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে না পারলে পারস্পরিক দোষারোপ ও কাল্পনিক বিষয়ে মেতে ওঠা বন্ধ হবে না।
উপমহাদেশের সব কটি দেশ তাদের সামর্থ্য এক করলেই কেবল শান্তি নিশ্চিত হবে। এর জন্য কারও আত্মপরিচয় কিংবা সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের দরকার নেই। তাদের উচিত, সবার মঙ্গলের স্বার্থে অবিশ্বাসকে কমিয়ে আনা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক এবং সাবেক কূটনীতিক।

No comments

Powered by Blogger.