সহজিয়া কড়চা-সন্দেশ, ধনেখালি শাড়ি ও ডিমভরা ইলিশ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যত ঔত্সুক্য দেখিয়েছে, ভারতের সংবাদপত্র ততটা করেনি। যদিও ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে।


ব্যক্তি শেখ হাসিনার প্রতি সব সময়ই ভারতের শাসকশ্রেণী প্রীতিপ্রবণ—তা তিনি ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন। যেমন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিহত হলে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উভয়েই শোক প্রকাশের জন্য দিল্লি যান। ভারতের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন শেখ হাসিনাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। কোনো কোনো প্রধান কাগজে শুধু শেখ হাসিনার ছবিই প্রকাশিত হয়, বেগম জিয়ার নয়। কিন্তু যেহেতু এবার শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে গেলেন, তাই ভারত সরকারের কাছে তাঁর গুরুত্ব দ্বিগুণ। স্বাধীন পত্রপত্রিকা পরিচালিত হয় নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতিমালায়, সরকারের সেখানে কিছু করার নেই।
পার্শ্ববর্তী রাজ্য হওয়ায় এবং একই এথনিক বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের বাংলাদেশ প্রশ্নে ভূমিকা ভারতের অন্য অঞ্চলের কাগজের চেয়ে একটু ভিন্ন। আগ্রহ একটু বেশি। সেটাই হওয়া স্বাভাবিক। তবে আগ্রহ নেতিবাচক ব্যাপারেই বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মুখের ভাষার মতো ওখানকার বাংলা কাগজের ভাষাও আমাদের বাঙালিদের মতো নয়, অন্য রকম। মানসম্মত বাংলা বাক্য রচনার যে তিন শ্রেষ্ঠ আদর্শ—বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্র—আমাদের সামনে আছেন, তাঁদের রীতি থেকে আজ কলকাতার কাগজগুলোর সাংবাদিকেরা দূরে সরে গেছেন। তাঁরা প্রবর্তন করেছেন এক নতুন ভাষারীতি ও পরিভাষা। তাঁদের বিভাষা (Jargon) ও বাক্রীতি (idiom) অন্য রকম। বাক্য গঠনের ঢং আলাদা। বিষয়বস্তুতে তথ্য যতটুকু ভাবাবেগ, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
আনন্দবাজার পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা নয়াদিল্লি থেকে ১১ জানুয়ারি যে প্রতিবেদন পাঠান তা পরদিন পত্রিকার সাতের পাতায় প্রকাশিত হয়। আরম্ভটি এ রকম:
‘জলভরা তালশাঁস সন্দেশ এবং ধনেখালি শাড়ি আনিয়ে রাখা হয়েছে কলকাতা থেকে।
অন্য দিকে ঢাকা থেকে এসেছে ডিমভরা ইলিশ।
আগামিকাল সন্ধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শেখ হাসিনার একান্ত বৈঠক। সেখানেই দুই নেত্রী একে অপরের হাতে তুলে দেবেন উপহারগুলি।
কাল সন্ধ্যায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়িও যাবেন হাসিনা। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর হাসিনা যখন ভারতে কার্যত আত্মগোপন করে রয়েছেন, তখনই দুই পরিবারের সখ্য গাঢ় হয়। যা তিরিশ বছর পরেও অমলিন। প্রণববাবুর স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরের উষ্ণতা অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। অসুস্থ শরীরে যিনি অপেক্ষা করে রয়েছেন হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। বললেন, “ওকে তো হাসু বলে ডাকতাম। আর ও আমাকে বলত আপা। এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কী বলে ডাকব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।”
গীতাদেবী সিল্কের শাড়ি আনিয়ে রেখেছেন “হাসু”কে দেবেন বলে। স্মৃতি থেকে তুলে আনলেন বিভিন্ন মজার ঘটনা। “একবার আমরা অজমের শরিফ বেড়াতে গিয়েছি। এমনটা প্রায়ই যেতাম। এক রাতে আমরা দুজনে গল্প করব বলে এক ঘরে শুয়েছি। হঠাত্ মাঝরাতে দরজায় ধাক্কা। ওঁর স্বামী ওয়াজেদ মিঞা চিত্কার করছেন, দরজা বন্ধ করে কে ঘুমায়”?’
পরদিন ‘বর্তমান’-এর সবচেয়ে নিচের প্রতিবেদনটির শিরোনাম: ‘ভারত-বাংলাদেশ ভাইবোন’ বলে শুরুতেই হাসিনার মন জয় করলেন মমতা। সংবাদদাতা শুরু করেছেন এভাবে:
‘দুই দেশের সরকারি সূচিতে বৈঠকের নির্ধারিত সময় ছিল বিকাল সাড়ে ৫টা। কিন্তু এপার বাংলা-ওপার বাংলার হূদ্যতার আবেগ আবার প্রোটোকলের তোয়াক্কা করে নাকি! তাই দুই দেশের সরকারি অফিসার আর মন্ত্রীদের বিস্মিত করে ৪০ মিনিট আগেই মৌর্য শেরাটন হোটেলের চন্দ্রগুপ্ত স্যুইটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির হয়ে গেলেন। একটুও বিস্মিত হননি হাসিনা। যেন তৈরিই ছিলেন। সাড়ে ৫টার মিটিং শুরু হয়ে গেল ৫টাতেই।
গালভরা নাম একান্ত বৈঠক। শোনা যাচ্ছিল বাংলাদেশের একঝাঁক রেল প্রকল্প নিয়েই আলোচনা হবে। ফাইলপত্র, কূটনৈতিক নিয়মকানুনের নথি নিয়ে তৈরি ছিলেন দুই দেশের সরকারি প্রতিনিধিরাও। কোথায় কী? সেসব অ্যাজেন্ডা সবশেষে। কারণ মমতা শুরুতেই জানিয়ে দিলেন—ভারত আর বাংলাদেশ ভাইবোন।...মমতার তরফে পশ্চিমবঙ্গের তাঁতের শাড়ি, সন্দেশ পেয়ে উচ্ছ্বসিত হাসিনা শুরুতেই বললেন, এই কেজো বৈঠকে মন ভরবে না। ঢাকায় আসছেন কবে? মমতা সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে দিলেন। মমতাকে হাসিনা গতকালই পাঠিয়েছিলেন ইলিশ মাছ। আজ দিলেন নিজের লেখা সদ্য প্রকাশিত দুটি বই— শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র ১ ও ২। হাসিনার বোনের জন্যও শাড়ি এনেছেন মমতা। ...সম্প্রীতির সফরে হাসিনাকে আচ্ছন্ন করে রাখল বঙ্গ-আবেগ।’
১৩ জানুয়ারির টেলিগ্রাফ, হিন্দুস্তান টাইমস, আনন্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিন প্রভৃতি দৈনিকে হাসিনা-মমতার আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজারের পাঁচের পাতায় প্রতিবেদনের শিরোনাম এ রকম: বাঙালিয়ানার জয়গানে হাসিনা-মমতা একসুর। প্রতিবেদক আরম্ভ করেছেন এভাবে:
‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির কথা বলতে কার্পণ্য করেননি কেউই। মনমোহন সিহং [সিং] আর শেখ হাসিনার যৌথ সক্রিয়তায় দুদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর জমজমাট চিত্রনাট্য দেখেছে রাজধানী। কিন্তু তারই সঙ্গে সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে আরও একটি স্বর, যার কূটনৈতিক ক্যাপশন হতে পারে—‘জয় বাংলা’। সেখানে হাসিনার প্রধান জুটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে কূটনৈতিক যোগসূত্র বাড়ানোর পাশাপাশি আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গের আবেগের সঙ্গেও নিজের দেশকে মেলাতে চাইছেন নেত্রী। ঢাকা-দিল্লির পাশাপাশি তৈরি করতে চাইছেন ঢাকা-কলকাতার সমান্তরাল অক্ষ। বাংলায় বক্তৃতা, বাংলা বই আর মিষ্টান্নের উপহার আদান-প্রদান, নৈশভোজে বাঙালি লেখক-অভিনেত্রীদের উপস্থিতি, পদ্মার ইলিশের রূপোলি ইঙ্গিত—সব মিলিয়ে কলকাতার সঙ্গে বেশ পোক্ত সেতুই রচিত হলো এবারের হাসিনা-অধ্যায়ে।
এই দফায় পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া হলো না বটে হাসিনার। তার জন্য আফসোসও করলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নিজেই উঠে এল দিল্লির দরবারে। বক্তৃতা দিতে গিয়ে ইংরেজি থেকে বারবার বাংলায় ফিরলেন হাসিনা। আর শীর্ষ প্রতিনিধি স্তরের বৈঠকে মমতা বাংলায় বক্তৃতা শুরু করে শেষ করলেন ইংরেজিতে। সেই রেশ ধরেই আজ সন্ধেয় নিখাদ বাংলায় আড্ডা মারলেন দুই ‘পুরনো বন্ধু’।....
‘দীর্ঘদিনের সম্পর্ক হাসিনা-মততার। চোদ্দ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যখন প্রথম ভারত সফরে আসেন হাসিনা, তার আগেই এই সখ্যের শুরু। সেবার গঙ্গা-চুক্তির সময় উভয়ে অনেকটা কাছাকাছি এসেছিলেন। মধ্যরাতে গাড়ি পাঠিয়ে হাসিনার মমতাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে নিয়ে আসা, পরবর্তীকালে বিরোধী নেত্রী হিসাবে দিল্লি এসে মমতার সঙ্গে দেখা করার আকুলতা—(তখন এনডিএ জমানা, সুষমা স্বরাজের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়) এ সবই সেই সখ্যের অঙ্গ।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী নৈশভোজে হাসিনার বোন রেহানাকে প্রথমে চিনতে পারেননি মমতা। রেহানার চুলের ‘স্টাইল’ বদলে গিয়েছে। পরে চিনতে পেরেই আলিঙ্গন করলেন। হাসিনা-মমতার সঙ্গে আলাপচারিতার বৃত্তে থাকলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কঙ্কণা সেনশর্মা। নিখাদ বাঙালি আড্ডায় মাতলেন কজনে। রাহুল গাঁধীর সঙ্গে একটেবিলে খাওয়ার সময়েও হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ কথাবার্তা হলো রেলমন্ত্রীর। আজ হাসিনা, রেহানা এবং দীপু মনিকে শাল উপহার দিলেন মমতা। হাসিনার জন্য আলাদা করে শাড়িও। হাসিনার পাঠানো ইলিশের তারিফ করে তৃণমূল নেত্রী জানালেন, খুব আনন্দ করে মাছ খেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশের ইলিশ খুব ভালোবাসি আমরা। আরও ইলিশ এদেশে আসুক, এই তো চাই।’
‘বিকেলে মমতার সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় হাসিনা গেলেন আর এক পারিবারিক ‘বন্ধু’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। প্রণববাবুর গোটা পরিবার ফুল দিয়ে স্বাগত জানাল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। পরিবেশন করা হলো বাড়িতে তৈরি মাছের আর কিমার চপ, সঙ্গে রসগোল্লা। দিল্লিতে আত্মগোপন করে থাকার সময় প্রণববাবুর স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা ছিল হাসিনার। ডাকতেন ‘আপা’ বলে। আজ বহু বছর পর ‘আপা’র সঙ্গে আলাপে ফিরে আসছিল অতীতের হাসিকান্নার দিনগুলো। প্রায় আড়াই ঘণ্টা আড্ডা হলো। যোগ দিল প্রণববাবুর নাতিও।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কাগজগুলোর রিপোর্ট পড়ে মনে হবে, শেখ হাসিনা সেখানে সপরিবারে প্রমোদভ্রমণে গেছেন, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে নন। বিভিন্ন পত্রিকা তাঁর সফরের সংবাদ লিখতে গিয়ে তাঁর ‘নাড়ির টান’ কথাটি ব্যবহার করেছে। এ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ও ভাবার্থ আমার কাছে পরিষ্কার ঠেকেনি। যখন-তখন সব শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে নেই। তা ছাড়া ‘ভূগোলের তুচ্ছতা’, ‘ইলিশের রূপোলি ইঙ্গিত’, ‘ঢাকা-কলকাতা অক্ষ’, ‘নিখাদ বাঙালি আড্ডা’, ‘বঙ্গ-আবেগ’, ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিত্রনাট্য’ প্রভৃতি কথা সাবলীল সাংবাদিকতার পরিচয় দেয় না।
দুই দেশের নেতাদের মধ্যে আগের ঘনিষ্ঠ জানাশোনা, যোগাযোগ, বিশেষ করে দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের নীতি-আদর্শের অভিন্নতা ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক, যদি রাজনৈতিক আদর্শে মিল না থাকে তা হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। পদ্মার ইলিশ বা ঢাকাই জামদানি, এবং জলভরা নলেন গুড়ের সন্দেশ বা ধনেখালি শাড়ি বিনিময় ব্যক্তিগত হূদতার নিদর্শন। এসবের ভূমিকা কূটনীতিতে নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার আলাদা।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী তাঁদের দেশের অতি মিষ্টি আম ইত্যাদি মাঝেমধ্যে বিনিময় করেছেন। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে মিষ্টতা আসেনি, অর্থাত্ তার কোনো প্রভাব ছিল না। ১৯৭৫-এর শেষের দিকে জিয়াউর রহমান বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং পররাষ্ট্রসচিব তবারক হোসেনকে তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের হাতে তিনি শ্রীমতী গান্ধীর জন্য উপহার হিসেবে দেন এক কৌটা পিঙ্ক পার্ল বা গোলাপি মুক্তা। তাঁদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুবই রাগতভাবে বলেন, আপনারা আপনাদের রাষ্ট্রের ফাউন্ডারকে হত্যা করেছেন—। কথাবার্তা বলে বেরিয়ে আসার সময় মিসেস গান্ধী মুক্তার জন্য ধন্যবাদ জানান। জিয়ার সময়টিতেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে শীতল সম্পর্ক ছিল। দ্বিপক্ষীয় বৈদেশিক সম্পর্কের রাজনীতি তার নিজস্ব পথেই চলে। তা নির্ধারিত হয় দুই দেশের বৈদেশিক নীতির দ্বারা, পরিচালিত করেন কূটনীতিক ও কর্মকর্তারা। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করেন দেশের নেতারা।
দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতাদের মতোই মিডিয়ার ভূমিকা খুব বড়। শেখ হাসিনার সফর নিয়ে ভারতের বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি কাগজ ইতিবাচক সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাঁর সফরের কয়েক দিন আগে এমন কিছু খবর প্রকাশ করেছে, যা সুখপ্রদ নয়। সবচেয়ে বড় করে সব কাগজে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে তা হলো পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে অনুপ চেটিয়ার ঢাকার কথিত বৈঠক। তথ্যটি ফাঁস করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সফরের কয়েক দিন আগে। তাতে ভারতের জনমত গঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সফর যেদিন শুরু হয় সেদিনই টাইমস অব ইন্ডিয়া আরেকটি নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে। আসাম রাইফেল্স-এর ডিজি লে. জেনারেল এস কে যাদবের বরাত দিয়ে বলা হয়— around 50% of the lower cadre of ULFA is from Bangladesh. খবরটি উদ্বেগজনক। আর একটি সংবাদও ছিল নেতিবাচক। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে পুরুলিয়ায় যে অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় তা কেনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অফিসের এক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। হিন্দুস্তান টাইমস-এর বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়: এসব খবর পড়ে ভারতের মানুষ বাংলাদেশকে বন্ধু মনে করতে পারে না।
উলফার অর্ধেক সদস্য যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকে, তা হলে তারা কারা? বাংলাদেশের চাষাভূষা, রাখাল বালক উলফায় নাম লেখাতে পারবে না। ইচ্ছা থাকলেও পারবে না এই জন্য যে তাদের ভাষা ও চেহারা বড় বাধা। যদি সত্যি গিয়ে কেউ নাম লেখায় তা হলে তারা সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবাঙালি আদিবাসী ও পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী। কিন্তু সত্যি কি তারা যায়?
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী সমর্থক লেখক-সাংবাদিকেরা দাবি করছেন প্রধানমন্ত্রীর ‘ভারত সফর শতভাগ সফল’। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, শতভাগ ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় যদি এমন চুক্তি হতো যে ভারত বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু দুটি করে রসগোল্লা, আড়াই শ গ্রাম পাঁঠার মাংস এবং ৫০০ গ্রাম চিকন চাল সরবরাহ করবে আগামী ২৫ বছর; তা হলেও পরদিন খোন্দকার দেলোয়ার হাহাকার করে উঠতেন: এবার বাংলাদেশের মানুষকে ডায়াবেটিসে ও হূদরোগে মারবার চক্রান্ত করছে ভারত সরকার। খোন্দকার সাহেব টিভি চ্যানেলের ডান্ডার কাছে মুখ নিয়ে বলতেন ডায়াবেটিস-হূদরোগ কী তা আমি জানি। বাংলাদেশের সবার সিঙ্গাপুরের চিকিত্সা নিতে যাওয়ার শক্তি নেই। ভারতের মিষ্টি ও মাংস খেয়ে মরতে মরতে আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশ জনশূন্য হয়ে যাবে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, ‘যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছি, শতভাগ সফল হয়েছি। দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছি। কাজেই জয়ী আমি আজ।’ নিজের জয়ের কথা ও সাফল্যের কথা নিজের মুখে বলতে নেই। তা ছাড়া সবচেয়ে যুক্তিবাদী ও বাস্তববাদী বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে সর্বদা সাক্ষী মানাও ঠিক নয়। যাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিতে তাঁকে উত্সাহিত করেছেন, তাঁরা সঠিক কাজ করেননি। দুর্যোধনের জবানীতে প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন: সুখ চাহি নাই মহারাজ—
জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,
সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত,
অদ্য আমি জয়ী।
রাষ্ট্র এক ভয়ংকর ও জটিলতম খেলা। বাঙালি বহুকাল রাষ্ট্র চালায়নি। নিজ বাসভূমে সে ছিল পরবাসী। যারা রাষ্ট্র চালায়নি, তাদের আবার পররাষ্ট্রনীতি কী? এখন যখন রাষ্ট্র হয়েছে, তখন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা থাকলেও কোনো সময়ই বৈরিতা ছিল না। এখন শেখ হাসিনার সময় একটি চমত্কার সুযোগ এসেছে দুই দেশের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় করার। তা শুধু ইলিশ মাছ ও ধনেখালি শাড়ি বিনিময়ের মাধ্যমে হবে না। তার জন্য দুই দেশের নেতাদের বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোতে হবে। যেকোনো ধরনের চাঞ্চল্য ও ভাবাবেগ সমস্ত সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করে দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রমুখের আচরণ ছিল সংযত, সংহত ও আন্তরিক। সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এবং ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে দেখেছি, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে তাঁদের আগ্রহও আন্তরিক। সব দেশের সরকারের একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আর একটি কূটনৈতিক কৌশল। জনগণের ইচ্ছাই প্রধান।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, জনগণ আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খুব জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে কয়েকটি বিষয়, যেমন—নদীর পানিবণ্টন, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, তালপট্টি, ছিটমহলের মানুষের দুর্দশা, সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন বিএসএফ কর্তৃক গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা প্রভৃতি। শীর্ষপর্যায়ে আলোচনা হলে কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তবু এ সফরের মাধ্যমে সূচনা ভালোই হয়েছে, দুই দেশের মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.