সাহসের সমাচারঃ শুধু প্রশ্নটা থাকবে by আল মাহমুদ
শারীরিক অক্ষমতা আমাকে একটু একটু করে দখলে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জীবনানন্দ দাশ স্থবিরতা কামনা করেছিলেন। আমি অবশ্য কোনোরূপ স্থবিরতার কথা বিবেচনা করি না। স্থবির হবে কেন? বেঁচে আছি যখন, তখন তো সর্বত্রই পদচারণা করতে হবে।
আমি হাঁটি। হাঁটতে চাই। আর হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই। পেছনে কী রেখে এলাম তা আমার মনে থাকে না। আর সামনে কী আছে সেটাও আমি জানি না। আমি হাঁটতে শিখেছি যখন থেকে তারপর আর বিশ্রাম নেইনি। হাঁটছি আর ভাবছি যে আমার গন্তব্য যেহেতু কেউ স্থিরিকৃত করে দেননি সেজন্য হাঁটাটাই স্বাধীনতার লক্ষণ। আমি হাঁটি কিন্তু কাউকে খাটাই না। এভাবেই আমি আমার একটা জগত্ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। মনে হয় আমার আয়ুষ্কালই আমার একমাত্র বিচরণক্ষেত্র।
কেবল পার হয়ে যাওয়া। পেছনে দেখার কিছু নেই এবং সামনে কী আছে সেটা জানার আগ্রহও খুব একটা অনুভব করি না। আমাকে নিয়ে কারও ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে সব সময় ঈর্ষাকাতর একটি মানুষের বলয় আমাকে ঘিরে আছে। আমি যেহেতু মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে অভ্যস্ত নই, সম্ভবত সে কারণে আমার পক্ষ থেকেও কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। আমি আছি আমার মতো। মাঝে মাঝে ফিসফিস করে কথাও বলি।
আমার ঘরের লোকেরা ভাবে আমার বোধ হয় কোথাও গরবর হয়েছে। কিন্তু কেউ জিজ্ঞাসা করে না। এভাবেই আমি নিঃশব্দে কত দুয়ার যে পার হয়ে গেছি কে জানে। আমি এমনিতে বলি আমার কেউ নেই। কিন্তু কোনোকালে কি ছিল? মনে হয় সব সময় আমি এরকমই ছিলাম। দুঃখী ছিলাম। দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও দুর্বিপাকে আচ্ছন্ন ছিলাম। আমাকে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা সাক্ষাত্ করতে এলে প্রশ্ন করে, আমি কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছিলাম কিনা। আমি মাথা নিচু করে হাসি। আসলে তো এই প্রশ্নের জবাব আমারও জানা নেই।
যেখানে পৌঁছতে চাই সেখানে পৌঁছার অভিজ্ঞতা অন্য কারও নেই। যারা আমার আগে চলে গেছেন তারা আর কেউ ফেরেননি। তাদের অভিজ্ঞতা না জানলে কী করে কাজে লাগানো যায়? তবুও আমি আন্দাজে স্বপ্নে এবং সকালে ঘুম ভেঙেই যা চেয়েছি তা হলো খাদ্য। একটা জিনিস আমার অনেক আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সেটা হলো খাদ্যের উপযোগিতা। অন্নজলের শক্তিসামর্থ্য। আমি অনেক জিনিস জানি না। জানতে হলে খেয়ে দেখতে হয়। কিন্তু আমার রুচি আমাকে যত্রতত্র বাসন নিয়ে বসে পড়তে দেয়নি। আমি বসেছিলাম পঙিক্ততেই। কিন্তু আমার পাতে কেউ কিছু দেয়নি। বাসন বাজিয়ে দেখেছি। বাসন বাজালেই কে যেন বলে উঠেছে, ‘সবুর’। আরে আমি তো সবুর থাকতে রাজি আছি। কিন্তু তোমাদের যে ভাণ্ডারে টান পড়ে গেছে সেটা তো দেখতে পাচ্ছি। সবুর থাকতে থাকতে শূন্যপাতে এখন উঠে যাওয়ায় সময়। আর কত সবুর মানব। এক সময় ক্ষুত্কাতর অবস্থায় উঠেপড়ে হাঁটতে শুরু করেছি। কিছু খাইনি। পান করিনি। কোথায় যাব? কেউ আমাকে হাত ধরে বলেনি আসুন। বরং আমার হাত থেকে আমার মতন ক্ষুধার্তরা বাসন নিয়ে গেছে। বলেছে, আপনি তো চলে যাচ্ছেন। দিন আমাকে। আমি দিয়ে দিয়েছি। মুখ তুলে দেখেছি, অন্য কোনো লোক নয় আমি নিজেই প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাসুন আমারই হাতে। আবার আমার বাসন অন্যের হাতে। আমি তা দেখে এই ভোজের আয়োজক কে তা জানতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছি। কিন্তু যার দিকেই এগিয়েছি তার চেহারা আমারই মতো, আমিই।
আমিই যখন ভোজের আগে এবং ভোজের পরেও ক্ষুধার্ত আছি তখন এই অফুরন্ত অনির্বান ক্ষুধার জগত্ সম্পর্কে আমি নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি? আমি সব ভোজসভার আগে এবং সব ভোজের পরে এক ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত অভুক্ত প্রাণ। কে আমাকে খেতে দেবে। তবুও আমি ক্ষুিপপাসার রহস্য জানতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে যাব। আমি খাব না এবং পাব না জেনেই এই ভোজের আয়োজনে শামিল হয়েছিলাম।
আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথার কেউ আছে কি? কেন যেন মনে হয় কেউ আছে। আমার জন্যই আছে। আমার জন্যই ঝরে যাচ্ছে অন্নজল। আমি ক্ষুিপপাসার রহস্য ভেদ করে এক অভুক্ত আত্মা। খেতে চাই। তারও চেয়ে বেশি পেতে চাই। আমার জন্য কেউ কাঁদে না, কেউ রাঁধে না। দু’বাহুতে বাঁধেও না। আমার পরিণাম আমি নিজেই। সব প্রশ্নের জবাব কেউ জানে না। কেউ কোনোদিন জানবে না। শুধু প্রশ্নটা থাকবে।
লেখক : কবি
কেবল পার হয়ে যাওয়া। পেছনে দেখার কিছু নেই এবং সামনে কী আছে সেটা জানার আগ্রহও খুব একটা অনুভব করি না। আমাকে নিয়ে কারও ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে সব সময় ঈর্ষাকাতর একটি মানুষের বলয় আমাকে ঘিরে আছে। আমি যেহেতু মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে অভ্যস্ত নই, সম্ভবত সে কারণে আমার পক্ষ থেকেও কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। আমি আছি আমার মতো। মাঝে মাঝে ফিসফিস করে কথাও বলি।
আমার ঘরের লোকেরা ভাবে আমার বোধ হয় কোথাও গরবর হয়েছে। কিন্তু কেউ জিজ্ঞাসা করে না। এভাবেই আমি নিঃশব্দে কত দুয়ার যে পার হয়ে গেছি কে জানে। আমি এমনিতে বলি আমার কেউ নেই। কিন্তু কোনোকালে কি ছিল? মনে হয় সব সময় আমি এরকমই ছিলাম। দুঃখী ছিলাম। দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও দুর্বিপাকে আচ্ছন্ন ছিলাম। আমাকে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা সাক্ষাত্ করতে এলে প্রশ্ন করে, আমি কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছিলাম কিনা। আমি মাথা নিচু করে হাসি। আসলে তো এই প্রশ্নের জবাব আমারও জানা নেই।
যেখানে পৌঁছতে চাই সেখানে পৌঁছার অভিজ্ঞতা অন্য কারও নেই। যারা আমার আগে চলে গেছেন তারা আর কেউ ফেরেননি। তাদের অভিজ্ঞতা না জানলে কী করে কাজে লাগানো যায়? তবুও আমি আন্দাজে স্বপ্নে এবং সকালে ঘুম ভেঙেই যা চেয়েছি তা হলো খাদ্য। একটা জিনিস আমার অনেক আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সেটা হলো খাদ্যের উপযোগিতা। অন্নজলের শক্তিসামর্থ্য। আমি অনেক জিনিস জানি না। জানতে হলে খেয়ে দেখতে হয়। কিন্তু আমার রুচি আমাকে যত্রতত্র বাসন নিয়ে বসে পড়তে দেয়নি। আমি বসেছিলাম পঙিক্ততেই। কিন্তু আমার পাতে কেউ কিছু দেয়নি। বাসন বাজিয়ে দেখেছি। বাসন বাজালেই কে যেন বলে উঠেছে, ‘সবুর’। আরে আমি তো সবুর থাকতে রাজি আছি। কিন্তু তোমাদের যে ভাণ্ডারে টান পড়ে গেছে সেটা তো দেখতে পাচ্ছি। সবুর থাকতে থাকতে শূন্যপাতে এখন উঠে যাওয়ায় সময়। আর কত সবুর মানব। এক সময় ক্ষুত্কাতর অবস্থায় উঠেপড়ে হাঁটতে শুরু করেছি। কিছু খাইনি। পান করিনি। কোথায় যাব? কেউ আমাকে হাত ধরে বলেনি আসুন। বরং আমার হাত থেকে আমার মতন ক্ষুধার্তরা বাসন নিয়ে গেছে। বলেছে, আপনি তো চলে যাচ্ছেন। দিন আমাকে। আমি দিয়ে দিয়েছি। মুখ তুলে দেখেছি, অন্য কোনো লোক নয় আমি নিজেই প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাসুন আমারই হাতে। আবার আমার বাসন অন্যের হাতে। আমি তা দেখে এই ভোজের আয়োজক কে তা জানতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছি। কিন্তু যার দিকেই এগিয়েছি তার চেহারা আমারই মতো, আমিই।
আমিই যখন ভোজের আগে এবং ভোজের পরেও ক্ষুধার্ত আছি তখন এই অফুরন্ত অনির্বান ক্ষুধার জগত্ সম্পর্কে আমি নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি? আমি সব ভোজসভার আগে এবং সব ভোজের পরে এক ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত অভুক্ত প্রাণ। কে আমাকে খেতে দেবে। তবুও আমি ক্ষুিপপাসার রহস্য জানতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে যাব। আমি খাব না এবং পাব না জেনেই এই ভোজের আয়োজনে শামিল হয়েছিলাম।
আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথার কেউ আছে কি? কেন যেন মনে হয় কেউ আছে। আমার জন্যই আছে। আমার জন্যই ঝরে যাচ্ছে অন্নজল। আমি ক্ষুিপপাসার রহস্য ভেদ করে এক অভুক্ত আত্মা। খেতে চাই। তারও চেয়ে বেশি পেতে চাই। আমার জন্য কেউ কাঁদে না, কেউ রাঁধে না। দু’বাহুতে বাঁধেও না। আমার পরিণাম আমি নিজেই। সব প্রশ্নের জবাব কেউ জানে না। কেউ কোনোদিন জানবে না। শুধু প্রশ্নটা থাকবে।
লেখক : কবি
No comments