বাঙালিয়ানা by ফাহমিদ উর রহমান
কলকাতার মীর্জা গালিব স্ট্রিটে বসে সেখানকার বিখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজারের পাতা উল্টাচ্ছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তখন দিল্লিতে। তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সাক্ষাতের সূত্রে আনন্দবাজার সেদিন শিরোনাম করেছে ‘বাঙালিয়ানা বেশ জমে উঠেছে।’
আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতাকে আশ্বাস দিলেন—পশ্চিমবঙ্গ আরও বেশি পদ্মার ইলিশ পাবে। মমতার তরফ থেকে তাকে দেয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের তাঁতের শাড়ি ও সন্দেশ। উভয়ের সাক্ষাতের আবহটায় নাকি বঙ্গ আবেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। উভয় নেত্রী সেদিন মনে করলেন দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত একই কবির লেখা।
আনন্দবাজার পত্রিকার ঐতিহ্য বহুদিনের। চিন্তা-ভাবনার দিক দিয়ে এটি কংগ্রেসের সমর্থক। এর স্বত্বাধিকারী তুষার কান্তি ঘোষ ছিলেন এক সময়ের কংগ্রেসের মন্ত্রী। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের সমর্থক হিসেবে এ পত্রিকাটির অবদানও সমধিক। শুধু তাই নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি বাবুদের শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে পত্রিকাটির অবদান অনেক। এর সহযোগী প্রকাশনা হচ্ছে সাপ্তাহিক দেশ এবং প্রকাশনা সংস্থার নাম হচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঘা বাঘা শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে।
পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি আর ভাবছি আনন্দবাজার যে রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা বলে তার ভেতরে বাঙালিয়ানার স্থান কতটুকু? এখনও আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় কলামের উপরে ছোট করে লেখা থাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘বন্দে মাতরম’। ভারতীয় জাতীয়তাবাদভিত্তিক কংগ্রেসী রাজনীতির ধারা থেকে সরে এসে বাংলা ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র রাজনীতির কথা আনন্দবাজারে কখনও বলেনি। বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার নিয়ে এবং দেশ ও ভাষাভিত্তিক হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এখনও তাদের শিরায় বইছে একদিকে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-সুরেন্দ্রনাথ অন্যদিকে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলের স্বপ্নে দেখা ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের রক্তধারা। তাহলে এই বাঙালিয়ানার গল্প কেন?
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশও অনেক সময় হাজার বছরের বাঙালি বলে একটা আবেগ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ইতিহাসের ধারায় বাঙালির জাতীয় চেতনা ও জাতীয় কৃষ্টির ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে কখনোই সংহত ও নির্দিষ্ট রূপ লাভ করেনি। ইতিহাসের যাত্রাপথে বাঙালি কখনোই পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ ধরনের ইউরোপীয় কায়দায় জাতীয় ঐক্য সাধনের বিপক্ষে এখানে ধর্ম ও জাতি বর্ণব্যবস্থা একটা বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে।
উনিশ শতকে ইউরোপীয় বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাবে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল, তা কিন্তু ওই হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তার পরিচয়েই গড়ে উঠেছিল। সেখানে ভারতের প্রকৃত ও দেশভিত্তিক জাতিগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। ভারতের হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস এ ধরনের জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালি তাই নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিয়েছে। হিন্দু ভারতীয় ও মুসলিম ভারতীয়। আবার ওই সময়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটেছিল তার হিন্দু পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। যার ফলে ধর্মনির্বিশেষে এটি সব বাঙালিকে মেলাতে পারেনি। এ কারণে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ একদিকে ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দুটোই প্রচার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভারত ভাগ্যবিধাতা নামক জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। আবার আমার সোনার বাংলা গানটিও বঙ্গভঙ্গের সময় লিখেছেন। তাদের বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্বের ধারণার মধ্যে কোনো তফাত্ ছিল না। এ কারণেই বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভক্তি রোধ করা যায়নি। মনে রাখা দরকার—এই একই চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার কারণে ভারতীয় জাতীয়তার বাইরে রবীন্দ্রনাথের মতো কবিও বাঙালির নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক রাষ্ট্রের কথা ভাবতে পারেননি। এ কারণেই তিনি মহাত্মা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ, রবিশঙ্কর, সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, জ্যোতিবসু, সৌরভ গাঙ্গুলি প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য কবি, শিল্পী, কলাবিদ, রাজনীতিক, ক্রীড়াবিদ ও আরও অনেকে পৃথিবীব্যাপী খ্যাত হয়েছেন ভারতীয় পরিচয়ে, বাঙালি হিসেবে নয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের মৃত্যুর পর আমাদের এখানকার বাঙালিবাদী সংস্কৃতিকর্মীরা বঙ্গ আবেগে আপ্লুত হয়ে তাকে হাজার বছরের অন্যতম সেরা বাঙালি হিসেবে সম্মানিত করেন এবং নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সত্যজিত রায় এ ধরনের পরিচয়ে গৌরব বোধ করতেন কি না তা জানার প্রয়োজন আমরা কখনও মনে করিনি। সত্যজিত রায়কে যখন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোঁয়া মিতেরা কলকাতায় এসে স্বহস্তে তার দেশের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তুলে দেন। রায় মশায় তখন সেই সংশয়কে এক ঘায়ে শেষ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, আমি তো বাঙালি-টাঙ্গালি নই। আমি গর্বিত ইন্ডিয়ান। সত্যজিতের এই আত্ম অন্বেষাকে আমাদের এখানকার বঙ্গ আবেগে নিমজ্জমান সংস্কৃতিকর্মীরা কীভাবে দেখবেন জানি না।
আসলে বাঙালিয়ানা যে একটা বড় ধরনের মিথ, ইতিহাসের সঙ্গে যার সম্বন্ধ একবারে নেই বললেই চলে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মিথটি তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগ্রহপুষ্ট বাঙালি বাবুদের হাতে। ইংরেজ শাসিত বাংলায় ওরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও শাসন ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল। বাংলা তথা ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকে পাকাপোক্ত করতে ওদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ইংরেজের সহযোগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার জন্য বাঙালিয়ানা তত্ত্বের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেই মতো করে তারা সেই তত্ত্বকে ফেরি করেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গবাসী যুক্তবঙ্গ থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিনের বাংলার হিন্দু নেতারা যৌথভাবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ভোট দিয়ে বাংলা ভাগের পক্ষে মত দেন। তখনকার পশ্চিমবঙ্গবাসী মনে করেছিল ওদের ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচিতি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার কাছে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে ১৯৩৬ ও ১৯৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে যখন এটা প্রমাণ হয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মুসলমানরাই বাংলায় ভবিষ্যত্ শাসক হিসেবে বহাল থাকবে। তারা তখন ভাবেনি গণতন্ত্র একদিন তাদের আধিপত্যের অবসান ঘটাবে। তাই তাদের দাবির ফলেই বাংলা ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে যায়। বাংলাকে এক রাখার চেষ্টা হয়েছিল বসু-সোহরাওয়ার্দী ফর্মুলার মাধ্যমে। কিন্তু খোদ গান্ধী-নেহরু এতে রাজি হননি, মুসলিম সংখ্যাগুরু অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুর স্বার্থরক্ষা হবে না এ যুক্তিতে। অথচ হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলেও তখনকার প্রেক্ষাপটে সবক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল। তা সত্ত্বেও গান্ধী-নেহরু সেদিন মুসলমানদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাহলে সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে জিন্নাহ সাহেবকে দোষ দেয়া কেন?
এর আগে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রচেষ্টা ওই পশ্চিমবঙ্গবাসীই প্রতিরোধ করেছিল, কারণ তখনকার প্রেক্ষাপট ওদের অনুকূলে ছিল। বাঙালিয়ানা তাই তার ভেতরকার বাবুয়ানাকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। বাঙালিয়ানার এই ফাঁকটুকু না ধরতে পারলে কৃষি পটভূমি থেকে উঠে আসা পূর্ববাংলার মানুষের কোনো মুক্তি নেই।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুর পক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবল আদর্শ অস্বীকার করে পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানকে স্বজাতিভুক্ত বলে মেনে নেয়া এবং বাঙালির জাতীয় ঐক্যের পক্ষে কাজ করা আজ তাই এক অসম্ভব ব্যাপার। সে অবস্থায় দিল্লির সঙ্গে বাঙালির বিরোধ অনিবার্য। এরকম চিন্তা আশ্চার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিত রায়, অন্নদা শংকর রায় কেউই করতে পারেননি।
ভারতকে বাদ দিয়ে বাঙ্গালির স্বাতন্ত্র্য চিন্তার কথা তারা কখনও মাথায় আনেননি। দেশ ভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেমন ভারতের অংশে পরিণত হয়, তেমনি মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সেই সময় মনে করা হয়েছিল সব রকমের সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বৃহত্তর ভারত সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারলেও পূর্ববঙ্গের ভাগ্য ঠিক একরকম হলো না। পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে যদিও তারা ধর্মীয়ভাবে নাজেহাল হওয়া থেকে রক্ষা পেল, কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের আধিপত্যের শিকার হলো। সেই আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য পূর্ব বাংলার মানুষকে আবার লড়াই করে বাংলাদেশ কায়েম করতে হলো। আমরা দুবার বিভক্ত হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করেছি। একবার এক ভাষা চর্চাকারী পশ্চিমবঙ্গ থেকে। দ্বিতীয়বার এক ধর্মে বিশ্বাসী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তাই পূর্ববঙ্গের মানুষের জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবোধ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের থেকে পৃথক। পূর্ববঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিবর্তন হয়েছে একভাবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সেই বিবর্তন হয়েছে অন্যভাবে। পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। পূর্ববঙ্গের মানুষ ধর্ম, ভাষা ও কালচার প্রত্যেকটিকে আত্মস্থ করে এক নতুন জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে অখণ্ড ভারত চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিয়ানার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষের বাঙালিয়ানার চরিত্রকে ঠিক মেলানো সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অনুভূতির এই যে স্বাতন্ত্র্যবোধ তারই নাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এটা সত্য পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষ একই বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাত-মাছ-আলু ভর্তা, শুঁটকি মাছ খায় এবং রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত শোনে। কিন্তু তা দিয়ে তো একটা রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে না। স্বভাষী ও স্বধর্মী হয়েও ব্রিটেন ও আমেরিকা পৃথক হয়ে গেছে। আটলান্টিকের দুই পাড়ের মানুষ ভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতীয়তার পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে। এর মূলে আছে তাদের পৃথক থাকবার চেতনা। ইউরোপে ও আরবে একই ধর্ম, ভাষা ও কালচার অনুসারীরা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতিতে সগৌরবে পরিচিতি বহন করে চলেছে। বাংলাদেশও এরকম একটা রাষ্ট্র।
একটা কথা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ তাই যেমন ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, তেমনি ভাষাকেও বাদ দিয়ে নয়। দুটোই আমাদের প্রয়োজন। দুটোর সমাহারে আমাদের আত্মপরিচয়।
এখানে একদল বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের কাছে বাঙালিয়ানার অর্থ হচ্ছে ইসলাম বর্জন। মুসলিম ভাবধারা ত্যাগ করে বাঙালিত্বের নামে প্রচলিত হিন্দুয়ানি গ্রহণ। অথবা সেই উনিশ শতকীয় কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু সংস্কৃতিকে নির্বিচারে আলিঙ্গন। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হচ্ছে ঔপনিবেশিক কালের মতো পূর্ববঙ্গকে আবার কলকাতার সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিণত করা। এটা কি আদৌ সম্ভব? আমরা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছি বলে যদি কেউ ভেবে থাকেন যে আমরা মুসলমানিত্বও জলাঞ্জলি দেব, সেটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা।
এসব বুদ্ধিজীবীর অনেকেই আছেন জীবন বাঁচানোর জন্য ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এমনকি এদের অনেকেরই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি পরিচয়ও সেদিন তাদের রক্ষা করতে পারেনি। আতঙ্কের ঠেলায় এরা পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করেন। আজকের এই বাংলাদেশে ওই পালিয়ে আসা ব্যক্তিরাই বড় বড় বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে আমাদের উপদেশ দেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কেরানিগিরি কিংবা নিদেনপক্ষে বড় বাবু হওয়া ছাড়া আর কিছু আশা করতে পারতেন না, যদি না তখন আমরা পৃথক হয়ে যেতাম। আজকের পশ্চিমবাংলার এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই অবস্থাটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
বাঙালি ঐতিহ্যের ধুয়া তুলে এরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভুলিয়ে দিতে চান। এরাই আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিকে মৌলবাদ বলে প্রচার করেন। এদের কাছে তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহ মৌলবাদী, ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনরা প্রগতিশীল। প্রগতি ও মৌলবাদের এই বিচিত্র ব্যাখ্যা আমাদের এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক দাসত্বের নমুনা ছাড়া আর কিছু নয়।
এসব সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা হীনম্মন্যতার সপ্তম স্বর্গে বাস করেন এবং ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে নিজস্ব ঐতিহ্য ও অতীতকে অস্বীকার করেন। এসব কক্ষচ্যুত সংস্কৃতিকর্মীরা কেউ কেউ মুসলিম নিয়মে সম্ভাষণ, নামকরণ, অনুষ্ঠানের সূচনা এবং পোশাকসহ যা কিছু আমাদের বৈশিষ্ট্য সব কিছু পরিত্যাগ করার কথা বলেন। এই পরিত্যাগের মধ্যে আছে আমাদের আত্মপরিচয় ডুবিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত।
যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও তত্পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির পরিচয়ভিত্তিক সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এগুলোকে ইসলাম থেকে সরে আসার ক্রান্তিকাল হিসেবে বর্ণনা করতে চান, তারা কখনও বলতে পারেননি ওই ধরনের আন্দোলন কেন পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠেনি। সেক্যুলার ও দেশভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলে তা কখনও তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অর্জনের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। বরং বাংলা ও বাঙালির বিভক্তির অবসানও ওই জাতীয়তাবাদের প্রধান দাবি হয়ে উঠত। তাই এটাকে বলা চলে বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদ, যার প্রধান উপাদান হচ্ছে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ।
ঔপনিবেশিক আমলে দীর্ঘ ২০০ বছর আমাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব ভাষা, কালচার, ধর্মকে কেউ মিশিয়ে দিতে পারেনি। ইসলাম ধর্ম থেকে প্রেরণা পেয়েই তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, ফকীর ও ওহাবী বিদ্রোহের নায়করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সেই সংগ্রামে পূর্ব-বাংলার মানুষই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিম বাংলার বাবুরা তখন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক শক্তি হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার পূর্ব-বাংলাতেই হয়েছে ভাষা আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভাষার জন্য রক্ত ঢেলে দেয়নি। তারা মেনে নিয়েছে অখণ্ড ভারততত্ত্বের আড়ালে হিন্দি ও মাড়োয়ারি আধিপত্য। কলকাতার কথ্য বাংলাকেও বলা যায় না এখন শুদ্ধ বাংলা। সেখানকার ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াসহ কথ্য বাংলায় যা বলা হয় তা হচ্ছে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজির অদ্ভুত খিচুড়ি। বাংলার চেয়ে হিন্দি ও ইংরেজিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, কারণ উঠতি প্রজন্মের ক্যারিয়ার নির্মাণে ঐ ভাষার গুরুত্বই এখন বেশি। বাংলার ব্যবহারিক মূল্য সেখানে তলানীতে এসে ঠেকেছে। বাঙালি শিল্পীরাও হিন্দিকে অগ্রাধিকার দেন এ কারণে যাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যায়। সুতরাং বাংলা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেয়ার ভার এসে পড়েছে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর।
তাই বাঙ্গালিত্ব যেমন আমাদের নিজস্ব জিনিস তেমনি মুসলমানিত্ব আমাদের ঐতিহ্য ও রক্তধারার সঙ্গে মিশে আছে। কোনো কিছুর বাড়াবাড়িকেই বলা যায় মৌলবাদ, তা সে ধর্মের রূপে হোক কিংবা ভাষা ও সংস্কৃতির আড়ালে হোক। আমরা যা আছি তাই থাকব। আমরা এগুতে চাই সামনের দিকে, দৃষ্টি আমাদের পেছনে নয়। বাঙালিয়ানার নামে বাবু মৌলবাদ তাই আমাদের কাম্য নয়।
আনন্দবাজার পত্রিকার ঐতিহ্য বহুদিনের। চিন্তা-ভাবনার দিক দিয়ে এটি কংগ্রেসের সমর্থক। এর স্বত্বাধিকারী তুষার কান্তি ঘোষ ছিলেন এক সময়ের কংগ্রেসের মন্ত্রী। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের সমর্থক হিসেবে এ পত্রিকাটির অবদানও সমধিক। শুধু তাই নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি বাবুদের শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে পত্রিকাটির অবদান অনেক। এর সহযোগী প্রকাশনা হচ্ছে সাপ্তাহিক দেশ এবং প্রকাশনা সংস্থার নাম হচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঘা বাঘা শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে।
পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি আর ভাবছি আনন্দবাজার যে রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা বলে তার ভেতরে বাঙালিয়ানার স্থান কতটুকু? এখনও আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় কলামের উপরে ছোট করে লেখা থাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘বন্দে মাতরম’। ভারতীয় জাতীয়তাবাদভিত্তিক কংগ্রেসী রাজনীতির ধারা থেকে সরে এসে বাংলা ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র রাজনীতির কথা আনন্দবাজারে কখনও বলেনি। বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার নিয়ে এবং দেশ ও ভাষাভিত্তিক হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এখনও তাদের শিরায় বইছে একদিকে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-সুরেন্দ্রনাথ অন্যদিকে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলের স্বপ্নে দেখা ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের রক্তধারা। তাহলে এই বাঙালিয়ানার গল্প কেন?
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশও অনেক সময় হাজার বছরের বাঙালি বলে একটা আবেগ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ইতিহাসের ধারায় বাঙালির জাতীয় চেতনা ও জাতীয় কৃষ্টির ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে কখনোই সংহত ও নির্দিষ্ট রূপ লাভ করেনি। ইতিহাসের যাত্রাপথে বাঙালি কখনোই পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ ধরনের ইউরোপীয় কায়দায় জাতীয় ঐক্য সাধনের বিপক্ষে এখানে ধর্ম ও জাতি বর্ণব্যবস্থা একটা বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে।
উনিশ শতকে ইউরোপীয় বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাবে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল, তা কিন্তু ওই হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তার পরিচয়েই গড়ে উঠেছিল। সেখানে ভারতের প্রকৃত ও দেশভিত্তিক জাতিগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। ভারতের হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস এ ধরনের জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালি তাই নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিয়েছে। হিন্দু ভারতীয় ও মুসলিম ভারতীয়। আবার ওই সময়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটেছিল তার হিন্দু পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। যার ফলে ধর্মনির্বিশেষে এটি সব বাঙালিকে মেলাতে পারেনি। এ কারণে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ একদিকে ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দুটোই প্রচার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভারত ভাগ্যবিধাতা নামক জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। আবার আমার সোনার বাংলা গানটিও বঙ্গভঙ্গের সময় লিখেছেন। তাদের বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্বের ধারণার মধ্যে কোনো তফাত্ ছিল না। এ কারণেই বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভক্তি রোধ করা যায়নি। মনে রাখা দরকার—এই একই চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার কারণে ভারতীয় জাতীয়তার বাইরে রবীন্দ্রনাথের মতো কবিও বাঙালির নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক রাষ্ট্রের কথা ভাবতে পারেননি। এ কারণেই তিনি মহাত্মা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ, রবিশঙ্কর, সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, জ্যোতিবসু, সৌরভ গাঙ্গুলি প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য কবি, শিল্পী, কলাবিদ, রাজনীতিক, ক্রীড়াবিদ ও আরও অনেকে পৃথিবীব্যাপী খ্যাত হয়েছেন ভারতীয় পরিচয়ে, বাঙালি হিসেবে নয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের মৃত্যুর পর আমাদের এখানকার বাঙালিবাদী সংস্কৃতিকর্মীরা বঙ্গ আবেগে আপ্লুত হয়ে তাকে হাজার বছরের অন্যতম সেরা বাঙালি হিসেবে সম্মানিত করেন এবং নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সত্যজিত রায় এ ধরনের পরিচয়ে গৌরব বোধ করতেন কি না তা জানার প্রয়োজন আমরা কখনও মনে করিনি। সত্যজিত রায়কে যখন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোঁয়া মিতেরা কলকাতায় এসে স্বহস্তে তার দেশের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তুলে দেন। রায় মশায় তখন সেই সংশয়কে এক ঘায়ে শেষ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, আমি তো বাঙালি-টাঙ্গালি নই। আমি গর্বিত ইন্ডিয়ান। সত্যজিতের এই আত্ম অন্বেষাকে আমাদের এখানকার বঙ্গ আবেগে নিমজ্জমান সংস্কৃতিকর্মীরা কীভাবে দেখবেন জানি না।
আসলে বাঙালিয়ানা যে একটা বড় ধরনের মিথ, ইতিহাসের সঙ্গে যার সম্বন্ধ একবারে নেই বললেই চলে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মিথটি তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগ্রহপুষ্ট বাঙালি বাবুদের হাতে। ইংরেজ শাসিত বাংলায় ওরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও শাসন ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল। বাংলা তথা ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকে পাকাপোক্ত করতে ওদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ইংরেজের সহযোগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার জন্য বাঙালিয়ানা তত্ত্বের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেই মতো করে তারা সেই তত্ত্বকে ফেরি করেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গবাসী যুক্তবঙ্গ থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিনের বাংলার হিন্দু নেতারা যৌথভাবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ভোট দিয়ে বাংলা ভাগের পক্ষে মত দেন। তখনকার পশ্চিমবঙ্গবাসী মনে করেছিল ওদের ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচিতি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার কাছে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে ১৯৩৬ ও ১৯৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে যখন এটা প্রমাণ হয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মুসলমানরাই বাংলায় ভবিষ্যত্ শাসক হিসেবে বহাল থাকবে। তারা তখন ভাবেনি গণতন্ত্র একদিন তাদের আধিপত্যের অবসান ঘটাবে। তাই তাদের দাবির ফলেই বাংলা ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে যায়। বাংলাকে এক রাখার চেষ্টা হয়েছিল বসু-সোহরাওয়ার্দী ফর্মুলার মাধ্যমে। কিন্তু খোদ গান্ধী-নেহরু এতে রাজি হননি, মুসলিম সংখ্যাগুরু অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুর স্বার্থরক্ষা হবে না এ যুক্তিতে। অথচ হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলেও তখনকার প্রেক্ষাপটে সবক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল। তা সত্ত্বেও গান্ধী-নেহরু সেদিন মুসলমানদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাহলে সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে জিন্নাহ সাহেবকে দোষ দেয়া কেন?
এর আগে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রচেষ্টা ওই পশ্চিমবঙ্গবাসীই প্রতিরোধ করেছিল, কারণ তখনকার প্রেক্ষাপট ওদের অনুকূলে ছিল। বাঙালিয়ানা তাই তার ভেতরকার বাবুয়ানাকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। বাঙালিয়ানার এই ফাঁকটুকু না ধরতে পারলে কৃষি পটভূমি থেকে উঠে আসা পূর্ববাংলার মানুষের কোনো মুক্তি নেই।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুর পক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবল আদর্শ অস্বীকার করে পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানকে স্বজাতিভুক্ত বলে মেনে নেয়া এবং বাঙালির জাতীয় ঐক্যের পক্ষে কাজ করা আজ তাই এক অসম্ভব ব্যাপার। সে অবস্থায় দিল্লির সঙ্গে বাঙালির বিরোধ অনিবার্য। এরকম চিন্তা আশ্চার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিত রায়, অন্নদা শংকর রায় কেউই করতে পারেননি।
ভারতকে বাদ দিয়ে বাঙ্গালির স্বাতন্ত্র্য চিন্তার কথা তারা কখনও মাথায় আনেননি। দেশ ভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেমন ভারতের অংশে পরিণত হয়, তেমনি মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সেই সময় মনে করা হয়েছিল সব রকমের সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বৃহত্তর ভারত সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারলেও পূর্ববঙ্গের ভাগ্য ঠিক একরকম হলো না। পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে যদিও তারা ধর্মীয়ভাবে নাজেহাল হওয়া থেকে রক্ষা পেল, কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের আধিপত্যের শিকার হলো। সেই আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য পূর্ব বাংলার মানুষকে আবার লড়াই করে বাংলাদেশ কায়েম করতে হলো। আমরা দুবার বিভক্ত হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করেছি। একবার এক ভাষা চর্চাকারী পশ্চিমবঙ্গ থেকে। দ্বিতীয়বার এক ধর্মে বিশ্বাসী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তাই পূর্ববঙ্গের মানুষের জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবোধ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের থেকে পৃথক। পূর্ববঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিবর্তন হয়েছে একভাবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সেই বিবর্তন হয়েছে অন্যভাবে। পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। পূর্ববঙ্গের মানুষ ধর্ম, ভাষা ও কালচার প্রত্যেকটিকে আত্মস্থ করে এক নতুন জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে অখণ্ড ভারত চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিয়ানার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষের বাঙালিয়ানার চরিত্রকে ঠিক মেলানো সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অনুভূতির এই যে স্বাতন্ত্র্যবোধ তারই নাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এটা সত্য পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষ একই বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাত-মাছ-আলু ভর্তা, শুঁটকি মাছ খায় এবং রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত শোনে। কিন্তু তা দিয়ে তো একটা রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে না। স্বভাষী ও স্বধর্মী হয়েও ব্রিটেন ও আমেরিকা পৃথক হয়ে গেছে। আটলান্টিকের দুই পাড়ের মানুষ ভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতীয়তার পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে। এর মূলে আছে তাদের পৃথক থাকবার চেতনা। ইউরোপে ও আরবে একই ধর্ম, ভাষা ও কালচার অনুসারীরা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতিতে সগৌরবে পরিচিতি বহন করে চলেছে। বাংলাদেশও এরকম একটা রাষ্ট্র।
একটা কথা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ তাই যেমন ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, তেমনি ভাষাকেও বাদ দিয়ে নয়। দুটোই আমাদের প্রয়োজন। দুটোর সমাহারে আমাদের আত্মপরিচয়।
এখানে একদল বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের কাছে বাঙালিয়ানার অর্থ হচ্ছে ইসলাম বর্জন। মুসলিম ভাবধারা ত্যাগ করে বাঙালিত্বের নামে প্রচলিত হিন্দুয়ানি গ্রহণ। অথবা সেই উনিশ শতকীয় কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু সংস্কৃতিকে নির্বিচারে আলিঙ্গন। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হচ্ছে ঔপনিবেশিক কালের মতো পূর্ববঙ্গকে আবার কলকাতার সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিণত করা। এটা কি আদৌ সম্ভব? আমরা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছি বলে যদি কেউ ভেবে থাকেন যে আমরা মুসলমানিত্বও জলাঞ্জলি দেব, সেটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা।
এসব বুদ্ধিজীবীর অনেকেই আছেন জীবন বাঁচানোর জন্য ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এমনকি এদের অনেকেরই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি পরিচয়ও সেদিন তাদের রক্ষা করতে পারেনি। আতঙ্কের ঠেলায় এরা পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করেন। আজকের এই বাংলাদেশে ওই পালিয়ে আসা ব্যক্তিরাই বড় বড় বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে আমাদের উপদেশ দেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কেরানিগিরি কিংবা নিদেনপক্ষে বড় বাবু হওয়া ছাড়া আর কিছু আশা করতে পারতেন না, যদি না তখন আমরা পৃথক হয়ে যেতাম। আজকের পশ্চিমবাংলার এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই অবস্থাটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
বাঙালি ঐতিহ্যের ধুয়া তুলে এরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভুলিয়ে দিতে চান। এরাই আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিকে মৌলবাদ বলে প্রচার করেন। এদের কাছে তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহ মৌলবাদী, ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনরা প্রগতিশীল। প্রগতি ও মৌলবাদের এই বিচিত্র ব্যাখ্যা আমাদের এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক দাসত্বের নমুনা ছাড়া আর কিছু নয়।
এসব সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা হীনম্মন্যতার সপ্তম স্বর্গে বাস করেন এবং ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে নিজস্ব ঐতিহ্য ও অতীতকে অস্বীকার করেন। এসব কক্ষচ্যুত সংস্কৃতিকর্মীরা কেউ কেউ মুসলিম নিয়মে সম্ভাষণ, নামকরণ, অনুষ্ঠানের সূচনা এবং পোশাকসহ যা কিছু আমাদের বৈশিষ্ট্য সব কিছু পরিত্যাগ করার কথা বলেন। এই পরিত্যাগের মধ্যে আছে আমাদের আত্মপরিচয় ডুবিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত।
যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও তত্পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির পরিচয়ভিত্তিক সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এগুলোকে ইসলাম থেকে সরে আসার ক্রান্তিকাল হিসেবে বর্ণনা করতে চান, তারা কখনও বলতে পারেননি ওই ধরনের আন্দোলন কেন পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠেনি। সেক্যুলার ও দেশভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলে তা কখনও তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অর্জনের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। বরং বাংলা ও বাঙালির বিভক্তির অবসানও ওই জাতীয়তাবাদের প্রধান দাবি হয়ে উঠত। তাই এটাকে বলা চলে বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদ, যার প্রধান উপাদান হচ্ছে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ।
ঔপনিবেশিক আমলে দীর্ঘ ২০০ বছর আমাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব ভাষা, কালচার, ধর্মকে কেউ মিশিয়ে দিতে পারেনি। ইসলাম ধর্ম থেকে প্রেরণা পেয়েই তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, ফকীর ও ওহাবী বিদ্রোহের নায়করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সেই সংগ্রামে পূর্ব-বাংলার মানুষই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিম বাংলার বাবুরা তখন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক শক্তি হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার পূর্ব-বাংলাতেই হয়েছে ভাষা আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভাষার জন্য রক্ত ঢেলে দেয়নি। তারা মেনে নিয়েছে অখণ্ড ভারততত্ত্বের আড়ালে হিন্দি ও মাড়োয়ারি আধিপত্য। কলকাতার কথ্য বাংলাকেও বলা যায় না এখন শুদ্ধ বাংলা। সেখানকার ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াসহ কথ্য বাংলায় যা বলা হয় তা হচ্ছে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজির অদ্ভুত খিচুড়ি। বাংলার চেয়ে হিন্দি ও ইংরেজিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, কারণ উঠতি প্রজন্মের ক্যারিয়ার নির্মাণে ঐ ভাষার গুরুত্বই এখন বেশি। বাংলার ব্যবহারিক মূল্য সেখানে তলানীতে এসে ঠেকেছে। বাঙালি শিল্পীরাও হিন্দিকে অগ্রাধিকার দেন এ কারণে যাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যায়। সুতরাং বাংলা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেয়ার ভার এসে পড়েছে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর।
তাই বাঙ্গালিত্ব যেমন আমাদের নিজস্ব জিনিস তেমনি মুসলমানিত্ব আমাদের ঐতিহ্য ও রক্তধারার সঙ্গে মিশে আছে। কোনো কিছুর বাড়াবাড়িকেই বলা যায় মৌলবাদ, তা সে ধর্মের রূপে হোক কিংবা ভাষা ও সংস্কৃতির আড়ালে হোক। আমরা যা আছি তাই থাকব। আমরা এগুতে চাই সামনের দিকে, দৃষ্টি আমাদের পেছনে নয়। বাঙালিয়ানার নামে বাবু মৌলবাদ তাই আমাদের কাম্য নয়।
No comments