শ্রদ্ধাঞ্জলি-জ্যোতি বসু: বাংলাদেশের সুহূদ by সোহরাব হাসান
জ্যোতি বসু এমন একজন নেতা, যাঁর পরিচয় ও কৃতিত্ব দল বা দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। রাজনৈতিক মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মোমারজি দেশাই, রাজীব গান্ধী, নরসিমা রাও তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।
নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া পদত্যাগ করার পর জ্যোতি বসুরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর দল সিপিআইএম সরকারে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। আই কে গুজরাল হন প্রধানমন্ত্রী। সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এভাবে একজন বাঙালি নেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন। পরে জ্যোতি বসু দলের এ সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ভুল বলে অভিহিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে জ্যোতি বসুর সম্পর্ক নিবিড় ও গভীর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে। এখনো সেখানে জ্যোতি বসুদের পুরোনো বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। একাধিকবার তিনি সেখানে গিয়েছেনও। দেশবিভাগের পর অধিকাংশ হিন্দু-মুসলমান বাড়ি ও সম্পদ অদলবদল করলেও জ্যোতি বসু তা করেননি। তাঁদের বাড়ি দেখাশোনার জন্য যে মুসলমান প্রতিবেশী ছিলেন, তাঁর কাছেই বাড়িটির দায়িত্ব দিয়ে যান। বাংলাদেশ সরকার বাড়িটি সংরক্ষণের প্রস্তাব দিলে জ্যোতি বসু সানন্দে রাজি হন।
গেল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি যে চুক্তি হয়, তাতে জ্যোতি বসু অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘদিন বিষয়টি অমীমাংসিত ছিল। ১৯৭৫ সালে পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালুর সময় শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার অঙ্গীকার করে ভারত। জিয়াউর রহমানের আমলে পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়, যাতে ৩৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা ছিল। এরশাদের শাসনামলে একবার চুক্তি নবায়ন হলেও মেয়াদ শেষে তা অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল; কিন্তু ভারত রাজি হচ্ছিল না। এ অবস্থায় শেখ হাসিনা জ্যোতি বসুর সহায়তা চাইলে তিনি বিষয়টি নিয়ে দিল্লির দরবারে পেশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দাবি-দাওয়া নিয়েও বহুবার দরবার করেছেন তিনি। ভারতে রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীদের যে পর্ষদ আছে, জ্যোতি বসু দীর্ঘদিন সেটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন; বিশেষ করে, অ-কংগ্রেসি রাজ্যগুলোর প্রতি যাতে কোনো বৈষম্য না হয়, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
বাংলাদেশের প্রয়াত রাজনীতিকদের মধ্যে মণি সিংহ, খোকা রায়, রণেশ দাশগুপ্ত, ফণীভূষণ মজুমদার, আহমদুল কবির, অমল সেন প্রমুখের সঙ্গে জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। রাজনীতির সূত্রে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোও তাঁর স্নেহধন্য। বাংলাদেশের কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি খুশি হতেন, পুরোনো বন্ধুদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯৪৬ সালে। তিনি তখন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী। কমিউনিস্ট পার্টির মাত্র চারজন সদস্য ছিলেন, নেতৃত্ব দিতেন জ্যোতি বসু। একবার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জ্যোতি বসুও আটক হন পুলিশের হাতে। অথচ তিনি আইনসভার সদস্য। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অবিভক্ত বাংলায় রাজনীতির সেই টালমাটাল সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম নেতাদের আলোচনার প্রয়োজন হতো। একবার এ রকম একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে জ্যোতি বসু তত্কালীন ছাত্রলীগের নেতা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আস্থাভাজন শেখ মুজিবের সহায়তা নিয়েছিলেন। অনেক দিন পর ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় এসব কথা তিনিই বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব যখন কলকাতায় যান, তখনো জ্যোতি বসু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় সহায়তার কথাও বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করছিল, জ্যোতি বসু এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, শুধু মৌখিক আশ্বাসে একটি জাতির মুক্তির লড়াই এগিয়ে নেওয়া যাবে না। এ জন্য চাই কার্যকর পদক্ষেপ। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ যুক্তফ্রন্টের বিরোধ তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় সরকার নকশাল ধরার নামে গোটা রাজ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যে প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘হাজার চুরাশির মা’। অর্থাত্ পশ্চিমবঙ্গের যুবকেরা নাম হারিয়ে একেকটি সংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। সেসব বৈরিতা সত্ত্বেও সব বামপন্থী দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধ্যমতো সহায়তা করেছিল।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে আই কে গুজরাল ও জ্যোতি বসুর সহায়তায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করতে সক্ষম হয় শেখ হাসিনার সরকার। জ্যোতি বসুর সঙ্গে শেখ হাসিনার এ হার্দিক সম্পর্ক অটুট ছিল শেষ দিনতক। শেখ হাসিনা এবারও দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গ যেতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতন পরিদর্শন ও জ্যোতি বসুকে দেখার জন্য; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।
জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ বছর, ২০০০ সালের মার্চে আমরা তাঁর একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন কবি মাহমুদ আল জামান ও আহমদ মুজতাহিদ। তত দিনে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও পরেরবার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন না। নির্বাচনেও দাঁড়াবেন না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসন জনগণকে কী দিতে পেরেছে, কী পারেনি, সেটাই ছিল আমাদের প্রশ্ন। জ্যোতি বসু সফলতার পাশাপাশি অকপটে দলের ও সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন।
কোথায় সফল হয়েছেন?
গ্রাম পঞ্চায়েত-ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও ভূমি সংস্কারে।
কোথায় ব্যর্থ হয়েছেন?
তাঁর স্পষ্ট উত্তর—শিল্পায়ন করতে না পারা।
বিদেশি বিনিয়োগকারী আনতে তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। তাঁর একটিই লক্ষ্য—প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাতে হবে, জীবনমান উন্নত করতে হবে। জ্যোতি বসুর আমলেই পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বর্তমানে তা আরও প্রসারিত হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি, অন্ধভাবে বিরোধিতা না করলে পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠত।
১৯৯২ সালে উগ্রপন্থী হিন্দুরা যখন বাবরি মসজিদ ভাঙল, সারা ভারতে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। বহু স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। কিন্তু জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা হতে দেননি। বিনষ্ট হতে দেননি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বিজেপিকে গাল দিয়েছিলেন অসভ্য সরকার বলে।
আলোচনা প্রসঙ্গে আসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানের অবস্থাও। জ্যোতি বসু বললেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আমরা (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী) এক ভাষায় কথা বলি, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিও এক। সে কারণেই দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানে সচেষ্ট থাকতে হবে। তারপর সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তখন ঢাকা-কলকাতা বাস চালু হয়ে গেছে। ঢাকা-আগরতলা বাস চালু নিয়ে কথাবার্তা চলছিল।
তিনি ত্রিদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, এতে তিন দেশই লাভবান হবে। গ্যাসক্ষেত্রের মালিক, ক্রেতা এবং পরিবহনকারী। জ্যোতি বসু চাইতেন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হোক। সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন এ বামপন্থী নেতা। ছিটমহলগুলো বিনিময়ের তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, এ ছাড়া বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে না। তাঁরা যে দেশের নাগরিক, সে দেশে যেতে পারেন না। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রাত্যহিক জীবনযাপন—সবই অন্য দেশের সঙ্গে।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে তিনবিঘা করিডর নিয়ে যে অস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়, তাতেও জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিল। বামফ্রন্টের শরিক ফরোয়ার্ড ব্লক এর প্রতিবাদে বন্ধ্ পালন করেছিল। ফ্রন্ট ত্যাগের হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু জ্যোতি বসু তাঁর অবস্থানে ছিলেন অনড়।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশে তাঁদের যে বাড়িটি আছে, সেটি নিয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। তিনি বলেছিলেন, বাড়িটি আমি সরকারকে দিয়ে দিয়েছি। সরকার যা খুশি করতে পারে।
শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রায়ই টেলিফোন করে তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তাঁর পরামর্শ নিতেন। একবার আলাপ প্রসঙ্গে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরও বামফ্রন্ট কীভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখল। জবাবে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করেছেন বলে সেটিই সম্ভব হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, শহরের সুবিধাভোগী মানুষ ছোট সমস্যাকেও বড় করে দেখে। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করলে তারা মনে রাখে।
জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথাও বলেছিলেন; বিশেষ করে, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়াদের কীভাবে নিয়ে আসা যায়। সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাদ্রাসায় পড়ার আগ্রহ বেশি। এসব মাদ্রাসা বাইরের সাহায্য-সহযোগিতাও পেয়ে থাকে। জ্যোতি বসুর সরকার সেই মাদ্রাসাশিক্ষাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু শিক্ষার্থীও সেখানে পড়াশোনা করছে।
একজন বিশাল মাপের নেতা যে কত বিনয়ী হতে পারেন, জ্যোতি বসু তার প্রমাণ। তিনি চব্বিশ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর আমলেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত প্রথা সফল হয়েছে, তাঁর ভূমি সংস্কার কর্মসূচি ভারতের অন্যান্য রাজ্যও গ্রহণ করেছে। কিন্তু তিনি কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। এমনকি নিজ দল সিপিআইএমের মাহাত্ম্যও বর্ণনা করেননি। তিনি বলতেন, ভালো করলে তার কৃতিত্ব পুরো বামফ্রন্টের। মন্দ করলেও সবাইকে তার দায় নিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম শুধু বৃহত্তম রাজনৈতিক দলই নয়, এককভাবে সরকার গঠনেও সক্ষম। তার পরও সমমনা ছোট দলগুলোকে নিয়ে জোট করেছে। মাঝেমধ্যে তাদের মনে অসন্তোষ, বিদ্রোহও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এ প্রবীণ নেতা ধৈর্য ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রতিবারই সে সমস্যা সামাল দিয়েছেন, যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না, তখনো।
তিনি ছিলেন ভারতের গণমানুষের নেতা, বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহূদ এবং আত্মার আত্মীয়।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
sohrab03@dhaka.net
বাংলাদেশের সঙ্গে জ্যোতি বসুর সম্পর্ক নিবিড় ও গভীর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে। এখনো সেখানে জ্যোতি বসুদের পুরোনো বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। একাধিকবার তিনি সেখানে গিয়েছেনও। দেশবিভাগের পর অধিকাংশ হিন্দু-মুসলমান বাড়ি ও সম্পদ অদলবদল করলেও জ্যোতি বসু তা করেননি। তাঁদের বাড়ি দেখাশোনার জন্য যে মুসলমান প্রতিবেশী ছিলেন, তাঁর কাছেই বাড়িটির দায়িত্ব দিয়ে যান। বাংলাদেশ সরকার বাড়িটি সংরক্ষণের প্রস্তাব দিলে জ্যোতি বসু সানন্দে রাজি হন।
গেল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি যে চুক্তি হয়, তাতে জ্যোতি বসু অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘদিন বিষয়টি অমীমাংসিত ছিল। ১৯৭৫ সালে পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালুর সময় শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার অঙ্গীকার করে ভারত। জিয়াউর রহমানের আমলে পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়, যাতে ৩৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা ছিল। এরশাদের শাসনামলে একবার চুক্তি নবায়ন হলেও মেয়াদ শেষে তা অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল; কিন্তু ভারত রাজি হচ্ছিল না। এ অবস্থায় শেখ হাসিনা জ্যোতি বসুর সহায়তা চাইলে তিনি বিষয়টি নিয়ে দিল্লির দরবারে পেশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দাবি-দাওয়া নিয়েও বহুবার দরবার করেছেন তিনি। ভারতে রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীদের যে পর্ষদ আছে, জ্যোতি বসু দীর্ঘদিন সেটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন; বিশেষ করে, অ-কংগ্রেসি রাজ্যগুলোর প্রতি যাতে কোনো বৈষম্য না হয়, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
বাংলাদেশের প্রয়াত রাজনীতিকদের মধ্যে মণি সিংহ, খোকা রায়, রণেশ দাশগুপ্ত, ফণীভূষণ মজুমদার, আহমদুল কবির, অমল সেন প্রমুখের সঙ্গে জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। রাজনীতির সূত্রে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোও তাঁর স্নেহধন্য। বাংলাদেশের কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি খুশি হতেন, পুরোনো বন্ধুদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯৪৬ সালে। তিনি তখন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী। কমিউনিস্ট পার্টির মাত্র চারজন সদস্য ছিলেন, নেতৃত্ব দিতেন জ্যোতি বসু। একবার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জ্যোতি বসুও আটক হন পুলিশের হাতে। অথচ তিনি আইনসভার সদস্য। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অবিভক্ত বাংলায় রাজনীতির সেই টালমাটাল সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম নেতাদের আলোচনার প্রয়োজন হতো। একবার এ রকম একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে জ্যোতি বসু তত্কালীন ছাত্রলীগের নেতা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আস্থাভাজন শেখ মুজিবের সহায়তা নিয়েছিলেন। অনেক দিন পর ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় এসব কথা তিনিই বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব যখন কলকাতায় যান, তখনো জ্যোতি বসু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় সহায়তার কথাও বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করছিল, জ্যোতি বসু এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, শুধু মৌখিক আশ্বাসে একটি জাতির মুক্তির লড়াই এগিয়ে নেওয়া যাবে না। এ জন্য চাই কার্যকর পদক্ষেপ। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ যুক্তফ্রন্টের বিরোধ তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় সরকার নকশাল ধরার নামে গোটা রাজ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যে প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘হাজার চুরাশির মা’। অর্থাত্ পশ্চিমবঙ্গের যুবকেরা নাম হারিয়ে একেকটি সংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। সেসব বৈরিতা সত্ত্বেও সব বামপন্থী দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধ্যমতো সহায়তা করেছিল।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে আই কে গুজরাল ও জ্যোতি বসুর সহায়তায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করতে সক্ষম হয় শেখ হাসিনার সরকার। জ্যোতি বসুর সঙ্গে শেখ হাসিনার এ হার্দিক সম্পর্ক অটুট ছিল শেষ দিনতক। শেখ হাসিনা এবারও দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গ যেতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতন পরিদর্শন ও জ্যোতি বসুকে দেখার জন্য; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।
জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ বছর, ২০০০ সালের মার্চে আমরা তাঁর একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন কবি মাহমুদ আল জামান ও আহমদ মুজতাহিদ। তত দিনে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও পরেরবার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন না। নির্বাচনেও দাঁড়াবেন না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসন জনগণকে কী দিতে পেরেছে, কী পারেনি, সেটাই ছিল আমাদের প্রশ্ন। জ্যোতি বসু সফলতার পাশাপাশি অকপটে দলের ও সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন।
কোথায় সফল হয়েছেন?
গ্রাম পঞ্চায়েত-ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও ভূমি সংস্কারে।
কোথায় ব্যর্থ হয়েছেন?
তাঁর স্পষ্ট উত্তর—শিল্পায়ন করতে না পারা।
বিদেশি বিনিয়োগকারী আনতে তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। তাঁর একটিই লক্ষ্য—প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাতে হবে, জীবনমান উন্নত করতে হবে। জ্যোতি বসুর আমলেই পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বর্তমানে তা আরও প্রসারিত হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি, অন্ধভাবে বিরোধিতা না করলে পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠত।
১৯৯২ সালে উগ্রপন্থী হিন্দুরা যখন বাবরি মসজিদ ভাঙল, সারা ভারতে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। বহু স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। কিন্তু জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা হতে দেননি। বিনষ্ট হতে দেননি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বিজেপিকে গাল দিয়েছিলেন অসভ্য সরকার বলে।
আলোচনা প্রসঙ্গে আসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানের অবস্থাও। জ্যোতি বসু বললেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আমরা (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী) এক ভাষায় কথা বলি, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিও এক। সে কারণেই দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানে সচেষ্ট থাকতে হবে। তারপর সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তখন ঢাকা-কলকাতা বাস চালু হয়ে গেছে। ঢাকা-আগরতলা বাস চালু নিয়ে কথাবার্তা চলছিল।
তিনি ত্রিদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, এতে তিন দেশই লাভবান হবে। গ্যাসক্ষেত্রের মালিক, ক্রেতা এবং পরিবহনকারী। জ্যোতি বসু চাইতেন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হোক। সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন এ বামপন্থী নেতা। ছিটমহলগুলো বিনিময়ের তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, এ ছাড়া বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে না। তাঁরা যে দেশের নাগরিক, সে দেশে যেতে পারেন না। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রাত্যহিক জীবনযাপন—সবই অন্য দেশের সঙ্গে।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে তিনবিঘা করিডর নিয়ে যে অস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়, তাতেও জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিল। বামফ্রন্টের শরিক ফরোয়ার্ড ব্লক এর প্রতিবাদে বন্ধ্ পালন করেছিল। ফ্রন্ট ত্যাগের হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু জ্যোতি বসু তাঁর অবস্থানে ছিলেন অনড়।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশে তাঁদের যে বাড়িটি আছে, সেটি নিয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। তিনি বলেছিলেন, বাড়িটি আমি সরকারকে দিয়ে দিয়েছি। সরকার যা খুশি করতে পারে।
শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রায়ই টেলিফোন করে তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তাঁর পরামর্শ নিতেন। একবার আলাপ প্রসঙ্গে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরও বামফ্রন্ট কীভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখল। জবাবে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করেছেন বলে সেটিই সম্ভব হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, শহরের সুবিধাভোগী মানুষ ছোট সমস্যাকেও বড় করে দেখে। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করলে তারা মনে রাখে।
জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথাও বলেছিলেন; বিশেষ করে, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়াদের কীভাবে নিয়ে আসা যায়। সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাদ্রাসায় পড়ার আগ্রহ বেশি। এসব মাদ্রাসা বাইরের সাহায্য-সহযোগিতাও পেয়ে থাকে। জ্যোতি বসুর সরকার সেই মাদ্রাসাশিক্ষাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু শিক্ষার্থীও সেখানে পড়াশোনা করছে।
একজন বিশাল মাপের নেতা যে কত বিনয়ী হতে পারেন, জ্যোতি বসু তার প্রমাণ। তিনি চব্বিশ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর আমলেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত প্রথা সফল হয়েছে, তাঁর ভূমি সংস্কার কর্মসূচি ভারতের অন্যান্য রাজ্যও গ্রহণ করেছে। কিন্তু তিনি কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। এমনকি নিজ দল সিপিআইএমের মাহাত্ম্যও বর্ণনা করেননি। তিনি বলতেন, ভালো করলে তার কৃতিত্ব পুরো বামফ্রন্টের। মন্দ করলেও সবাইকে তার দায় নিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম শুধু বৃহত্তম রাজনৈতিক দলই নয়, এককভাবে সরকার গঠনেও সক্ষম। তার পরও সমমনা ছোট দলগুলোকে নিয়ে জোট করেছে। মাঝেমধ্যে তাদের মনে অসন্তোষ, বিদ্রোহও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এ প্রবীণ নেতা ধৈর্য ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রতিবারই সে সমস্যা সামাল দিয়েছেন, যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না, তখনো।
তিনি ছিলেন ভারতের গণমানুষের নেতা, বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহূদ এবং আত্মার আত্মীয়।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
sohrab03@dhaka.net
No comments