আদালতের রুল

এবার হরতালের বিকল্প নিয়ে ভাবুন হরতালে হরতালে জর্জরিত দেশ। হরতালের নামে রাজনৈতিক পদক্ষেপের কার্যকারিতা শূন্যের কোঠায়। স্বাভাবিকভাবেই হরতালের প্রতি নৈতিক সমর্থন নেই কারো। সাধারণ মানুষের বিরক্তি চরমে। সীমাহীন দুর্ভোগের নাম এখন হরতাল। পথেঘাটে আতঙ্ক। হরতালের বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষের জীবন।


কর্মহীন দিনমজুরের ঘরে অনিশ্চয়তা। অনিশ্চিত দেশের আগামী দিনের নাগরিক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। হরতাল অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। সাধারণের আবেদন অগ্রাহ্য। রাজনৈতিক দলের প্রাধিকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণ। রুল জারি। আদালত যে জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমলে নিয়েছেন, হয়তো এটাই শেষ সান্ত্বনা সাধারণের। রবিবারের পর আরো কঠিন ও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা। হরতালের চেয়ে কঠিনতর আবার কী! প্রবলতর হচ্ছে আতঙ্ক ও নানা আশঙ্কা।
দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হরতাল এখন গুরুত্বহীন। হরতাল মানে অর্থনীতির চাকা থেমে থাকা। রুদ্ধ অগ্রগতির পথ। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত। মানুষের অশেষ দুর্ভোগ। কাজের অপরিসীম ক্ষতি। তার পরও সে ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়া যেত, যদি ফললাভ হতো। নাগরিক দুর্ভোগ ও জীবনহানি যে রাজনৈতিক রণকৌশলের অনিবার্য ফল তা অবশ্যবর্জনীয়। ক্ষমতাসীন দলকে দুর্বল করতে, নিজেদের দাবিদাওয়া আদায় করতে হরতালের বিকল্প নেই- এমন কথা এখন আর বলা যাবে না। কারণ গত কয়েক বছরে হরতাল সবার কাছ থেকে সব ধরনের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। হারিয়েছে কার্যকারিতা। অতিসম্প্রতি হরতাল আহ্বান করা হয়েছে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর সন্ধানের দাবিতে। দুই সপ্তাহে পাঁচ দিনের হরতাল কী লাভ তুলে দিল দেশবাসীর হাতে? বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগ, কর্মহীন দিনযাপন ও প্রাণহানি। অনিশ্চিত নিহতদের পরিবারের ভবিষ্যৎ। অন্যদিকে হরতালে অনেকের অভুক্ত থাকা কিংবা জমানো টাকা থেকে ভেঙে খাওয়া- এই তো হরতালের প্রাপ্তি। তবে অন্তহীন ক্ষতি শিক্ষার্থীদের। তাদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে গেল পাঁচটি অনুর্বর দিন। বিশেষ করে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। একদিকে পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হওয়া- দুইয়ে মিলে একটি অনিশ্চিত অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। আদালত এ বিষয়টিকেই আমলে নিয়েছেন। পাবলিক পরীক্ষা চলাকালে হরতাল থেকে বিরত থাকতে কেন রুল দেওয়া যাবে না, সেটা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, শিক্ষাসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এর আগে গত ২৬ এপ্রিল আদালতে এ বিষয়ে একটি রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা পরীক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে হরতাল আহ্বান করে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় বলে রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়। তা ছাড়া হরতালে অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। একজন পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। হরতালের নামে এই ক্ষতিসাধন কতটা যৌক্তিক, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
শুরুতেই বলা হয়েছে, হরতাল এখন আর কার্যকর রাজনৈতিক রণকৌশল নয়। কাজেই বিকল্প ভাবতে হবে। যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নেই, যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধাগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, সে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি সাধারণের নৈতিক সমর্থন থাকে না। এতে সরকারকে বিব্রত করা যায়, কিন্তু জনসমর্থন বৃদ্ধি পায় না। এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পর্কে ভাবতে হবে। উচ্চতর আদালতের রুল রাজনৈতিক দলগুলোকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনা করেই আদালতের জারি করা এই রুল নিঃসন্দেহে সর্বমহলে প্রশংসিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.