প্রতিপক্ষঃ ছাত্র রাজনীতির গতিপ্রকৃতি by এবনে গোলাম সামাদ
ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত কি উচিত নয় সেটা একটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ছাত্ররা এদেশে রাজনীতি করে আসছে সেই ইংরেজ আমল থেকেই। আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাসকে বুঝতে হলে অনুশীলন করতে হয় ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসকে।
ইংরেজ আমলে আমাদের দেশে এসে পৌঁছায় ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই নানা রাজনৈতিক দর্শন। যা আলোকিত করেছে ছাত্রদের মনকে। আর তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে নানা রাজনৈতিক মতাদর্শে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়েছে সংগঠন, করেছে আন্দোলন। ইংরেজ আমলে এক সময় দেশে সবাইকে পড়ানো হতো বিলেতের রাজনৈতিক ইতিহাস। কিন্তু পরে ইংরেজ সরকার চায়নি আর ছাত্রদের ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়াতে। কারণ তারা বুঝতে পারে, এই উপমহাদেশে ছাত্ররা রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছে ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়ে। সে যুগের ছাত্র রাজনীতি আর আজকের ছাত্র রাজনীতি এক নয়। ছাত্র রাজনীতিতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। ছাত্র রাজনীতি এক সময় ছিল আদর্শের ব্যাপার, এখনকার মতো ব্যক্তিস্বার্থের ব্যাপার নয়। ছাত্ররা আগে কখনোই টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে মাতেনি। মাতেনি ভর্তি বাণিজ্যে। এখন তাদের এসব ক্ষেত্রে মাতোয়ারা হতে দেখা যাচ্ছে। ইংরেজ চলে যাওয়ার পরও এদেশে ছাত্ররা এক সময় করেছে আদর্শের রাজনীতি। এখন ফেব্রুয়ারি মাস। ছাত্ররা করেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন তারা ব্যক্তিস্বার্থে করেনি। করেছে তদানীন্তন পাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলমান স্বার্থকে সংরক্ষিত করার জন্য। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতির সামনে এরকম কোনো বিরাট আদর্শের নমুনা হাতছানি দিচ্ছে না। ছাত্ররা হয়ে পড়ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশ। আর তাদের স্বার্থেই ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে তারা। হারিয়ে ফেলেছে তাদের চিন্তা-চেতনার সত্তা। এদেশের রাজনীতির ইতিহাস অনুশীলন করলে দেখা যায়, ছাত্রদের সেই আন্দোলন সফল হয়েছে, যেখানে জনসাধারণ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সঙ্গে। অর্থাত্ ছাত্র রাজনীতির সাফল্য নির্ভর করেছে জণগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারার ফলে। এক সময় এদেশে ছাত্ররা বিবেচিত হয়েছে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে। তারা কুড়িয়েছে দেশের মানুষের শ্রদ্ধা। এক সঙ্গে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেকেছে অনেক ছাত্র। তাদের মধ্যে ঘটতে পেরেছে ভাবের আদান-প্রদান, গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক সংগঠন। আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশেরই উদ্ভব হয়েছে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে। পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্ররা নিয়েছিল বিশেষ ভূমিকা। পাঞ্জাবের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী বিলেতের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় চয়ন করেছিলেন পাকিস্তান নামটি। তিনি পাকিস্তান বলতে প্রথমে বাংলাদেশের কথা বোঝেননি। তিনি চেয়েছিলেন, এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে পাকিস্তান, বাংলা, আসাম অঞ্চলে বাঙগা-ই-ইসলাম এবং এই উপমহাদেশের মধ্য ভাগে নিজাম শাসিত হায়দরাবাদকে নির্ভর করে উসমানিস্তান গড়তে। এই উমহাদেশের রাজনৈতিক চিন্তায় ছাত্ররা বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় নিযুক্ত ছাত্ররা শিক্ষাজীবন শেষ করার আগে রেখেছেন তাদের চিন্তার অবদান। কিন্তু এখন এদেশের ছাত্র সমাজ দেশের কথা, দশের কথা সেভাবে আর ভাবছে বলে মনে হয় না। ছাত্র রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলে গেছে বিরাটভাবে। ছাত্র রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে সঙ্কীর্ণমনতা। এর জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মনে হয় বিশেষভাবে দায়ী।
রাজশাহী দেশের মধ্যে একটি শিক্ষা নগরী হিসেবে খ্যাত। এই শহরের ছাত্র রাজনীতির যে চেহারা এখন আমি দেখছি, এক সময় তা ছিল না। ক’দিন আগে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে খুন হলেন এক ছাত্র নেতা। তিনি ছিলেন শুনলাম ছাত্রমৈত্রী নামে এক ছাত্র সংগঠনের নেতা। তিনি খুন হলেন ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে। তার মৃত্যুতে শহরে খুব একটা হই চই হলো না। কারণ ছাত্রমৈত্রী আর ছাত্রলীগ এখন দেশের রাজনীতিতে হয়ে পড়েছে জোটবদ্ধ। যদিও আবার চলেছে সংঘাত। এই মৃত্যুর রেশ না মেলাতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হলেন ছাত্রলীগের সমর্থক বলে কথিত একজন ছাত্র। একে নাকি হত্যা করেছে ছাত্রশিবিরের সদস্যরা। যদিও বিষয়টি হয়ে আছে বিশেষভাবে অস্পষ্ট। কিন্তু এই মৃত্যুর ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ধরপাকড়।
মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল তার ছাত্র সংগঠনকে রক্ষা করার জন্য নিচ্ছে তার পক্ষ। আর হত্যার অজুহাত তুলে চাচ্ছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করার যুক্তি পেতে। এটা দলতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক হতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক নয়। ছাত্রলীগের ছাত্রের মৃত্যুর জন্য হেলিকপ্টারে করে ছুটে আসতে দেখা গেল বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে। অথচ এর আগে ছাত্রলীগ যখন ছাত্রমৈত্রীর একজন স্থানীয় ছাত্রনেতাকে হত্যা করল তখন সরকারি দলের কোনো প্রতিমন্ত্রীকে এভাবে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল না। সরকারের কাজ করতে হয় দেশের আইন মেনে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, পুলিশকে চলতে হবে তার আদেশ মেনে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক’দিন আগে যা ঘটেছে, তার জন্য এখন দায়ী করা হচ্ছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে কয়েকজন পুলিশকে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করতে চাননি বলে মনে হয় তাদের পেতে হচ্ছে এই শাস্তি। নানা দিক থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে শাসক দল আনছে আবিলতা। আমি কোনো পক্ষ নিতে চাই না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে কেটেছে আমার জীবনের দীর্ঘ সময়। আমি চাই সেখানে বজায় থাক শিক্ষার পরিবেশ। আর ছাত্ররা রাজনৈতিক ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করুক, কিন্তু জড়িয়ে না পড়ুক হিংস্র রাজনীতিতে। দেশে আমরা গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চাই। তবে খুন-খারাবির রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। এবার খুন-খারাবির রাজনীতি শুরু করেছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। সেটা রাজনৈতিক দিক থেকে মোটেও সমীচীন হচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ, দেশের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষমতাসীন দলকে দেখাতে হবে সহিষ্ণুতা। কিন্তু সেটা দেখানোর কোনো প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে না শাসক দলের মধ্যে। তারা যেন মেতে উঠতে চাচ্ছেন নির্মূলের রাজনীতিতে। তাদের ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও যার প্রভাব প্রকাশ পাচ্ছে সুস্পষ্টভাবে।
ছাত্ররা এখন আর দেশের রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি নয়। কিন্তু তারা দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা গণনযোগ্য শক্তি। তাদের তাই হতে হবে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে খুবই ভুল রাজনীতি। এতে থাকছে দেশে গণতন্ত্র বিলুপ্তির আশঙ্কা। আর থাকছে সেই সঙ্গে বিদেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা। বর্তমান বাংলাদেশ একটা সুপ্রাচীন সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র নয়। আমাদের ভুলে এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হতেই পারে। আজকের ছাত্রদের মধ্যে অনেকে হবে ভবিষ্যতের মন্ত্রী। তাই তাদের উচিত হবে দেশকে জানা ও বোঝা। ভাবতে হবে দেশের সমস্যাগুলোকে নিয়ে। সংগ্রাম কথাটা আমরা খুব বেশি বলি। কিন্তু সৃজন কথাটা নিয়ে আমরা খুব একটা চিন্তা করি না। রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেভাবে থাকতে হবে সৃজনী প্রচেষ্টা। পুরনোকে ভাঙার পাশে যাতে আমরা গড়ে তুলতে পারি নতুনকে।
No comments