তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন এবং রবীন্দ্র-বিতর্ক by সৈয়দ সামিউস সালেহ
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তা ও সম্মেলন কমিটির সভাপতি। দু’জন সম্পাদক, একজন অধ্যাপক অজিত গুহ।
অন্যজন সৈয়দ আলী আশরাফ। সম্মেলন সফল করতে মূল ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, কবি জসিম উদ্দীন, বেগম শামছুন্নাহার, আবুল হাসনাত, অধ্যক্ষ শরফুদ্দীন, ত্রিপুরা শঙ্কর সেন শাস্ত্রী, ড. এসআর খাস্তগীর ও ড. আবদুল ওয়াজেদ।
সাহিত্য সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, তারা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেবে না এবং কোনো সহযোগিতা করবে না। তারা মত প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রগতি সাহিত্য বিরোধী এবং প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণসাহিত্যের পরিপন্থী। একই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মার্কসবাদী’তে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রগুপ্ত তার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রগতি বিরোধী সাহিত্যিক হিসেবে চিত্রিত করেন। প্রবন্ধে বলা হয় যেহেতু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রগতিবিরোধী সেহেতু প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করা একটি বৈপ্লবিক দায়িত্ব। রবীন্দ্র গুপ্তের এই বক্তব্যে উভয় বাংলার সাহিত্য মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ববাংলার সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশ রবীন্দ্র বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ড. আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন ও আখলাকুর রহমান।
রবীন্দ্র নাথ বিষয়ে এদের সঙ্গে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ-এর সভাপতি অধ্যাপক অজিত গুহের বিরোধ দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রগতিবিরোধী বা প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক নন, এর সপক্ষে অজিত গুহ হাজারটা যুক্তি উত্থাপন করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অজিত গুহকে সমর্থন করেন।
এখানে যে প্রশ্নটি পাঠককে তাড়া করে তা হলো, মুসলিম লীগ সরকার যখন বলতে চাচ্ছে ‘বাংলা হিন্দুদের ভাষা’, প্রভাবশালী হিন্দুরা তাদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে বাংলা ভাষাকে লালন করে আসছে। সে সময় কেন বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী অংশ কেন রবীন্দ্রবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো! এ বিষয়ে বিশ্লেষকগণ বলেন, যারা রবীন্দ্র বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা সাহিত্যকে দুর্বল করা। অন্যভাবে বলা যায় নেপথ্যে থেকে মুসলিম লীগ সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করা।
যাহোক রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বিরোধীরা তাকে প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বাংলা সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হটাতে পারেনি। বরং বায়ান্নের পর নিজেরাই হটে গেছে।
এ কথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলা সাহিত্য থেকে হটানোর চেষ্টা পূর্ববাংলায় কম হয়নি। সে চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৪৯ সালে যদি এ চেষ্টা সফল হতো তাহলে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হতো। ভাষা আন্দোলন শুধু রাজপথেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কিন্তু নয়। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায়ও ঝড় উঠেছিল। বিতর্ক হয় প্রচুর। ‘যথাসম্ভব’ একটিমাত্র শব্দ নিয়েও দীর্ঘ বিতর্ক হয়।
‘যথাসম্ভব’ শব্দ নিয়ে বিতর্কের বিষয়টা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয়। গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এদের প্রত্যেকটি থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়। আহ্বায়ক মনোনীত হন শামছুল আলম। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে ‘বর্ধমান হাউসে’ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠকে বহুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেন। ৮ দফা চুক্তি হয়। চুক্তির অষ্টম দফা ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস সম্পর্কিত ঘোষণা মাত্র। ৮ম দফায় বলা হয়, ‘সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনার পর এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।’
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল ১৯৪৮ বিকেলে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাবের দ্বিতীয় দফায় বলা হয় ‘পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে ‘যথাসম্ভব’ বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।’ পরবর্তী সময়ে এক সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি ‘স্কলারের’ স্থলে ‘ছাত্র’ শব্দটি সংযোজন করতে চান। এই ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়।
বিতর্কের শুরুতে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, প্রধানমন্ত্রী হাউসে যে প্রস্তাব পেশ করেছেন সে প্রস্তাবে কতদিনের ভেতর বাংলা আমাদের সরকারি ভাষা হবে তার উল্লেখ নেই। আমাদের কথা হচ্ছে যথাসম্ভব নয় অতি শিগগির তা করা দরকার। কারণ, যদি অতি শিগগির তা করা না হয় যদি তার ভেতর ডেডলাইন পড়ে যায় তাহলে ১০০ বছরেও বাংলা ভাষা এখানকার প্রাদেশিক ভাষার স্থান লাভ করতে পারবে না। কংগ্রেসের অপর সদস্য বিনোদ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি একটি অস্পষ্ট শব্দ, অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি। এটা রক্ষার জন্য সরকার যে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে ভরসা নেই। কংগ্রেস সদস্য প্রভাস চন্দ্র লাহিরী একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মধ্যে ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি তুলে দিতে বলেন। তিনি প্রস্তাব করেন ১. পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুদ্রা, টেলিগ্রাফ, রেলওয়ে টিকিট এবং অন্যান্য সরকারি ও আধা সরকারি ফরমে বাংলার ব্যবহার অবিলম্বে চালু করতে হবে।
২. কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস এবং সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সমস্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং অন্যতম বিষয় হিসেবে বাংলা প্রবর্তন করতে হবে। কংগ্রেস দলীয় নেতা বসন্ত কুমার দাস, প্রভাস চন্দ্র লাহিরীর প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে উল্লিখিত ‘যথাসম্ভব’ শব্দের পরিবর্তে নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেন। আহমদ আলী মৃধা প্রস্তাব করেন, বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে যত শিগগির সম্ভব বাস্তব সমস্যাগুলো দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাববিষয়ক আলোচনার সমাপ্তি টানেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, তার দেয়া প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশটির কতকগুলো সমালোচনা সত্ত্বেও মূল প্রস্তাবটির বিষয় পরিষদে সম্পূর্ণ মতৈক্য লক্ষিত হয়েছে। একটি সমালোচনা হয়েছে ‘যথাসম্ভব’কে কেন্দ্র করে। অপরটি তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে। এই দুই সমালোচনাকে বিবেচনা করে আহমদ আলী মৃধার ১৬ নম্বর সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পরিষদকে জানান। তিনি বলেন, ওই সংশোধনী গ্রহণ করায় মূল প্রস্তাবের পাঠ দাঁড়াবে পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হইবে এবং যত শিগগির সম্ভব বাস্তব সমস্যাগুলো দূর করা যায়, তত শিগগির তাহা কার্যকর করা হইবে। তিনি আরও বলেন, ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি তুলে ফেলা হলে অনেক বাস্তব সমস্যা দেখা দেবে যা সমাধান করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’ ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি বাদ দেয়ার অর্থ প্রস্তাবটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিণত হবে। এই কাজ করা কী সম্ভব। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার জন্য বাংলায় লিখিত বই আছে কি? এজন্যই ‘যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে না দিয়ে আহমদ আলী মৃধা সাহেবের সংশোধনীটি গ্রহণ করা হলো।
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, বাংলা সাহিত্যকে দুর্বল করতে পশ্চিমাদের সঙ্গে আমাদের প্রথিতযশা সাহিত্যিকগণেরও ভূমিকা ছিল। আবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন সংসদ ও রাজপথে সমানভাবে সক্রিয় ছিল। তবে বিজয় এসেছে রাজপথের আন্দোলন থেকেই।
salehszk@yahoo.com
সাহিত্য সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, তারা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেবে না এবং কোনো সহযোগিতা করবে না। তারা মত প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রগতি সাহিত্য বিরোধী এবং প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণসাহিত্যের পরিপন্থী। একই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মার্কসবাদী’তে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রগুপ্ত তার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রগতি বিরোধী সাহিত্যিক হিসেবে চিত্রিত করেন। প্রবন্ধে বলা হয় যেহেতু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রগতিবিরোধী সেহেতু প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করা একটি বৈপ্লবিক দায়িত্ব। রবীন্দ্র গুপ্তের এই বক্তব্যে উভয় বাংলার সাহিত্য মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ববাংলার সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশ রবীন্দ্র বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ড. আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন ও আখলাকুর রহমান।
রবীন্দ্র নাথ বিষয়ে এদের সঙ্গে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ-এর সভাপতি অধ্যাপক অজিত গুহের বিরোধ দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রগতিবিরোধী বা প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক নন, এর সপক্ষে অজিত গুহ হাজারটা যুক্তি উত্থাপন করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অজিত গুহকে সমর্থন করেন।
এখানে যে প্রশ্নটি পাঠককে তাড়া করে তা হলো, মুসলিম লীগ সরকার যখন বলতে চাচ্ছে ‘বাংলা হিন্দুদের ভাষা’, প্রভাবশালী হিন্দুরা তাদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে বাংলা ভাষাকে লালন করে আসছে। সে সময় কেন বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী অংশ কেন রবীন্দ্রবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো! এ বিষয়ে বিশ্লেষকগণ বলেন, যারা রবীন্দ্র বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা সাহিত্যকে দুর্বল করা। অন্যভাবে বলা যায় নেপথ্যে থেকে মুসলিম লীগ সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করা।
যাহোক রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বিরোধীরা তাকে প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বাংলা সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হটাতে পারেনি। বরং বায়ান্নের পর নিজেরাই হটে গেছে।
এ কথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলা সাহিত্য থেকে হটানোর চেষ্টা পূর্ববাংলায় কম হয়নি। সে চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৪৯ সালে যদি এ চেষ্টা সফল হতো তাহলে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হতো। ভাষা আন্দোলন শুধু রাজপথেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা কিন্তু নয়। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায়ও ঝড় উঠেছিল। বিতর্ক হয় প্রচুর। ‘যথাসম্ভব’ একটিমাত্র শব্দ নিয়েও দীর্ঘ বিতর্ক হয়।
‘যথাসম্ভব’ শব্দ নিয়ে বিতর্কের বিষয়টা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয়। গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এদের প্রত্যেকটি থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়। আহ্বায়ক মনোনীত হন শামছুল আলম। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে ‘বর্ধমান হাউসে’ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠকে বহুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেন। ৮ দফা চুক্তি হয়। চুক্তির অষ্টম দফা ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস সম্পর্কিত ঘোষণা মাত্র। ৮ম দফায় বলা হয়, ‘সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনার পর এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।’
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল ১৯৪৮ বিকেলে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাবের দ্বিতীয় দফায় বলা হয় ‘পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে ‘যথাসম্ভব’ বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।’ পরবর্তী সময়ে এক সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি ‘স্কলারের’ স্থলে ‘ছাত্র’ শব্দটি সংযোজন করতে চান। এই ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়।
বিতর্কের শুরুতে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, প্রধানমন্ত্রী হাউসে যে প্রস্তাব পেশ করেছেন সে প্রস্তাবে কতদিনের ভেতর বাংলা আমাদের সরকারি ভাষা হবে তার উল্লেখ নেই। আমাদের কথা হচ্ছে যথাসম্ভব নয় অতি শিগগির তা করা দরকার। কারণ, যদি অতি শিগগির তা করা না হয় যদি তার ভেতর ডেডলাইন পড়ে যায় তাহলে ১০০ বছরেও বাংলা ভাষা এখানকার প্রাদেশিক ভাষার স্থান লাভ করতে পারবে না। কংগ্রেসের অপর সদস্য বিনোদ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি একটি অস্পষ্ট শব্দ, অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি। এটা রক্ষার জন্য সরকার যে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে ভরসা নেই। কংগ্রেস সদস্য প্রভাস চন্দ্র লাহিরী একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মধ্যে ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি তুলে দিতে বলেন। তিনি প্রস্তাব করেন ১. পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুদ্রা, টেলিগ্রাফ, রেলওয়ে টিকিট এবং অন্যান্য সরকারি ও আধা সরকারি ফরমে বাংলার ব্যবহার অবিলম্বে চালু করতে হবে।
২. কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস এবং সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সমস্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং অন্যতম বিষয় হিসেবে বাংলা প্রবর্তন করতে হবে। কংগ্রেস দলীয় নেতা বসন্ত কুমার দাস, প্রভাস চন্দ্র লাহিরীর প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে উল্লিখিত ‘যথাসম্ভব’ শব্দের পরিবর্তে নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেন। আহমদ আলী মৃধা প্রস্তাব করেন, বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে যত শিগগির সম্ভব বাস্তব সমস্যাগুলো দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাববিষয়ক আলোচনার সমাপ্তি টানেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, তার দেয়া প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশটির কতকগুলো সমালোচনা সত্ত্বেও মূল প্রস্তাবটির বিষয় পরিষদে সম্পূর্ণ মতৈক্য লক্ষিত হয়েছে। একটি সমালোচনা হয়েছে ‘যথাসম্ভব’কে কেন্দ্র করে। অপরটি তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে। এই দুই সমালোচনাকে বিবেচনা করে আহমদ আলী মৃধার ১৬ নম্বর সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পরিষদকে জানান। তিনি বলেন, ওই সংশোধনী গ্রহণ করায় মূল প্রস্তাবের পাঠ দাঁড়াবে পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হইবে এবং যত শিগগির সম্ভব বাস্তব সমস্যাগুলো দূর করা যায়, তত শিগগির তাহা কার্যকর করা হইবে। তিনি আরও বলেন, ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি তুলে ফেলা হলে অনেক বাস্তব সমস্যা দেখা দেবে যা সমাধান করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’ ‘যথাসম্ভব’ শব্দটি বাদ দেয়ার অর্থ প্রস্তাবটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিণত হবে। এই কাজ করা কী সম্ভব। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার জন্য বাংলায় লিখিত বই আছে কি? এজন্যই ‘যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে না দিয়ে আহমদ আলী মৃধা সাহেবের সংশোধনীটি গ্রহণ করা হলো।
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, বাংলা সাহিত্যকে দুর্বল করতে পশ্চিমাদের সঙ্গে আমাদের প্রথিতযশা সাহিত্যিকগণেরও ভূমিকা ছিল। আবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন সংসদ ও রাজপথে সমানভাবে সক্রিয় ছিল। তবে বিজয় এসেছে রাজপথের আন্দোলন থেকেই।
salehszk@yahoo.com
No comments