ধর্ম-শ্রমিক-মালিকের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে কর্মজীবী মানুষের শ্রমের অধিকার পূর্ণমাত্রায় স্বীকৃত। শ্রমিক-মালিক প্রত্যেকেই স্বীয় মেধা, দক্ষতা, শক্তি, বুদ্ধি-বিবেক অনুসারে চেষ্টা ও পরিশ্রম দ্বারা কাজ সম্পাদন করেন। ইসলামে শ্রমজীবী, কর্মমুখী মেহনতি মানুষের যেমন মর্যাদা ও সম্মানবোধ রয়েছে—তেমনই তাদের নিজ নিজ কর্তব্য এবং ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব রয়েছে।


নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে অন্যের কাজ করা বা শ্রমের মূল্য আদায় বা গ্রহণ করা মোটেই লজ্জার ব্যাপার নয়। এ জন্য প্রতিটি কাজের যা মূল্য, এতে শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি বা পারিশ্রমিক পরিপূর্ণভাবে দিতে হবে এবং কোনোরূপ জুলুম, পীড়ন, শোষণ বা বঞ্চনার অবকাশ নেই। নবী করিম (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে ধনাঢ্য মালিক ব্যক্তিদের টালবাহানা করা জুলুম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামের শ্রমনীতি অনুযায়ী কৃষক, শ্রমিক বা কোনো কর্মজীবীকে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতে পারবে না। শ্রমের ন্যায়সংগত চুক্তির পারিতোষিক তাদেরকে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন। শ্রমিকদের আর্থিক বা দৈহিক ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে, সামর্থ্যের বাইরে তাদের ওপর কাজের বোঝা চাপানো যাবে না এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে। শ্রমিকের পরিশ্রমের ফল বা কর্মীর কাজের প্রতিদান পাওয়ার অধিকার অনস্বীকার্য। একজন সৎকর্মশীল শ্রমিক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত-২৬)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক হবে ভাইয়ের মতো। শ্রমিক মালিকের অর্পিত দায়িত্ব ভাই হিসেবে আঞ্জাম দেবে, আর মালিক থাকবে শ্রমিকের প্রতি সহানুভূতিশীল, দয়াবান ও দরদি। মালিক শ্রমিককে কখনো শোষণ করবে না এবং সাধ্যাতীত কোনো কাজের বোঝাও তার ওপর চাপিয়ে দেবে না। অকারণে শ্রমিক ছাঁটাই করে তাদের অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। অতএব, আল্লাহ কারও ভাইকে তার অধীন করে দিলে সে যা খাবে, তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে—তাকে তা থেকে পরিধান করতে দেবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সে কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।’ (বুখারি)
ইসলামে শ্রমের অধিকারের পাশাপাশি শ্রমিকের কাজে অবকাশ তথা দৈনিক বিশ্রাম ও সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ার অধিকার আছে। শিশু, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণদের প্রতি সদয় আচরণ এবং বৃদ্ধ ও অসুস্থতার জন্য ভাতা লাভ শ্রমিকের অন্যতম অধিকার। শ্রমশক্তি অব্যাহত রাখার জন্য শরীর ঠিক রাখতে ন্যূনতম ঘুম, বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন হয়। গৃহ শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময় বিশ্রাম, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা অধিকারের কথাও ইসলাম স্বীকার করে। শ্রমজীবী লোকেরা অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত হলে, কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়লে, অকর্মণ্য বা বার্ধক্য দেখা দিলে তাকে দীর্ঘকালীন অবিশ্রান্ত শ্রমসাধনার অনিবার্য পরিণতি গণ্য করে এ অবস্থায় তার জীবিকা ও পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে সহযোগিতা করা সামাজিক দায়িত্ব এবং তার জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করে তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করা মালিকের কর্তব্য। প্রত্যেক নবী-রাসূল শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন। নবী করিম (সা.) স্বয়ং অসহায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রাখতেন, কেউ রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) অসুস্থ শ্রমিক-কর্মচারীদের সেবা-শুশ্রূষা করতেন এবং চিকিৎসার খোঁজখবর নিতেন। কেউ এ কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে তাকে পদচ্যুত করতেন, আর কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে নিয়োজিত দেখলে তার কাজের বোঝা লাঘব করে দিতেন।
শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে ইসলামে ঘোষিত হয়েছে যে শ্রমিকদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে মালিকের যেসব দামি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা ও জেনেশুনে তা নষ্ট বা ধ্বংস না করা তাদের অবশ্যকর্তব্য। যে কাজ যেভাবে করা উচিত, সে কাজ সেভাবে আঞ্জাম দেওয়া শ্রমিকের দায়িত্ব, অন্যথায় চরম বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এ ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো লোকের অধীন শ্রমিক স্বীয় মালিকের সম্পদের রক্ষক এবং সে তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামে শ্রমিক ও পুঁজিপতি মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, সংঘাত ও শ্রেণীসংগ্রামের নয়, বরং সে সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের, সহযোগীর ও সাহায্যকারীর। শ্রমিক, মজুর ও মেহনতি মানুষ নিজেকে হীন মনে করবে না—পক্ষান্তরে মালিকও নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে না। মূলত পণ্য ও উৎপাদনে মূলধন ও শ্রম অপরিহার্য। কাজেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে পরিপূরক মনে করতে হবে। তাই শ্রমিকেরা যেমন ন্যায্য মজুরি পাওয়ার অধিকারী, তেমনই ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত লোকেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন-ভাতা এবং পুঁজির মালিক উদ্যোক্তারা ন্যায়সংগত মুনাফা লাভের অধিকারী। যাতে তারা শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করতে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ, শিক্ষা-চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। শ্রমিকের মজুরি প্রদান সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজা)
ইসলাম সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ব্যবধান দূরীভূত করেছে—শ্রমিকদের মর্যাদাহানিকর কোনো শব্দ ব্যবহার হোক বা সম্বোধন করুক—ইসলাম তাও সমর্থন করেনি। ইসলামের প্রাথমিক যুগেই শ্রম নীতিমালায় কোনো শ্রমিককে দাস বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মনিবকে “রব” বা প্রভু বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করছি। কারণ, মনিব-শ্রমিক তোমরা ছোট-বড়, উঁচু-নিচু সবাই একমাত্র আল্লাহর গোলাম।’
ইসলামে শ্রমিক-মালিকের অধিকার এবং পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে যে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে, এর যথার্থ অনুশীলন করলে শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে কখনো বঞ্চিত হবে না এবং মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো দিন মনোমালিন্য ঘটবে না।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.