সুশাসন-দুদকের স্বাধীনতা বনাম সংবিধানের সুরক্ষা by এ এম এম শওকত আলী
দুদকের জন্ম হয়েছিল স্বাধীনভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল মহত্ এবং সিদ্ধান্তও ছিল যুগোপযোগী। জন্মলগ্ন থেকেই দুদককে খোঁড়া হাঁস বলে মিডিয়ায় আখ্যায়িত করা হয়। কী কারণে করা হয় তার কিছু বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।
২০০৭ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জরুরি অবস্থা জারির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কিছু কাঠামোগত সংস্কার সূচিত হয়। এ সংস্কারের প্রধান অংশ ছিল, দুই কমিশনারসহ নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং বিদ্যমান আইনের সংশোধন। এসব সংস্কারের মাধ্যমে দুদকের দুর্নীতি দমন কার্যক্রম গতিশীল হলেও এ সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে কিছু অত্যাচার ও অনাচারের বিষয় জনমনে ঘনীভূত হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমনের মূল চালিকাশক্তি কে বা কারা ছিল এবং এর উদ্দেশ্যই বা ছিল কী—এ দুটি প্রশ্নের সঠিক তথ্য জানা না গেলেও দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিছু মৌলিক তথ্য বিভিন্ন টক শোসহ মিডিয়ার অন্যান্য প্রতিবেদনে জানা যায়।
সংসদ গঠিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে একটি সংসদীয় কমিটি দুদকের কমিশনারদের সশরীরে হাজির হয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোর অভাবের কারণে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অবশ্য দুদকের একজন সাবেক সচিব প্রথমে হাজির হতে অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তী সময়ে হাজির হন। অন্য কেউ এ বিষয়ে সাড়া দেননি। লক্ষণীয় যে, একমাত্র সরকারি বেতনভুক ব্যক্তিরাই সংসদে জবাবদিহি করতে বাধ্য, অন্য কেউ নয়।
দুদক নির্বাচন কমিশনের মতো কোনো সাংবিধানিক সংস্থা নয়। এ সংস্থার স্বাধীনতার সীমারেখাও বিদ্যমান। এ সীমারেখা কমিশনের আইনেই বলা রয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট সংগত কারণে বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টই স্বাধীন, তবে সংবিধান সাপেক্ষে। প্রকাশ্যে স্বীয় সংস্থার বিষয়ে কোনো অনভিপ্রেত বক্তব্য বিচারপতিরা প্রকাশ করেন না। দুদকের জন্মলগ্নে এ ধরনের কিছু বক্তব্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দিয়েছিলেন—যাকে বলা যায়, ময়লা কাপড় জনসমক্ষে সাফ করা। সম্প্রতি দুদকের প্রধান কর্মকর্তার এমনই একটি বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্যে বলা হয়েছে, দুদক দন্তহীন বাঘ। আসলে কি তাই?
সংবিধানের মূলমন্ত্র হচ্ছে—রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দুদক বা এ ধরনের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা ও শক্তির নামে এ মূলমন্ত্রকে উজিয়ে যেতে পারে না। এটা উপেক্ষা করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে দুঃশাসন বা কুশাসন হবে, যা কারও কাম্য নয়। এ ধরনের উপলব্ধি থেকেই সংসদীয় কমিটি সম্প্রতি দুদক আইন সংশোধনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, অধিকাংশ দিকনির্দেশনার সঙ্গে দুদক দ্বিমত পোষণ করেছে। দুদকের যে উপকমিটি সংসদীয় কমিটির কিছু দিকনির্দেশনার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে, সে বিষয়েও দুদকের প্রধানসহ কমিশনাররা একমত নন। প্রকাশিত সংবাদে যে কটি দিকনির্দেশনা সংসদীয় কমিটি দুদককে প্রেরণ করেছে, সে বিষয়গুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিষয়গুলো হলো : এক. সরকারের বেতনভুক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দাখিলের আগে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করাই বিধান। এ বিধান এর আগে অর্থাত্ পুরোনো আইনে ছিল, নতুন আইনে বিলুপ্ত করা হয়। এ বিধানের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, অনেক সত্ ও দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকলেও পরবর্তীকালে দুদকের আসামি হয়েছেন। এ কারণে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিথিলতা আসে। এ ধরনের ব্যাখ্যাকে আরও সম্প্রসারিত করা যায়। এক. সরল বিশ্বাসে কাজ করার বিষয়টি দণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়। এ স্বীকৃতি ফৌজদারি বিধিমালায়ও বিদ্যমান। দুই. অতীতে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলায় বিশেষ করে, ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির জন্য দুর্নীতি দমন অধিদপ্তর ঢালাওভাবে যেসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ক্রয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নন, কিন্তু সরকারি কার্য সম্পাদনবিধি অনুযায়ী তাঁরা ক্রয়সংক্রান্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিন. এমন অনেক নজির রয়েছে, বিভিন্ন কারণে দুর্নীতির মামলায় আসামি সাত-আট বছর পর সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ সময়কালে তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত ছিলেন। এ ধরনের উদাহরণ এখনো যে নেই, তা বলা যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে দুদক কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই সাত-আট বছরের কর্মজীবন বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনাম? এ বিধান প্রতিস্থাপিত হলে পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে বলে যে যুক্তি প্রকাশিত হয়েছে, তার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। দুদকের যুক্তি ভিন্নতর। এককথায় তারা বলেছে, দুদককে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য পরিবর্তনের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।
পুরোনো বিধানটি কীভাবে কাজ করত, সে বিষয়ে যাঁরা বিপক্ষে বলেছেন, তাঁদের হয়তো জানা নেই। প্রাথমিকভাবে সরকারি অনুমোদনের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল। ১৯৮২ পরবর্তী সময়ে এ কমিটির সব সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে) এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন, সচিব, এমপি ও মন্ত্রীদের মামলার অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। অর্থাত্ সম্পূর্ণ বিষয়টি রাজনীতিকায়ন করা হয়। কোনো বিশ্লেষণধর্মী গবেষণায় কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কী করেছে, যাতে নিরপেক্ষতার অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যা কিছু আছে, তা অনুমাননির্ভর। এর সঙ্গে যোগ করা যায় ভারতের বিদ্যমান প্রথা। এ প্রথায় সরল বিশ্বাসে কাজ করার জন্য সরকারি অনুমোদনের বিধান এখনো অনুসৃত হয়। এ বিষয়ে কিছু দিন আগে একজন বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবী স্পষ্ট মন্তব্য করেছিলেন—পুরোনো বিধানটি রাখতে হবে, অন্যথায় সরকারি বেতনভুক ব্যক্তিরা কাজ করতে পারবেন না।
আইন সংশোধনীর পরবর্তী দিকনির্দেশনা হলো—২০০৭-০৮ সালে দুদকের যেসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে দুই ধরনের প্রস্তাব দুই উত্স থেকে প্রদান করা হয়েছে। সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি মত দিয়েছে, এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুদকের সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে অভিযোগ করতে হবে এবং গৃহীত ব্যবস্থা দুদক অভিযোগকারীকে জানাবে। অন্য উত্স অর্থাত্ দুদকের উপকমিটির মত হলো, বিধি অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে বিধায় আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। বলে রাখা প্রয়োজন, সব সংস্থাই আইন অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তবে এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারও হয়। বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ছাড়াও নিরপেক্ষ তদন্তের বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে থাকবে না কেন?
পরবর্তী দিকনির্দেশনা হলো, কমিশনের সচিব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তিনি মুখ্য হিসেবে কর্মকর্তা হবেন। এ বিষয়ে দুদকের ভিন্নমত রয়েছে। তাহলো : এক. দুদকের আইন অনুযায়ী এ ক্ষমতা সরকারের নয়, বরং দুদকের। দুই. দুদকের আইন মতে, চেয়ারম্যান এ সংস্থার প্রধান নির্বাহী। এ ধরনের বক্তব্য বিশেষ করে, শেষোক্ত ক্ষেত্রে হয় অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা নিছক একগুঁয়েমি। প্রধান নির্বাহী এবং মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা সমার্থক নয়। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী মন্ত্রী, সচিব নয়। সচিব মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা, যাঁর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সংসদের সরকারি হিসাবসংক্রান্ত কমিটির কাছে অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে জবাবদিহি করা। এটা যদি চেয়ারম্যানকে করতে হয়, তাহলে তাঁকে ওই সংসদীয় কমিটির কাছে সশরীরে হাজির হয়ে প্রতিটি অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। আর যদি দুদকের নিযুক্ত সচিবের কাছে করতে হয়, তাহলে বিধি অনুযায়ী তাঁকে সংস্থার মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সংসদ রাজি না হলে দুদক এটা করতে পারবে না। প্রথমোক্ত বিষয়ে বলা যায়, এমনকি নির্বাচন কমিশনেও সরকার থেকে প্রেষণে সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব নিয়োগ করা হতো। এখনো তা-ই রয়েছে। এতে কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এ ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়ম হবে, দুদক সংগত মনে করলে সরকারকে অনুরোধ জানাতে পারে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে দুদকের অধীনে প্রেষণে স্থানান্তর করার। পরবর্তী সময়ে দুদক নিয়োগ আদেশ দিতে পারে।
প্রকাশিত সংবাদে আরও দেখা যায়, দুদকের উপকমিটির মতের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের দ্বিমত রয়েছে। এ ছাড়া দুদকও আইন সংশোধনের বিষয়ে কিছু নতুন প্রস্তাব সরকারকে প্রেরণ করবে। প্রশ্ন হলো, সংসদ যদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে দুদকের উপায় কী হবে? প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা সংসদের, অন্য কোনো সংস্থার নয়।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হচ্ছে দুদক বনাম সংসদ অথবা দুদক বনাম সরকারের সঙ্গে, তা এ প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দিতে পারে। নিজস্ব সব মতই সঠিক, অন্যের মত সঠিক নয়—এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের অভ্যন্তরে এবং সরকারের বাইরের সব সংস্থারই একে অন্যের প্রতি অধিকতর সহনশীল হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিই সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক শক্তি—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সবশেষে আলোচনার বিষয়টি হলো, রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি জবাবদিহিতা। এ বিষয়ে দুদকের পক্ষে মত হলো, তারা রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করে থাকে এবং তা সংসদেও পেশ করা হয়। অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা—যেমন নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশনও এ কাজটি করে থাকে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না। কারণ, না রাষ্ট্রপতি, না সংসদ এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো মতামত প্রদান করেন। কারণ আইনে এ সুযোগ নেই। প্রচলিত নিয়মও তা-ই। এ বিষয়ে আরেকটি উত্স থেকে মত প্রকাশ করা হয়েছে যে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় বিধায় এ জবাবদিহিতার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে না। তাহলে কি দুদক একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে সংবিধানকেও উজিয়ে যাবে?
বিগত এক বছরে নির্বাচন কমিশনসহ দুদকও স্বীকার করেছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টি কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি। নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে এ স্বীকারোক্তি কি যথেষ্ট নয়? অন্য একটি প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেশ কিছুসংখ্যক সাংসদের কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ বোর্ড নির্বাহী বিভাগের অধীন একটি সংস্থা। তাদের যদি এ বিষয়ে সত্ সাহস থাকে, তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
সংসদ গঠিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে একটি সংসদীয় কমিটি দুদকের কমিশনারদের সশরীরে হাজির হয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোর অভাবের কারণে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অবশ্য দুদকের একজন সাবেক সচিব প্রথমে হাজির হতে অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তী সময়ে হাজির হন। অন্য কেউ এ বিষয়ে সাড়া দেননি। লক্ষণীয় যে, একমাত্র সরকারি বেতনভুক ব্যক্তিরাই সংসদে জবাবদিহি করতে বাধ্য, অন্য কেউ নয়।
দুদক নির্বাচন কমিশনের মতো কোনো সাংবিধানিক সংস্থা নয়। এ সংস্থার স্বাধীনতার সীমারেখাও বিদ্যমান। এ সীমারেখা কমিশনের আইনেই বলা রয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট সংগত কারণে বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টই স্বাধীন, তবে সংবিধান সাপেক্ষে। প্রকাশ্যে স্বীয় সংস্থার বিষয়ে কোনো অনভিপ্রেত বক্তব্য বিচারপতিরা প্রকাশ করেন না। দুদকের জন্মলগ্নে এ ধরনের কিছু বক্তব্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দিয়েছিলেন—যাকে বলা যায়, ময়লা কাপড় জনসমক্ষে সাফ করা। সম্প্রতি দুদকের প্রধান কর্মকর্তার এমনই একটি বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্যে বলা হয়েছে, দুদক দন্তহীন বাঘ। আসলে কি তাই?
সংবিধানের মূলমন্ত্র হচ্ছে—রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দুদক বা এ ধরনের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা ও শক্তির নামে এ মূলমন্ত্রকে উজিয়ে যেতে পারে না। এটা উপেক্ষা করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে দুঃশাসন বা কুশাসন হবে, যা কারও কাম্য নয়। এ ধরনের উপলব্ধি থেকেই সংসদীয় কমিটি সম্প্রতি দুদক আইন সংশোধনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, অধিকাংশ দিকনির্দেশনার সঙ্গে দুদক দ্বিমত পোষণ করেছে। দুদকের যে উপকমিটি সংসদীয় কমিটির কিছু দিকনির্দেশনার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে, সে বিষয়েও দুদকের প্রধানসহ কমিশনাররা একমত নন। প্রকাশিত সংবাদে যে কটি দিকনির্দেশনা সংসদীয় কমিটি দুদককে প্রেরণ করেছে, সে বিষয়গুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিষয়গুলো হলো : এক. সরকারের বেতনভুক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দাখিলের আগে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করাই বিধান। এ বিধান এর আগে অর্থাত্ পুরোনো আইনে ছিল, নতুন আইনে বিলুপ্ত করা হয়। এ বিধানের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, অনেক সত্ ও দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকলেও পরবর্তীকালে দুদকের আসামি হয়েছেন। এ কারণে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিথিলতা আসে। এ ধরনের ব্যাখ্যাকে আরও সম্প্রসারিত করা যায়। এক. সরল বিশ্বাসে কাজ করার বিষয়টি দণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়। এ স্বীকৃতি ফৌজদারি বিধিমালায়ও বিদ্যমান। দুই. অতীতে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলায় বিশেষ করে, ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির জন্য দুর্নীতি দমন অধিদপ্তর ঢালাওভাবে যেসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ক্রয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নন, কিন্তু সরকারি কার্য সম্পাদনবিধি অনুযায়ী তাঁরা ক্রয়সংক্রান্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিন. এমন অনেক নজির রয়েছে, বিভিন্ন কারণে দুর্নীতির মামলায় আসামি সাত-আট বছর পর সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ সময়কালে তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত ছিলেন। এ ধরনের উদাহরণ এখনো যে নেই, তা বলা যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে দুদক কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই সাত-আট বছরের কর্মজীবন বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনাম? এ বিধান প্রতিস্থাপিত হলে পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে বলে যে যুক্তি প্রকাশিত হয়েছে, তার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। দুদকের যুক্তি ভিন্নতর। এককথায় তারা বলেছে, দুদককে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য পরিবর্তনের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।
পুরোনো বিধানটি কীভাবে কাজ করত, সে বিষয়ে যাঁরা বিপক্ষে বলেছেন, তাঁদের হয়তো জানা নেই। প্রাথমিকভাবে সরকারি অনুমোদনের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল। ১৯৮২ পরবর্তী সময়ে এ কমিটির সব সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে) এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন, সচিব, এমপি ও মন্ত্রীদের মামলার অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। অর্থাত্ সম্পূর্ণ বিষয়টি রাজনীতিকায়ন করা হয়। কোনো বিশ্লেষণধর্মী গবেষণায় কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কী করেছে, যাতে নিরপেক্ষতার অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যা কিছু আছে, তা অনুমাননির্ভর। এর সঙ্গে যোগ করা যায় ভারতের বিদ্যমান প্রথা। এ প্রথায় সরল বিশ্বাসে কাজ করার জন্য সরকারি অনুমোদনের বিধান এখনো অনুসৃত হয়। এ বিষয়ে কিছু দিন আগে একজন বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবী স্পষ্ট মন্তব্য করেছিলেন—পুরোনো বিধানটি রাখতে হবে, অন্যথায় সরকারি বেতনভুক ব্যক্তিরা কাজ করতে পারবেন না।
আইন সংশোধনীর পরবর্তী দিকনির্দেশনা হলো—২০০৭-০৮ সালে দুদকের যেসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে দুই ধরনের প্রস্তাব দুই উত্স থেকে প্রদান করা হয়েছে। সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি মত দিয়েছে, এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুদকের সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে অভিযোগ করতে হবে এবং গৃহীত ব্যবস্থা দুদক অভিযোগকারীকে জানাবে। অন্য উত্স অর্থাত্ দুদকের উপকমিটির মত হলো, বিধি অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে বিধায় আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। বলে রাখা প্রয়োজন, সব সংস্থাই আইন অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তবে এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারও হয়। বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ছাড়াও নিরপেক্ষ তদন্তের বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে থাকবে না কেন?
পরবর্তী দিকনির্দেশনা হলো, কমিশনের সচিব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তিনি মুখ্য হিসেবে কর্মকর্তা হবেন। এ বিষয়ে দুদকের ভিন্নমত রয়েছে। তাহলো : এক. দুদকের আইন অনুযায়ী এ ক্ষমতা সরকারের নয়, বরং দুদকের। দুই. দুদকের আইন মতে, চেয়ারম্যান এ সংস্থার প্রধান নির্বাহী। এ ধরনের বক্তব্য বিশেষ করে, শেষোক্ত ক্ষেত্রে হয় অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা নিছক একগুঁয়েমি। প্রধান নির্বাহী এবং মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা সমার্থক নয়। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী মন্ত্রী, সচিব নয়। সচিব মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা, যাঁর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সংসদের সরকারি হিসাবসংক্রান্ত কমিটির কাছে অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে জবাবদিহি করা। এটা যদি চেয়ারম্যানকে করতে হয়, তাহলে তাঁকে ওই সংসদীয় কমিটির কাছে সশরীরে হাজির হয়ে প্রতিটি অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। আর যদি দুদকের নিযুক্ত সচিবের কাছে করতে হয়, তাহলে বিধি অনুযায়ী তাঁকে সংস্থার মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সংসদ রাজি না হলে দুদক এটা করতে পারবে না। প্রথমোক্ত বিষয়ে বলা যায়, এমনকি নির্বাচন কমিশনেও সরকার থেকে প্রেষণে সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব নিয়োগ করা হতো। এখনো তা-ই রয়েছে। এতে কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এ ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়ম হবে, দুদক সংগত মনে করলে সরকারকে অনুরোধ জানাতে পারে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে দুদকের অধীনে প্রেষণে স্থানান্তর করার। পরবর্তী সময়ে দুদক নিয়োগ আদেশ দিতে পারে।
প্রকাশিত সংবাদে আরও দেখা যায়, দুদকের উপকমিটির মতের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের দ্বিমত রয়েছে। এ ছাড়া দুদকও আইন সংশোধনের বিষয়ে কিছু নতুন প্রস্তাব সরকারকে প্রেরণ করবে। প্রশ্ন হলো, সংসদ যদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে দুদকের উপায় কী হবে? প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা সংসদের, অন্য কোনো সংস্থার নয়।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হচ্ছে দুদক বনাম সংসদ অথবা দুদক বনাম সরকারের সঙ্গে, তা এ প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দিতে পারে। নিজস্ব সব মতই সঠিক, অন্যের মত সঠিক নয়—এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের অভ্যন্তরে এবং সরকারের বাইরের সব সংস্থারই একে অন্যের প্রতি অধিকতর সহনশীল হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিই সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক শক্তি—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সবশেষে আলোচনার বিষয়টি হলো, রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি জবাবদিহিতা। এ বিষয়ে দুদকের পক্ষে মত হলো, তারা রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করে থাকে এবং তা সংসদেও পেশ করা হয়। অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা—যেমন নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশনও এ কাজটি করে থাকে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না। কারণ, না রাষ্ট্রপতি, না সংসদ এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো মতামত প্রদান করেন। কারণ আইনে এ সুযোগ নেই। প্রচলিত নিয়মও তা-ই। এ বিষয়ে আরেকটি উত্স থেকে মত প্রকাশ করা হয়েছে যে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় বিধায় এ জবাবদিহিতার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে না। তাহলে কি দুদক একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে সংবিধানকেও উজিয়ে যাবে?
বিগত এক বছরে নির্বাচন কমিশনসহ দুদকও স্বীকার করেছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টি কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি। নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে এ স্বীকারোক্তি কি যথেষ্ট নয়? অন্য একটি প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেশ কিছুসংখ্যক সাংসদের কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ বোর্ড নির্বাহী বিভাগের অধীন একটি সংস্থা। তাদের যদি এ বিষয়ে সত্ সাহস থাকে, তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments