শিক্ষার পরিবেশ-বিদ্যালয়গুলোকে বদলে দাও by মোহাম্মদ জাকিউল ইসলাম
প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়—যেমন, সিলেবাস, সময়মতো বই বিতরণ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার মান নিয়ে লেখা হয়। কিন্তু ‘শিক্ষার পরিবেশ’ নিয়ে আমাদের আলোচনা খুবই সীমিত। পরিবেশ বলতে আমি শুধু ফিজিক্যাল বা ভৌত পরিবেশের কথা বলছি, আরও সহজভাবে স্কুল বিল্ডিং ডিজাইনের কথা বলতে চাচ্ছি।
যেকোনো কিছুর জন্যই পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। Lewin-এর ফর্মুলা BƒP.E (Behavior (B) is a function of the person (P) and the environment (E). যেখানে বোঝানো হচ্ছে, মানুষ কী রকম আচরণ করবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে মানুষটির ওপর এবং যে পরিবেশে মানুষটি আছে তার ওপর। যেমন, জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে, অর্থাত্ শিক্ষার্থী কী রকম শিখবে, তা নির্ভর করবে অবশ্যই তার মেধা, প্রস্তুতি এবং যিনি শেখাচ্ছেন তাঁর ওপর, কিন্তু যে পরিবেশে শিক্ষার্থী আছে, তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমাদের দেশের স্কুলগুলোর দিকে একটু তাকান, দেখবেন, এগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি এখানে স্কুলের ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই: ১. কীভাবে স্কুল-ভবনের বাইরের জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো যায়। ২. স্কুলের ডিজাইনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের সুযোগ থাকার প্রয়োজনীয়তা। ৩. স্কুলে এমন একটা জায়গা থাকার প্রয়োজনীয়তা, যেখানে সব শিক্ষার্থী মিলিত হতে পারবে।
প্রথমত, স্কুল বলতে আমরা শুধু স্কুল-ভবনকেই বুঝি, অথচ স্কুলের চারপাশে খোলা জায়গাটাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারি। ঘনবসতিপূর্ণ শহর, যেমন ঢাকার স্কুলগুলোর খুব একটা খোলা জায়গা থাকে না। কিন্তু সাধারণত গ্রামাঞ্চলে স্কুলের চারপাশে খোলা জায়গা পাওয়া যায়। স্কুলের যে খেলার মাঠটা থাকে, তাকে আমরা ধরে থাকি শুধু টিফিনের সময় খেলার জায়গা হিসেবে। কিন্তু খুব সহজেই এই জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো যায় ঘরের বাইরের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে।
একদিক দিয়ে আমরা খুবই ভাগ্যবান, আমাদের দেশের আবহাওয়া এমন যে বছরের অন্তত ছয় মাস আমরা স্বচ্ছন্দে ঘরের বাইরে কাটাতে পারি, যা কি না অনেক গ্রীষ্ম বা শীতপ্রধান দেশে অসম্ভব।
এই বাইরের ক্লাসরুমগুলো করতে খুব একটা খরচের প্রয়োজন হয় না। কয়েকটা খুঁটি এবং টিন অথবা খড়ের চালাই যথেষ্ট। কদিন আগেই গাইবান্ধার কয়েকটা স্কুল ঘুরে দেখলাম, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী ক্লাসরুমগুলো অনেক ছোট, জায়গার বড় অভাব। বেচারা বাচ্চাগুলো চাপাচাপি করে বসে ক্লাস করছে। বাইরের এই ক্লাসরুমগুলো করতে পারলে জায়গার অভাব কিছুটা হলেও কমবে।
এই ক্লাসরুমগুলো শিক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের শেখার সুযোগ করে দেয়। বাচ্চারা যখন ছবি আঁকবে, তখন অন্ধকার ঘরে বসে কেন আঁকবে? ব্যাঙের জীবনের বিভিন্ন ধাপ বোঝার জন্য বইয়ের ছবি যথেষ্ট নয়। বাচ্চারা এই ক্লাসগুলোতে আসল ব্যাঙাচি দেখে ব্যাঙের জীবনের বিভিন্ন ধাপ শিখবে।
বাইরের এই ক্লাসরুমগুলোর আরেকটা ভালো দিক হচ্ছে প্রাথমিক স্কুলে যে বয়সের বাচ্চারা যায়, তারা ঘরের ভেতরের চেয়ে বাইরে সময় কাটাতে পছন্দ করে। স্বভাবতই আশা করা যায়, বাইরের এই ক্লাসরুমগুলো বাচ্চাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
এ তো গেল স্কুল-ভবনের চারপাশের খোলা জায়গা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার আলোচনা। এবার ভবনের ভেতর নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমাদের দেশের স্কুলগুলোর ডিজাইন পুরোনো ধাঁচের, এ ধরনের ডিজাইনের পেছনে মূল যে চিন্তা বা ধারণা তা হচ্ছে, একেকটা ক্লাসরুমে নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী বসবে এবং নির্দিষ্ট সময় তারা একজন শিক্ষিকার কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু শিখবে। কিন্তু বাস্তবে এভাবে পড়াশোনা হয় না। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন নমনীয়তার প্রয়োজন, তেমনি নমনীয়তার প্রয়োজন স্কুল-ভবনের ডিজাইনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্লাসরুমগুলো এমন করে ডিজাইন করা সম্ভব, যা কি না লেকচার শোনার জন্যও উপযোগী হবে, আবার শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করার জন্যও উপযোগী হবে। অল্প কয়েকটা পার্টিশন দেয়াল দিয়ে এটা করা সম্ভব, যা কি না শিক্ষার্থী বা শিক্ষকেরা ইচ্ছামতো সরিয়ে নিতে পারবে তাদের চাহিদা অনুযায়ী।
বাচ্চারা শুধু শিক্ষকের কাছ থেকেই শেখে না, তারা অনেক কিছুই শেখে তাদের কাছাকাছি বয়সের অন্য বাচ্চাদের কাছ থেকে। কিন্তু এর জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। এমন একটা জায়গা, যেখানে সব শিক্ষার্থী মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এখনকার স্কুলগুলোতে খুব সহজেই এ রকম একটা পারস্পরিক যোগাযোগের জায়গা ডিজাইন করা সম্ভব। বাচ্চারা এই জায়গায় মিলিত হতে পারবে, কথা বলতে পারবে, শিখতে আর একে অন্যকে শেখাতে পারবে।
মোট কথা, স্কুলের পরিবেশ হওয়া উচিত এমন, যেখানে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে। যেখানে বাচ্চারা খেলতে খেলতে শিখবে। কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন মানুষের জন্য চাপিয়ে দেওয়া কোনো জিনিস হওয়া জরুরি নয়। আমরা এভাবেই শিখি। কিন্তু
এই জ্ঞান অর্জন ঠিকমতো হওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ।
উল্লিখিত বাইরের ক্লাসরুম, স্কুল-ভবনের ডিজাইনে নমনীয়তা এবং শিক্ষার্থীদের মিলিত হওয়ার জায়গা স্কুলে দিতে পারলে, বাংলাদেশের স্কুলগুলো হয়ে উঠবে মজার এক জায়গা। প্রাথমিক স্কুল থেকে আর ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়বে না। বাচ্চারা তো তাদের কাজ ঠিকমতোই করছে। মন দিয়ে পড়াশোনা আর চমত্কার সব রেজাল্ট করছে! আর আমরা বড়রা, আমাদের কাজ করব না?
ড. মোহাম্মদ জাকিউল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
zakiislam.mail@gmail.com
কিন্তু আমাদের দেশের স্কুলগুলোর দিকে একটু তাকান, দেখবেন, এগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি এখানে স্কুলের ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই: ১. কীভাবে স্কুল-ভবনের বাইরের জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো যায়। ২. স্কুলের ডিজাইনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের সুযোগ থাকার প্রয়োজনীয়তা। ৩. স্কুলে এমন একটা জায়গা থাকার প্রয়োজনীয়তা, যেখানে সব শিক্ষার্থী মিলিত হতে পারবে।
প্রথমত, স্কুল বলতে আমরা শুধু স্কুল-ভবনকেই বুঝি, অথচ স্কুলের চারপাশে খোলা জায়গাটাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারি। ঘনবসতিপূর্ণ শহর, যেমন ঢাকার স্কুলগুলোর খুব একটা খোলা জায়গা থাকে না। কিন্তু সাধারণত গ্রামাঞ্চলে স্কুলের চারপাশে খোলা জায়গা পাওয়া যায়। স্কুলের যে খেলার মাঠটা থাকে, তাকে আমরা ধরে থাকি শুধু টিফিনের সময় খেলার জায়গা হিসেবে। কিন্তু খুব সহজেই এই জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো যায় ঘরের বাইরের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে।
একদিক দিয়ে আমরা খুবই ভাগ্যবান, আমাদের দেশের আবহাওয়া এমন যে বছরের অন্তত ছয় মাস আমরা স্বচ্ছন্দে ঘরের বাইরে কাটাতে পারি, যা কি না অনেক গ্রীষ্ম বা শীতপ্রধান দেশে অসম্ভব।
এই বাইরের ক্লাসরুমগুলো করতে খুব একটা খরচের প্রয়োজন হয় না। কয়েকটা খুঁটি এবং টিন অথবা খড়ের চালাই যথেষ্ট। কদিন আগেই গাইবান্ধার কয়েকটা স্কুল ঘুরে দেখলাম, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী ক্লাসরুমগুলো অনেক ছোট, জায়গার বড় অভাব। বেচারা বাচ্চাগুলো চাপাচাপি করে বসে ক্লাস করছে। বাইরের এই ক্লাসরুমগুলো করতে পারলে জায়গার অভাব কিছুটা হলেও কমবে।
এই ক্লাসরুমগুলো শিক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের শেখার সুযোগ করে দেয়। বাচ্চারা যখন ছবি আঁকবে, তখন অন্ধকার ঘরে বসে কেন আঁকবে? ব্যাঙের জীবনের বিভিন্ন ধাপ বোঝার জন্য বইয়ের ছবি যথেষ্ট নয়। বাচ্চারা এই ক্লাসগুলোতে আসল ব্যাঙাচি দেখে ব্যাঙের জীবনের বিভিন্ন ধাপ শিখবে।
বাইরের এই ক্লাসরুমগুলোর আরেকটা ভালো দিক হচ্ছে প্রাথমিক স্কুলে যে বয়সের বাচ্চারা যায়, তারা ঘরের ভেতরের চেয়ে বাইরে সময় কাটাতে পছন্দ করে। স্বভাবতই আশা করা যায়, বাইরের এই ক্লাসরুমগুলো বাচ্চাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
এ তো গেল স্কুল-ভবনের চারপাশের খোলা জায়গা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার আলোচনা। এবার ভবনের ভেতর নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমাদের দেশের স্কুলগুলোর ডিজাইন পুরোনো ধাঁচের, এ ধরনের ডিজাইনের পেছনে মূল যে চিন্তা বা ধারণা তা হচ্ছে, একেকটা ক্লাসরুমে নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী বসবে এবং নির্দিষ্ট সময় তারা একজন শিক্ষিকার কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু শিখবে। কিন্তু বাস্তবে এভাবে পড়াশোনা হয় না। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন নমনীয়তার প্রয়োজন, তেমনি নমনীয়তার প্রয়োজন স্কুল-ভবনের ডিজাইনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্লাসরুমগুলো এমন করে ডিজাইন করা সম্ভব, যা কি না লেকচার শোনার জন্যও উপযোগী হবে, আবার শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করার জন্যও উপযোগী হবে। অল্প কয়েকটা পার্টিশন দেয়াল দিয়ে এটা করা সম্ভব, যা কি না শিক্ষার্থী বা শিক্ষকেরা ইচ্ছামতো সরিয়ে নিতে পারবে তাদের চাহিদা অনুযায়ী।
বাচ্চারা শুধু শিক্ষকের কাছ থেকেই শেখে না, তারা অনেক কিছুই শেখে তাদের কাছাকাছি বয়সের অন্য বাচ্চাদের কাছ থেকে। কিন্তু এর জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। এমন একটা জায়গা, যেখানে সব শিক্ষার্থী মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এখনকার স্কুলগুলোতে খুব সহজেই এ রকম একটা পারস্পরিক যোগাযোগের জায়গা ডিজাইন করা সম্ভব। বাচ্চারা এই জায়গায় মিলিত হতে পারবে, কথা বলতে পারবে, শিখতে আর একে অন্যকে শেখাতে পারবে।
মোট কথা, স্কুলের পরিবেশ হওয়া উচিত এমন, যেখানে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে। যেখানে বাচ্চারা খেলতে খেলতে শিখবে। কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন মানুষের জন্য চাপিয়ে দেওয়া কোনো জিনিস হওয়া জরুরি নয়। আমরা এভাবেই শিখি। কিন্তু
এই জ্ঞান অর্জন ঠিকমতো হওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ।
উল্লিখিত বাইরের ক্লাসরুম, স্কুল-ভবনের ডিজাইনে নমনীয়তা এবং শিক্ষার্থীদের মিলিত হওয়ার জায়গা স্কুলে দিতে পারলে, বাংলাদেশের স্কুলগুলো হয়ে উঠবে মজার এক জায়গা। প্রাথমিক স্কুল থেকে আর ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়বে না। বাচ্চারা তো তাদের কাজ ঠিকমতোই করছে। মন দিয়ে পড়াশোনা আর চমত্কার সব রেজাল্ট করছে! আর আমরা বড়রা, আমাদের কাজ করব না?
ড. মোহাম্মদ জাকিউল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
zakiislam.mail@gmail.com
No comments