চরাচর-'চিতাবাঘ মিতা আমার' by ইশতিয়াক হাসান

শিকার করতে গিয়েছিলাম পাহাড়ে। কাছেই মিয়ানমারের সীমানা। হঠাৎই বনের মধ্যে দেখি দুটি বাঘ। হলদে শরীরে কালো কালো ফোঁটা। দেখতে ভারি সুন্দর। ভাবলাম তেড়ে আসবে। কিন্তু না, উল্টো আমাদের দেখে পালিয়ে গেল।' এভাবেই বান্দরবানের মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় চিতাবাঘ দেখার ঘটনা বর্ণনা করেছিল এক মারমা মাঝি।


একসময় বাংলাদেশের অনেক বনেই দেখা মিলত এদের। ছিল ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়ও। এমনকি আজ থেকে বছর ষাটেক আগেও ঢাকার উত্তরা আর মিরপুরে চিতাবাঘ শিকারের কথা বলেছেন এনায়েত মওলা তাঁর 'যখন শিকারি ছিলাম' বইয়ে। মধুপুরের গড় তো ছিল চিতাবাঘের আড্ডাখানা। রাত হয়েছে আর মধুপুর জঙ্গলের আশপাশে বাস করা মানুষ চিতাবাঘের রক্ত পানি করা গর্জন শুনবে না, এটাই অস্বাভাবিক ছিল। স্বাধীনতার ঠিক পরপরও চিতাবাঘ ছিল মধুপুরে। তবে এখন চিতাবাঘ হারিয়ে গেছে মধুপুরসহ বাংলাদেশের বেশির ভাগ বন থেকেই।
চিতাবাঘের যে উপপ্রজাতিটি বাংলাদেশে দেখা যায়, সেটা পরিচিত ইন্ডিয়ান লেপার্ড নামে। এদের দেখা মেলে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে। সাধারণত মাথাসহ শরীরের দৈর্ঘ্য ২০০ সেন্টিমিটার আর লেজের দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার। খাদ্যতালিকায় আছে মায়া হরিণ, বুনো শুয়োর, খরগোশ, এমনকি পাখিও। লোকালয়ের কাছে থাকে যেসব চিতাবাঘ, তাদের মেন্যুতে থাকে কুকুর আর গৃহপালিত পশুও।
বন ধ্বংস আর নির্বিচার শিকারের কারণে বাংলাদেশে এদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা কিছু বনে এরা এখনো সামান্য সংখ্যায় টিকে আছে। সেখানকার গভীর বনে বাস করা আদিবাসীরা এখনো মাঝেমধ্যে চিতাবাঘের দেখা পায়। কখনো কখনো গারো পাহাড় পাড়ি দিয়ে ভারতের বন থেকে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনায় চলে আসে চিতাবাঘ। মাঝেমধ্যে আসে পঞ্চগড়ের দিকেও। তবে এগুলোর কপালে ভালো কিছু জোটে না। এই তো সেদিনের কথা, পঞ্চগড় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া একটি চিতাবাঘকে পিটিয়ে মেরেছিল স্থানীয়রা। একসময় সিলেটের বন আর চা বাগানেও চিতাবাঘ দেখা যেত। এখন এসব এলাকায় কালেভদ্রে দেখা মেলে। মৌলভীবাজারের লাঠিটিলার বনে ঘুরে বেড়ানোর সময় অনেকের মুখেই চিতাবাঘ দেখার গল্প শুনেছি। এমনকি কেউ কেউ এর করাতচেরা ডাক নকল করেও শুনিয়েছেন। ধারণা করা যায়, লাঠিটিলা, রেমা-কালেঙ্গাসহ সিলেট বিভাগের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা বনে এরা এখনো টিকে আছে। বাংলাদেশের বনে এমনকি কালো চিতাও দেখা গেছে। শরীরে মেলানিনের আধিক্যে যেসব চিতাবাঘের গায়ের রং কালো হয় তারাই পরিচিত কালো চিতা বা ব্ল্যাক প্যান্থার নামে, তবে এরা আলাদা কোনো প্রজাতি নয়। বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী কালো চিতা দেখেছিলেন বছর বিশেক আগে বান্দরবানের আলীকদম এলাকায়। কিছুদিন আগে বড় মোদক যাওয়ার সময় আমাদের মারমা গাইড আংসু মারমার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ১৯৯০ সালের দিকে রেমাক্রি এলাকায় একটা কালো চিতা ফাঁদ পেতে মেরেছিল শিকারিরা। এক হিসাবে বাংলাদেশে এখন বাঘের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে চিতাবাঘ। এখনই এদের রক্ষায় এগিয়ে না এলে মধুপুরের গড় থেকে যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি গোটা দেশ থেকেই হারিয়ে যাবে চিতাবাঘ, যেমন হারিয়ে গেছে গণ্ডার কিংবা নীলগাই।
ইশতিয়াক হাসান

No comments

Powered by Blogger.