চলতি পথে-লালমাই পাহাড়ে একদিন by গাজীউল হক

বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।


দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।’
বাড়ির কাছে লালমাই পাহাড়। কুমিল্লার তথা পুরো দেশখ্যাত পাহাড় । এ পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসু যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। নিসর্গপ্রেমী কুমিল্লার পাখি-বিশেষজ্ঞ জামিল খানকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি ঘুরে দেখা এ পাহাড় দারুণভাবে মোহিত করেছে। যত দূর ভেতরে প্রবেশ করা গেছে, শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ। উঁচু-নিচু টিলার মাঝখানে জনপদের মানুষের বসবাস। পাখিদের কলধ্বনি, সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণী আর বৃক্ষরাজি দিয়ে বিধাতা নিজ হাতে সাজিয়েছেন এ পাহাড়। কুমিল্লায় বেড়াতে এলে নিশ্চিত লালমাই পাহাড় আপনাকে আচ্ছন্ন করবে। সারা দিন হাসি আর আনন্দে বেড়ানোর সুন্দর জায়গা এটি।
কুমিল্লার কোটবাড়ীর শালবন বিহার দেখে ময়নামতি জাদুঘর পার হলেই সালমানপুর পাহাড়ি এলাকা। সেখানেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। লালমাই পাহাড়ের সুউচ্চ টিলা আর সমতলের ৫০ একর জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। লালমাটির ওপর নির্মিত ইমারতের সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরে ওঠা যাবে, ততই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য লক্ষ করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুব পাশেই বনকুটির। পর্যটকেরা সারা দিন পাহাড় দর্শন করে এসে সেখানে একটু আয়েশ করেন। ওই পথ ধরে এগোলেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর দুই পাশের বৃক্ষরাজি মনকে দারুণ উজ্জীবিত করবে। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট আধাপাকা আর মাটির ঘর চোখ জুড়াবে। সঙ্গে কৃষকের সারি সারি সবুজ সবজির খেতও দেখা যাবে। পাহাড়ের একটি উঁচু চূড়ার নাম জামমূড়া। ওইখানেই আদিবাসী ত্রিপুরাদের বসবাস। প্রায় ১৫টি পরিবার সেখানে থাকে। বংশানুক্রমিকভাবে শত শত বছর ধরে তারা সেখানে অবস্থান করছে। কাঠ কেটে আর কৃষিকাজ করে ওরা জীবিকা নির্বাহ করে। আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসবে কত হাহাকারের গল্প। ওই পাহাড়ের শতবর্ষী ‘বুড়িমা’ খ্যাত সারদা দেবী ও রনি রানী ত্রিপুরা জানালেন, বিদ্যুত্ আর সড়ক হলেই পাহাড় আলোকিত হতো। জামমূড়ায় এখন আনারসের চাষ হচ্ছে। থোকা থোকা আনারস আদিবাসীদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথকে প্রশস্ত করেছে।
জামমূড়া থেকে নেমে চৌধুরীখলা ও রাজারখলা পার হলেই বড়ধর্মপুর এলাকা। বড়ধর্মপুরের গেছু মিয়ার বাড়ির পাশেই একটি ঝরনা আছে। সারা বছরই পাহাড়ি ওই ঝরনা দিয়ে পানি পড়ে। ওই পানি আশপাশের মানুষের তৃষ্ণা মেটায়। অত্যন্ত মিষ্টি ও সুপেয় ওই পানি পান করে আমাদের তৃষ্ণা মিটে গেল। আসার সময় এক বোতল পানিও নিয়ে এলাম। ওই ঝরনা পার হয়ে পৌঁছে যাই টাক্কুটিলায়। সেখানেই বছর পাঁচেক আগে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। টাক্কুটিলার ওপর থেকে উত্তর দিকে চোখ রাখলেই মন নেচে উঠবে। গুনগুন শব্দে বেজে উঠবে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা...।’ ওই টিলার অদূরে গ্যাস উদিগরণের মুখ। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধের সময় গ্যাসের মুখ সিলগালা করে দেয়। ফলে আর গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়নি। লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ এলাকার নাম চণ্ডীমূড়া। বরুড়া উপজেলাসংলগ্ন ওই অংশে প্রতিদিন শত শত মানুষের ঢল নামে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রায় সব ধর্মের মানুষের কাছে সেটি আকর্ষণীয় স্থান। ১৭৯টি সিঁড়ি মাড়িয়ে সমতল ভূমি থেকে ওই মন্দিরে উঠতে হবে। সেখানে পাশাপাশি দুটি মন্দির আছে। এগুলো হলো চণ্ডীমন্দির ও শিবমন্দির। পাহাড়ের কোলে প্রকৃতি সুষমামণ্ডিত মন্দিরের সুউচ্চ স্থান থেকে নিচে তাকালে দেখা যাবে, কেবলই সবুজ আর সবুজ; যা আপনাকে হাতছানি দেবে। সপ্তম শতাব্দীতে রানি প্রভাবতী দেবী মা মহাময়া চণ্ডীর পূজা করার জন্য মন্দিরটি গড়ে তোলেন। নির্জন প্রকৃতিতে এটি একটি অনন্য তীর্থস্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তা উন্মুক্ত থাকে।
লালমাই পাহাড়ের বেশির ভাগ এলাকা গহিন অরণ্য। শালবৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত ওই পাহাড়ে বহু প্রজাতির বনজ, ফলদ ও লতাগুল্ম বিদ্যমান রয়েছে। কাঁঠাল, বাঁশ, মেহগনি, পুরোনো তালগাছ ও কাঠগাছের অপূর্ব সমন্বয়ে ওই পাহাড়। চিরহরিত্ প্রজাতির গর্জন ও তেলসুরগাছও চোখে পড়েছে। রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এর মধ্যে রয়েছে বনরুই, শজারু, খরগোশ, গুইসাপ, শিয়াল, বেজি, কিছু মেছো বাঘ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। অন্ধকার নেমে এলেই ওরা লোকালয়ে বেরিয়ে আসে। দিনের আলোয় ওদের চোখে পড়েনি।
কুমিল্লা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে লালমাই পাহাড়ের অবস্থান। শহরের কান্দিরপাড় ও টমছম ব্রিজ থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে ওই পাহাড়ে যাওয়া যায়। তবে গহিন পাহাড়ে প্রবেশ করতে হলে মোটরসাইকেলের বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত বাহন থাকলে আরও সুবিধা। যাওয়ার সময় খাবার ও পানি নিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.