কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেই কলম ধরতে হলো। গত ২৭ জুন দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। নিবন্ধটি মোটামুটি বড়ই। মোটামুটি বললাম। কিন্তু নিবন্ধটি আরো দীর্ঘ হতে পারত। তিনি অনেক বিষয় কেবল স্পর্শ করে গেছেন, ব্যাখ্যা করলে একটা বড়সড় লেখাই হতে পারত এবং হলে বোধ হয় ভালোই হতো।


তবে তিনি সহজ-সরলভাবে যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছেন, তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হয়েছে। যে 'ভালোর দল' সম্পর্কে তিনি কথা বলেছেন, তাদের আমরা চিনি। তাদের সম্পর্কে অনেক কথাই আমাদের মনে জমা আছে। আমরা তো আর পার্টি করি না, পার্টির হোমরাচোমরা নেতাও নই। তাই দূর থেকে যেভাবে পারি 'ভালোর দল' সম্পর্কে কথা বলি। কাজের কাজ কিছুই হয় না, কেবল শত্রুতা বাড়ে; কিন্তু পার্টির যাঁরা হোমরাচোমরা, তাঁরা কেন সেসব কথা বলতে ব্যর্থ হন, যে কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বলতে হলো! নাকি তাঁরা ইচ্ছা করেই বলেন না! তাঁরা কি সত্যিই কিছু দেখেন না, নাকি চোখ থাকতেও অন্ধ এবং কান থাকতেও কিছু শুনতে পান না। অথচ তাঁদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা পড়েই তো বুঝলাম যে সবই দেখেন ও শোনেন। শত কাজের মধ্যেও তাঁকেই নিজ হাতে কলম ধরতে হলো। পার্টির যাঁরা প্রশ্রয়প্রাপ্ত জ্ঞানীজন আছেন, তাঁরাও কী এ ক্ষেত্রে কার্যকর কিছু করতে পারছেন না! মনে হয় তাই। আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার পক্ষের যাঁরা, তাঁরা বড্ড বেশি 'নিরপেক্ষ' হয়ে কথা বলেন এবং লেখেন। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পক্ষে তাঁদের কলম ও জিভ কেমন যেন আড়ষ্ট থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ টানার চেষ্টা করি। নারীনীতি নিয়ে যখন মোল্লারা খুব হৈচৈ করলেন, তখন মন্ত্রী-নেতা-বুদ্ধিজীবীদের তেমন শক্তভাবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে দাঁড়াতে দেখলাম কোথায়? অথচ 'ভালোর দল' এবং চিহ্নিত বিরুদ্ধাচারীরা কিন্তু নানা কথার শোরগোল তুলে মাঠ-পত্রিকা-টক শো গরম করে ফেললেন। তৃণমূলের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম_তোমরা বা তোমাদের নেতারা কেন নারীনীতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সমর্থনে সাধারণ মানুষকে সচেতন করছ না এবং স্পষ্ট ব্যাখ্যায় সবাইকে প্রকৃত সত্য জানাচ্ছ না। সদুত্তর পাইনি। খোপের (নিজস্ব বলে পরিচিত) বুদ্ধিজীবীরাও অলআউট সাপোর্ট দিয়ে খুব একটা কথা বলেননি দেখে বিস্মিত হয়েছি। সংবিধান সংশোধনীবিষয়ক বিতর্ক নিয়েও ব্যাপারটি প্রায় তেমনই হয়েছে। পক্ষে যতটা লেখা এবং কথা বলার প্রয়োজন ছিল, ততটা বোধ হয় হয়নি। অথচ বিরুদ্ধবাদী যাঁরা, তাঁরা কিন্তু একজোটে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেমিনার, গোলটেবিল, পত্রিকার কলাম, টক শো এবং সামাজিক সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের গুষ্টি উদ্ধার করা হচ্ছে। যে কারণে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অনৈতিক ও অযৌক্তিকভাবে সংসদে না গিয়েও যে দাপট দেখাচ্ছেন, তা প্রতিহত করার জন্য তেমন পরিকল্পিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা কোথায়! আওয়ামী লীগ এবং সরকারের প্রচারের ব্যবস্থাটি গত আড়াই বছরে পোক্তভাবে তৈরি হয়নি। পক্ষের যাঁরা, তাঁদের ভেতর সমন্বয়ের অভাব। তবুও যাঁরা কলম ধরেন তাঁরা নিজ উদ্যোগেই কিছু লেখার চেষ্টা করেন। টক শোতে যাঁরা বসেন, তাঁরা প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তায়নের ভাষা এবং ছলচাতুরীপূর্ণ কথাবার্তার কাছে, গলাবাজির কাছে 'মাজুল' হয়ে যান। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যৌক্তিক জবাবদিহি করতে পারবেন কি? বছরখানেক আগে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম সরকার ও দলের জন্য 'থিংক ট্যাংক' তৈরি করতে। যাঁরা দেশে ও বিদেশে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে যৌক্তিক ও ইতিবাচক কথা স্পষ্ট ও জোরের সঙ্গে বলতে পারবেন, এই কাজটি দলের পক্ষ থেকেও গত আড়াই বছরে করা যেত। করা হয়নি। যার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই শেষমেশ কলম ধরে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে চাতুর্যের সঙ্গে জনগণকে 'সুগার কোটেড কুইনাইন' গিলিয়ে যাচ্ছেন। এই গোষ্ঠী সরবে ও নীরবে যেভাবে প্রপাগান্ডা চালায়, তা ক্রিকেট খেলার স্পিন বোলিংয়ের চেয়েও ভয়ংকর, গুগলি কিংবা দুসরার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে এখন যে মিথ্যা প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেও একই রকম ক্যাম্পেইন চালানো হয়েছিল। শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের সাফল্য ও সম্ভাবনা নিয়ে পরিসংখ্যান দিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, তা এত দিন সাধারণ মানুষের অজানা ছিল। তাঁর মন্ত্রী বাহাদুর ও দলীয় নেতারা এগুলো তাঁর মতো করে জানাননি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজ জীবনের ওপর সরকারি বৈষম্যের যে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন, তাতে উদ্বিগ্ন হতেই হয়। সেনা সদরে বিরোধীদলীয় নেতার বাড়ি বিষয়ে যত হৈচৈ হয়েছে, তার তুলনায় শেখ হাসিনার বিষয়ে তো কিছুই হয়নি। একই কথা বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার জন্য বরাদ্দ বাড়ির বিষয়েও প্রযোজ্য। শেখ হাসিনা তাঁর নিবন্ধে বর্তমান সরকারের আড়াই বছরের অর্জন এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছানোর পরিকল্পনা ও চলমান কর্মসূচির যে খতিয়ান দিয়েছেন, তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন প্রথম সরকারের সময়কার অর্জনের অনেক কথাও উল্লেখ করেছেন। কথাগুলো সত্য ও জনকল্যাণকর। অথচ এসব জনকল্যাণমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রচার নেই। সরকারের নিজের ঢাক একখানা আছে, যার নাম বিটিভি। কিন্তু সেখানে দিনরাত যা বলা হয় এবং দেখানো হয়, তা আদৌ জনমনে প্রভাব ফেলে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ হয়। সেখানে সরকারের সমর্থনে অজস্র অনুষ্ঠান হয়, অথচ সাধারণ মানুষের মনে সেসব তেমন দাগ কাটে বলে মনে হয় না। অথচ শক্তিশালী এই প্রতিষ্ঠানটিকে কত ভালোভাবেই না ব্যবহার করা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিবন্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং পরবর্তী কয়েক বছরে ভালোর দলের ভূমিকা নিয়ে যা বলেছেন, তা সত্য। সেসব তো আমাদের নিজের চোখেই দেখা। তিনি ১৯৫৮-পরবর্তীকালের নিজ অভিজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরে যে অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। শেখ হাসিনা বর্ণিত রাজনৈতিক 'চাচার' দল কিন্তু '৭৫ পরবর্তী সময়েও একই ভূমিকা পালন করেছে। ভালোর দলের মতো আওয়ামী লীগের অনেক 'চাচা' নেতাও কিন্তু তখন সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। উপরন্তু খন্দকার মোশতাক, জিয়া অথবা ঘাতকদের কৃপালাভের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার বিষয়টি কি সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব! তবে হ্যাঁ, সেই দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তাঁর দুই সন্তানের জন্য গোপনে কাজ করেছেন অসংখ্য কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। কেউ কেউ দেশত্যাগ করে দেরিতে হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সে দিনের সেসব চেনা প্রতিবাদী মুখগুলো আজ দল ও নেত্রীর কাছাকাছি খুব একটা দেখি না। কিন্তু জানি যে তাঁরা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও নেত্রী শেখ হাসিনার শুভাকাঙ্ক্ষী। অথচ এখন যাঁরা অতি উচ্চ রব ও উচ্চাসনে আসীন, তাঁদের কাজকর্ম, কথাবার্তার ধরনে স্বস্তি পাওয়া যায় না। আমার কেবলই সন্দেহ হয়, এঁরা বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত কাগজের নোটকেই বেশি পছন্দ করেন। শেখ হাসিনার চিহ্নিত ভালোর দলের বিপক্ষে এঁদের অবস্থান শক্ত নয়। নিজেদের ভেতর ঐক্য ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রটিও ভীষণ নড়বড়ে। নিবন্ধের শেষে প্রধানমন্ত্রী সঠিক বিবেচনায়ই বলেছেন, দেশের গরিব মানুষই ভালোর দল। এরা বাণিজ্যের পণ্য। ভাগ্যহত এসব গরিব মানুষের জন্য তিনি জীবন বাজি রেখে কাজ করার অঙ্গীকারও করেছেন। কাজটি দুরূহ এবং তাঁর একার পক্ষে সেটা করা কঠিন। সেই জন্য ভেতর-বাইরে তাঁকে অবশ্যই বেছে নিতে হবে বিশ্বস্ত, মেধাসম্পন্ন, নিবেদিতপ্রাণ, নিঃস্বার্থ সহকর্মী। যাঁরা তাঁর হাল ধরা নৌকাকে শত প্রতিকূলতার ভেতর পেঁৗছে দেবে কাঙ্ক্ষিত সুবর্ণ বন্দরে।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.