শিবের গীত-জন্মদিন পালন by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ঝগড়াপুর নামক দেশের মাটির নিচে কিছু মহাদেশীয় বিচ্যুতিরেখার অবস্থান, যেগুলোর কারণে মাঝেমধ্যে মাটিতে দুলুনি লাগে; দালানকোঠা থরথর কাঁপে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে রয়েছে যে এক বিরাট বিচ্যুতিরেখা, তাতে মাটির মহাদুলুনির আগেই সবকিছু ভেঙে পড়ে একদিন দেশটি শেষ হয়ে যাবে, এ রকম ধারণা দেশতত্ত্ববিদদের।


ঝগড়াপুরের দুই প্রধান দল, এ দল ও বি দলের পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। এ দল ক্ষমতায় থাকলে বি দল হামলে পড়ে তার ওপর, সঙ্গে থাকে সারমেয়কে দোলায় যে লেজ, সেই জে দল। আর বি দল ক্ষমতায় থাকলে এ দল আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে যায় তার দিকে। মাঝেমধ্যে সঙ্গে থাকে শূন্য কলসির মতো বড় আওয়াজ করতে পারদর্শী সি দল। দুই দলের ঝগড়াপ্রীতি এমনই যে একটি দল ক্ষমতায় থাকলেও অন্য দলকে ছেড়ে কথা কইতে চায় না। ফলে দেশটির আকাশে সব সময় থাকে আগুনের হলকা, বাতাস থাকে উত্তপ্ত। এই উত্তাপে নদী শুকিয়ে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, পাকা ধানের শিষ পুড়ে যায়। আর সেই সুযোগে সান্ত্রী-কোটাল তুলে নেয় ঝগড়াপুরের দেখভালের দায়িত্ব। তাতে ঝগড়া কিছুদিনের জন্য বন্ধ হলেও এর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়।
সম্প্রতি বি দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বুড়োদের দিয়ে অনেক তো ঝগড়া হয়েছে, এখন দরকার তেজি তরুণ নেতৃত্ব। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের নেতৃত্বকে কতটা তরুণ বলা যায়—বিশেষ করে কাগজে যখন ওঠে ‘পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ রিকশাচালক নিহত’—তা বিবেচনায় নিয়েও দলটির এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে ঝগড়াপুরবাসী। তারা বুঝেছে তেজি গলার নেতৃত্ব না এলে ঝগড়াটা তেমন জমবে না। তারা দেখেছে, প্রতিদিনই ঝগড়ার নতুন নতুন বিষয় সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন, প্রতিবেশী দেশ বাগড়াপুর যেখানে ঝগড়াপুরের নদী খেয়ে ফেলছে, অথচ ঝগড়াপুরের পানিদারিদ্র্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ‘খাইতে দেন, নদী তো ওগো অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
বি দল তরুণ নেতৃত্বকে ঝগড়াপুরের সিংহাসনে দেখতে পাচ্ছে, ফলে ঘটা করে নেতৃত্বের জন্মদিন পালন করেছে। না, তরুণ নেতৃত্বের একাধিক জন্মদিন নেই এবং কোনো বড় শোক দিবসকে জন্মদিন পালনের জন্যও দলটি বেছে নেয়নি। এ জন্য দলটি প্রশংসিত হয়েছে। সারা দেশে ১১ দিন ধরে নতুন নেতৃত্বের জন্মদিন পালন হলো; মিডিয়াতে নেতৃত্বের জয়গাথা গাইলেন প্রাক্তন উপাচার্য থেকে নিয়ে বর্তমান দলীয় বুদ্ধিজীবীরা। শহরে শহরে বিশাল মিছিল হলো, কেক কাটা হলো। নেতৃত্বকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি হলো, তা দেখানো হলো; নেতৃত্বের ছবিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেল। ১১ দিন ধরে জন্মদিন পালনের নতিজাটা না বুঝলেও ঝগড়াপুরবাসী উল্লসিত হলো। কেউ কেউ দাবি জানাল পুরো এক মাস, চাই কি, এক বছর ধরে জন্মদিন পালিত হোক। আর এতেই এ দল ঝগড়া করতে শুরু করল। তারা বলল, ‘তরুণ নেতৃত্বের ওপর বিদেশে টাকা পাচার ও দুর্নীতির মামলাসহ এতগুলো মামলা, অথচ বি দল বলে কিনা এই নেতৃত্বই ভবিষ্যৎ কর্ণধার ঝগড়াপুরের?’ তারা আরও বলল, ‘বাতাসধামের কাহিনি কি দেশবাসী ভুলে গেছে? নাকি দশ হাতি বোঝাই অস্ত্র মামলা?’
আমি ঝগড়াপুরের মানুষ নই বলে ‘বাতাসধাম’ ও ‘দশ হাতি অস্ত্র’ প্রসঙ্গগুলো ধরতে অপারগ। তার পরও এ দলের অভিযোগ নিছক অসূয়াপ্রসূত বলে আমার মনে হয়েছে। ঝগড়াপুর কি সিঙ্গাপুর যে এর নেতৃত্বকে সার্ফ এক্সেলে ধোয়া হতে হবে? দুর্নীতির মামলা যদি না-ই থাকে নেতৃত্বের ওপর, তাহলে দুর্নীতিবাজদের সেই নেতৃত্ব চিনবে কীভাবে? কীভাবে দুর্নীতি আটকাবে? আর বিদেশে টাকা পাচার মানে কী? এ তো বিনিয়োগ! ঝগড়াপুরের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যা অবস্থা, তাতে এই বিনিয়োগ থেকে পাওয়া লাভ যোগ হলে দেশটার কত যে উপকার হবে, ভেবে দেখুন তো?
তরুণ নেতৃত্বকে নিয়ে তৈরি করা তথ্যচিত্রটি দেখার আমার সুযোগ হয়নি, কিন্তু সাবেক উপাচার্য-বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে তারিফ করছেন, বি দলের পেশাজীবী থেকে নিয়ে ঝগড়াজীবীরা যেভাবে মারহাবা মারহাবা করছেন, তাতে আমি নিশ্চিত, নেতৃত্বকে যে ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ বলা হচ্ছে, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এই নেতৃত্বের জন্মদিন যদি ঘটা করে উদ্যাপন করা না-ই হয়, তাহলে কি তা করা হবে, ধরুন, আমের আকার নামক পরাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বাবামার?
এ দলের উচিত ছিল তরুণ নেতৃত্বের জন্মদিনে একটা ১১ ফুট লম্বা চমৎকার বার্থ ডে কার্ড পাঠানো। তাতে অন্তত ঝগড়াপুরের ঝগড়া কিছুটা কমত।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.