চারদিক-ভয়

আমাদের চোখের লোনা জলে আরেকটি সমুদ্র হোক। সেই সমুদ্রের কী নাম হবে? হাজার হাজার আপনজন হারানোর ব্যথায় চোখ দিয়ে যে অনবরত লোনা পানি ঝরছে প্রতিদিন, সেই লোনা পানি দিয়ে তৈরি সমুদ্রের কী নাম দেওয়া যায়? চলে গেলেন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন।


এভাবে প্রতিদিন ১০-১৫ জন মাসুদ, মুনীর, সায়মা, রেশমারা চলে যাচ্ছে। কোনো না কোনোভাবে। পানিতে ডুবে, সড়ক দুর্ঘটনায়, পুলিশের পিটুনিতে, গণপিটুনিতে, চিকিৎসকের অবহেলায়, আরও কত ভাবে।
আমি আমার ২০ বছর ছয় মাসের সন্তানকে হারিয়েছি চিকিৎসকদের চরম অবহেলায়, ২০০৯ সালে। রোজ কাঁদি সন্তানের জন্য। কিন্তু কই, চোখের জল তো ফুরায় না। সন্তান হারিয়ে নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি স্বপ্নবিহীন-আনন্দবিহীন এই পৃথিবীতে। আমরা এমন একটা দেশে বাস করছি, যেখানে মৃত্যুটাই স্বাভাবিক আর বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক। এ দেশে কি কারও বিচার হয় না? এ দেশে বিচার থাকুক না থাকুক, আছে শুধু ভয়। আমরা সন্তানের মায়েরা যেন একেকটা মানসিক রোগী। না হলে সন্তানদের নিয়ে এত ভয় কেন? সেই ছোটবেলায় যখন সন্তান জন্ম নিল, তখন ছিল একধরনের ভয়—দুধে ভেজাল আছে কিনা, পানি ঠিকমতো ফুটিয়েছে কিনা, বাচ্চা খাট থেকে পড়ে গেল কিনা, এত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো ঠিক হচ্ছে কিনা, আরও কত ভয়। আস্তে আস্তে সন্তান বেড়ে উঠল। এখন আরেক ভয়। সব কাজ ফেলে সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, আবার নিয়ে আসা। একা ছাড়া যাবে না, রাস্তায় সাইকেল চালানো যাবে না; কোনো খেলার মাঠ নেই, বাসায় সাইকেল চালাও। এরপর আরেকটু বড় হলো ছেলে। কলেজে যাবে। মাকে এবার সন্তানকে একা ছাড়তেই হবে। শুরু হলো নতুন ভয়। ছেলে ঠিকমতো কলেজে পৌঁছালো তো? চারটা বেজে গেল, ছেলে এখনো এল না কেন? রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা দিল না তো! কোনো বিপদ হলো না তো, কেউ অপহরণ করে নিয়ে গেল না তো! একটা ভালো চিন্তাও তো মাথায় আসে না। মায়েদের এই ভয়ের নামই তো ‘মানসিক রোগ’।
ছেলে আরেকটু বড় হলো। এবার যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও ভয়। ছেলে যাদের সঙ্গে মেশে, তারা সবাই ভালো তো! ভার্সিটিতে অনেক ছেলেই শুনি নানা অপকর্ম করে, ট্যাবলেট বিক্রি করে। আরও কত কী! পত্রিকার পাতায় মাঝেমধ্যে আসে, পড়লে শরীর শিউরে ওঠে। ভয় হয়, আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো! আবার ভয়, ছেলে ১০০ টাকা চাইলে দিই ৫০ টাকা। ছেলের রাগ হয়, মাকে ভুল বোঝে। হয়তো ভাবে, মা-বাবা এমন করে কেন? টিভিতে মাঝেমধ্যে টক শো হয়। চিকিৎসক-মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আপনার ছেলেকে বেশি টাকা-পয়সা দেবেন না। সব সময় খেয়াল করবেন, সে টাকা কোথায় খরচ করে। খেয়াল করবেন, সে কাদের সঙ্গে মেশে, তাদের কাছে টাকা ধার করে কিনা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত জেগে থাকে। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। এতেও ভয়, ছেলে নেশাটেশা করে না তো। কারণ, নেশার উপকরণ আজ নাগালের মধ্যে।
কোথায় যাবে আমাদের সন্তানেরা? খেলার মাঠ নেই, বিনোদনের জায়গা নেই, শেষ ভরসা ইন্টারনেট। আস্তে আস্তে সন্তানের কাছে ছোট হয়ে আসে পৃথিবী। তারা আস্তে আস্তে অসামাজিক হয়ে ওঠে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতে চায় না। ভুল বোঝে আত্মীয়স্বজন। কী করবে মা-বাবারা? ঘর থেকে বের হলে কে দেবে এদের নিরাপত্তা। হয়তো একটু বিকেলে বাইরে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে এল। মা ভয়ে ছেলেকে ফোন করল, ‘বাবা, তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি বাসায় এসো।’ ছেলে লজ্জায় পায়। বন্ধুরা বলে, একটু রাত হলেই তোর মায়ের ফোন করা শুরু হয়ে যায়। ছেলে মাকে ভুল বোঝে। বলে, ‘মা, বড় হই নাই? এখনো এভাবে আমাকে আগলে রাখতে চাও?’ ছেলেকে বলে বোঝাতে পারি না বাবা, আমাদের এই দেশে কোথাও তুমি বা আমরা নিরাপদ নই। তাই আজ সন্তানদের মায়েরা একেকটা মানসিক রোগী। ভয় নামের একটা রোগ চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের তাড়া করে বেড়ায়।
প্রচণ্ড গরমে ছেলে ভার্সিটিতে জ্ঞান হারাল। বন্ধুরা নিয়ে গেল বড় হাসপাতালে। আমিও ততক্ষণে পৌঁছালাম। প্রায় দুই ঘণ্টা চিকিৎসকেরা তাকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখল। তারপর সাত দিন বিশেষ ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখল। সাত দিন পর সন্তান আমাদের ছেড়ে চলে গেল না-ফেরার দেশে। এই বাংলাদেশেই এটা সম্ভব। ছেলে চলে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছেলের বাবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো একটা বিরাট অঙ্কের কাগজ। ছেলের জীবনের বিনিময়ে পেলাম সে কাগজ। তারপর আরেক গল্প। তাড়াতাড়ি টাকা পরিশোধ করেন। বিনিময়ে লাশ নিয়ে যান। সে কী অস্থিরতা! ‘পিতার কাঁধে ছেলের লাশ’। নির্মম এই সত্যটা বুঝে বাবাকে একটু কাঁদতেও সময় দেয়নি তারা। তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যান। বেড খালি করুন। কারণ, খালি বেডটা তো তাদের বড় দরকার। একদিকে বাবার চোখে প্রচণ্ড বেদনার রক্ত ঝরা অশ্রু, অন্যদিকে টাকা পরিশোধ করে লাশ নিয়ে যাওয়ার তাড়া। কী কঠিন সময় পার করেছে এক সন্তানহারা পিতা। আজ সন্তানকে নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। সন্তান চলে গেছে ভয়হীন দেশে। তারেক মাসুদেরও নাকি খুব ভয় হতো গাড়ি জোরে চালালে। তিনি ৪০ মাইলের বেশি বেগে গাড়ি চালাতে নিষেধ করতেন। আর ভয় নেই। আজ তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর—সবাই ভয়হীন দেশের বাসিন্দা। সবকিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ঝাপসা হয়ে আসছে প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি। শুধু আত্মার কাছাকাছি মানুষগুলো নীরবে লোনা জল ফেলবে যত দিন বেঁচে থাকবে।
ফারহানা ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.