শেকড়ের ডাক-ক্রমেই প্রকট হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট by ফরহাদ মাহমুদ
একসময় নদী ছিল আমাদের সম্পদ। নদীর পলি জমে প্লাবনভূমি উর্বরতা পেত, নদী ও প্লাবনভূমি ছিল মাছের অফুরন্ত ভাণ্ডার, নদীপথে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে যাওয়া যেত। নদীমাতৃক দেশ হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই পরিচয় আজ মৃতপ্রায়। অনেক নদী ইতিমধ্যে মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রধান নদীগুলোও আজ মরতে বসেছে।
মানুষ নদী ভরাট করে বাড়িঘর বানাচ্ছে, নদী দখল করে চাষাবাদ করছে। ফলে বর্ষায় উজান থেকে আসা পানি ঠিকমতো নামতে না পারায় বন্যা অবধারিত হয়ে উঠেছে। তাই বাংলাদেশের পরিচয় হয়ে যাচ্ছে বন্যাকবলিত, সাহায্যপ্রার্থী ও দুর্গত মানুষের দেশ হিসেবে। ছোট হোক আর বড় হোক, বন্যা প্রতিবছরই আঘাত হানছে। গতবছরও আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তিস্তা-যমুনার অববাহিকা প্লাবিত হয়েছিল। বন্যায় মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্ভোগ পোহায় দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের ফসলহানি হয়, বন্যাপরবর্তী রোগ-মহামারিতে স্বাস্থ্যহানি হয়। দারিদ্র্য আরো বেশি করে তাদের চেপে ধরে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে এবং দুটি বড় বন্যার মধ্যবর্তী সময়সীমা ক্রমেই কমে আসছে। বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে, নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। কারণ বর্ষাকালে বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তার প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে উজানে থাকা দেশগুলোর পার্বত্য অঞ্চল থেকে। এ পানি আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। আবার আমাদের নদীগুলো ক্রমেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় বা নদীগুলোর গভীরতা না থাকায় নদী সে পানির কিয়দংশও ধারণ করতে পারে না। তখন নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয় বা ফসলি জমি ডুবিয়ে দেয়। আবার খাল, বিল, জলাশয় ক্রমাগতভাবে ভরাট হওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির পানিও বন্যার মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
অপরদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমেই বাড়ছে। যেমন বাড়ছে সংখ্যায়, তেমন বাড়ছে তীব্রতা বা ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকেও। জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, কেবল ২০১০ সালেই বিশ্বে চার কোটি ২০ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। আর এদের উদ্বাস্তু হওয়ার প্রধান কারণ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশে ২০০৭ ও ২০০৯ সালে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। সেগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ এখনো পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। এক সপ্তাহ আগে বঙ্গোপসাগরে ছোটখাটো একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করেছিল। তার প্রভাবে সাগর কিছুটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সে সময় পূর্ণিমা থাকায় জোয়ারের মাত্রা আরো কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। আর তাতেই প্লাবিত হয়েছিল টেকনাফ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূল। অনেক জায়গায় মাইলের পর মাইল উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। প্রবল বেগে ঢুকে পড়ে সমুদ্রের নোনা পানি। তাতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বহু বাড়িঘর ধসে পড়ে। বহু গবাদিপশু ভেসে যায় স্রোতের টানে। আউশ ধান, পানের বরজ, সুপারির বাগানসহ মানুষের সহায়-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ বন্যার প্রকোপও বাড়ছে। নদী দিয়ে আসা পানির চূড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে সাগর। সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নদীর পানি মোহনায় গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পানির গতি থেমে যায়। উজানের পানির সঙ্গে আসা পলি তখন সাগরে না গিয়ে নদীগুলোতেই বেশি করে জমতে থাকে। এতে নদী ভরাট প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হয় এবং পুনরায় বন্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়। কাজেই বাংলাদেশে বন্যা সমস্যা মোকাবিলা করার একটিই উপায় আছে, তা হলো নদীগুলোকে বাঁচানো। এ জন্য দুটি কাজ করতে হবে। এক. পলিবাহিত কারণ ছাড়া নদী ভরাটের অন্য সব প্রক্রিয়া ঠেকানো। দুই. ড্রেজিং বা খননের মাধ্যমে নদীর গভীরতা বা নাব্যতা বাড়ানো। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে প্রচলিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রথম কাজটি করা সম্ভব। দ্বিতীয় কাজটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এর কোনো বিকল্প নেই।
যত দূর জানা যায়, ব্রিটিশ ভারতেও ড্রেজারের একটি বড় বহর ছিল, নদীগুলো নিয়মিত খনন করা হতো। নদীতে চলাচলকারী নৌযানগুলো থেকে টোল আদায় করে খননের ব্যয় মেটানো হতো। অথচ তখন আমাদের নদীগুলোতে এত বেশি পলি আসত না। কারণ উজানের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে তখন প্রচুর গাছপালা ছিল। সেখানে ভূমিক্ষয় কম হতো, ফলে পলিও কম আসত। এখন উজান থেকে যেমন অনেক বেশি পলি আসছে, তেমনি দেশের ভেতরেও ভূমিক্ষয় অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে ১৫-১৬ কোটি মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পবর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্যের সবই গিয়ে পড়ছে নদীতে। ফলে নদী দ্রুত ভরাট হচ্ছে। অথচ এখন নদী খননের কোনো উদ্যোগই নেই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমরা কোনো ড্রেজার পাইনি। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালের মধ্যে সাতটি ড্রেজার কেনা হয়েছিল। এর পর গত ৩৫ বছরে আর কোনো ড্রেজার কেনা হয়নি। সাধারণভাবে একটি ড্রেজারের আয়ু ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। সে ক্ষেত্রে কার্যকর আয়ুসম্পন্ন কোনো ড্রেজারই এখন দেশে নেই। পুরনোগুলোকেই কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। তার পরও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাবি্লউটিএ) উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে, সোজা কথায় জ্বালানির অভাবে সেই ড্রেজারগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। কেবল ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এগুলোর সামান্য ব্যবহার দেখা যায়।
নিকট-অতীতে নদী খনন না হলেও নদীশাসনের নামে অনেক অপকর্ম হয়েছে। বাঁধ ও স্লুইস গেটের মাধ্যমে স্থানে স্থানে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ফলে যে পলি আগে প্লাবনভূমিতে গিয়ে জমা হতো, তা-ও নদীতেই জমা হতে থাকে। এতেও নদী ভরাট প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। আশির দশকে ফ্লাড অ্যাকশন প্লানের (ফ্যাপ) আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে বাঁধ নির্মাণে। সে সময় দেশ ও বিদেশের বহু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ এর পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বাঁধ না দিয়ে নদীগুলো খননের মাধ্যমে নাব্য করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার শাসকরা এসব পরামর্শ কানেই নেননি। এ অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কেবল নদীগুলোকেই মেরেছে তা নয়, বাংলাদেশ নামক দেশটিকেও বিপন্ন করে তুলেছে। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো পাল্টে যাওয়ায় দেশের জীববৈচিত্র্য বা প্রতিবেশগত (ইকোলজিক্যাল) ভারসাম্যও ব্যাপকভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। বাংলাদেশ একসময় মিঠাপানির মাছের প্রজাতির দিক থেকে সারা বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ছিল। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ছিল ছয় শতাধিক। আজ সেই সংখ্যা ২০০-এ নেমে এসেছে। তার মধ্যেও অনেক প্রজাতির মাছের সংখ্যা এত কম যে অচিরেই সেগুলো বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। কারণ মিঠাপানির অনেক মাছ নদীতে থাকলেও বর্ষায় প্রজননের সময় প্লাবনভূমিতে চলে আসে। অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে সেই প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। একদিকে খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া, আরেক দিকে প্রজননচক্র ব্যাহত হওয়া_দুটোই দেশের মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
আশার কথা, বর্তমান মহাজোট সরকার এ ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ড্রেজার ২০১২ সাল নাগাদ দেশে পেঁৗছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আরো ১৭টি ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া চলছে। ভারতও বাংলাদেশের নদীগুলোর খনন কাজে ও ভাঙন রোধে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। ইতিমধ্যেই ২৫টি ড্রেজার দিয়ে সীমান্তসংলগ্ন ইছামতী নদীর খননকাজ তারা সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশও নদী খননের দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যাতে ব্যয় হবে এক হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে ৫০টি নদীপথের খনন কাজ সম্পন্ন করা হবে। বড় নদীগুলো বিআইডাবি্লউটিএ-র আওতায় থাকলেও দেশের ছোটখাটো নদীগুলোর খনন কাজ পরিচালিত হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবোর আওতায়। তাদের কাছে ২০টি ছোট আকারের ড্রেজার রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে ছোট নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধিতে তা যথেষ্ট সহায়ক হবে। আবার বেসরকারিভাবেও অনেকে দেশি খনন-নৌকার সাহায্যে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। এর পরিমাণও নেহাত কম নয়। তবে এ ধরনের বালু উত্তোলনের ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। কারণ তারা নদীর কোনো একটি স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ বালু উত্তোলন করে এবং সেখানে হঠাৎ করে গভীরতা বেড়ে যায়। বর্ষায় সেখানে নদীর তলদেশে পানির ঘূর্ণি তৈরি হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী জনপদ নদীভাঙনের শিকার হয়। এ ব্যাপারেও সরকার একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তারা কোথায় কী পরিমাণ বালু তুলতে পারবে, তা ওই নীতিমালায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে সমন্বিত উপায়ে বালু উত্তোলন করা হলে তা খনন কাজেও সহায়ক হবে।
সমস্যা হচ্ছে, ১৯৯৮ সালের হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পলি আসে ৯০ লাখ ঘনমিটার। মেয়াদোত্তীর্ণ সাতটি ড্রেজার পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করলেও খনন করতে পারবে ৩০ লাখ ঘনমিটার। আরো তিনটি ড্রেজার এলে খননের পরিমাণ বাড়বে আরো ১৫ লাখ ঘনমিটার। তার পরও প্রতি বছর ৪৫ লাখ ঘনমিটার পলি নদীগুলোতে জমা হবে। কাজেই নদীগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হলে বছরে ৯০ লাখ ঘনমিটারের বেশি খনন কাজ চালাতে হবে।
প্রাথমিকভাবে এটি একটি ব্যয়বহুল কাজ। কিন্তু প্রতিবছর বন্যায় যে ফসলহানি হয়, জীববৈচিত্র্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তার তুলনায় সে ব্যয় খুবই সামান্য। বর্তমান সরকার দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে অতি ব্যয়বহুল সেই কাজটিকেই এগিয়ে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সাংবাদিক
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে এবং দুটি বড় বন্যার মধ্যবর্তী সময়সীমা ক্রমেই কমে আসছে। বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে, নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। কারণ বর্ষাকালে বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তার প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে উজানে থাকা দেশগুলোর পার্বত্য অঞ্চল থেকে। এ পানি আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। আবার আমাদের নদীগুলো ক্রমেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় বা নদীগুলোর গভীরতা না থাকায় নদী সে পানির কিয়দংশও ধারণ করতে পারে না। তখন নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয় বা ফসলি জমি ডুবিয়ে দেয়। আবার খাল, বিল, জলাশয় ক্রমাগতভাবে ভরাট হওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির পানিও বন্যার মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
অপরদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমেই বাড়ছে। যেমন বাড়ছে সংখ্যায়, তেমন বাড়ছে তীব্রতা বা ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকেও। জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, কেবল ২০১০ সালেই বিশ্বে চার কোটি ২০ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। আর এদের উদ্বাস্তু হওয়ার প্রধান কারণ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশে ২০০৭ ও ২০০৯ সালে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। সেগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ এখনো পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। এক সপ্তাহ আগে বঙ্গোপসাগরে ছোটখাটো একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করেছিল। তার প্রভাবে সাগর কিছুটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সে সময় পূর্ণিমা থাকায় জোয়ারের মাত্রা আরো কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। আর তাতেই প্লাবিত হয়েছিল টেকনাফ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূল। অনেক জায়গায় মাইলের পর মাইল উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। প্রবল বেগে ঢুকে পড়ে সমুদ্রের নোনা পানি। তাতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বহু বাড়িঘর ধসে পড়ে। বহু গবাদিপশু ভেসে যায় স্রোতের টানে। আউশ ধান, পানের বরজ, সুপারির বাগানসহ মানুষের সহায়-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ বন্যার প্রকোপও বাড়ছে। নদী দিয়ে আসা পানির চূড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে সাগর। সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নদীর পানি মোহনায় গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পানির গতি থেমে যায়। উজানের পানির সঙ্গে আসা পলি তখন সাগরে না গিয়ে নদীগুলোতেই বেশি করে জমতে থাকে। এতে নদী ভরাট প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হয় এবং পুনরায় বন্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়। কাজেই বাংলাদেশে বন্যা সমস্যা মোকাবিলা করার একটিই উপায় আছে, তা হলো নদীগুলোকে বাঁচানো। এ জন্য দুটি কাজ করতে হবে। এক. পলিবাহিত কারণ ছাড়া নদী ভরাটের অন্য সব প্রক্রিয়া ঠেকানো। দুই. ড্রেজিং বা খননের মাধ্যমে নদীর গভীরতা বা নাব্যতা বাড়ানো। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে প্রচলিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রথম কাজটি করা সম্ভব। দ্বিতীয় কাজটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এর কোনো বিকল্প নেই।
যত দূর জানা যায়, ব্রিটিশ ভারতেও ড্রেজারের একটি বড় বহর ছিল, নদীগুলো নিয়মিত খনন করা হতো। নদীতে চলাচলকারী নৌযানগুলো থেকে টোল আদায় করে খননের ব্যয় মেটানো হতো। অথচ তখন আমাদের নদীগুলোতে এত বেশি পলি আসত না। কারণ উজানের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে তখন প্রচুর গাছপালা ছিল। সেখানে ভূমিক্ষয় কম হতো, ফলে পলিও কম আসত। এখন উজান থেকে যেমন অনেক বেশি পলি আসছে, তেমনি দেশের ভেতরেও ভূমিক্ষয় অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে ১৫-১৬ কোটি মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পবর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্যের সবই গিয়ে পড়ছে নদীতে। ফলে নদী দ্রুত ভরাট হচ্ছে। অথচ এখন নদী খননের কোনো উদ্যোগই নেই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমরা কোনো ড্রেজার পাইনি। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালের মধ্যে সাতটি ড্রেজার কেনা হয়েছিল। এর পর গত ৩৫ বছরে আর কোনো ড্রেজার কেনা হয়নি। সাধারণভাবে একটি ড্রেজারের আয়ু ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। সে ক্ষেত্রে কার্যকর আয়ুসম্পন্ন কোনো ড্রেজারই এখন দেশে নেই। পুরনোগুলোকেই কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। তার পরও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাবি্লউটিএ) উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে, সোজা কথায় জ্বালানির অভাবে সেই ড্রেজারগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। কেবল ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এগুলোর সামান্য ব্যবহার দেখা যায়।
নিকট-অতীতে নদী খনন না হলেও নদীশাসনের নামে অনেক অপকর্ম হয়েছে। বাঁধ ও স্লুইস গেটের মাধ্যমে স্থানে স্থানে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ফলে যে পলি আগে প্লাবনভূমিতে গিয়ে জমা হতো, তা-ও নদীতেই জমা হতে থাকে। এতেও নদী ভরাট প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। আশির দশকে ফ্লাড অ্যাকশন প্লানের (ফ্যাপ) আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে বাঁধ নির্মাণে। সে সময় দেশ ও বিদেশের বহু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ এর পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বাঁধ না দিয়ে নদীগুলো খননের মাধ্যমে নাব্য করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার শাসকরা এসব পরামর্শ কানেই নেননি। এ অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কেবল নদীগুলোকেই মেরেছে তা নয়, বাংলাদেশ নামক দেশটিকেও বিপন্ন করে তুলেছে। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো পাল্টে যাওয়ায় দেশের জীববৈচিত্র্য বা প্রতিবেশগত (ইকোলজিক্যাল) ভারসাম্যও ব্যাপকভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। বাংলাদেশ একসময় মিঠাপানির মাছের প্রজাতির দিক থেকে সারা বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ছিল। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ছিল ছয় শতাধিক। আজ সেই সংখ্যা ২০০-এ নেমে এসেছে। তার মধ্যেও অনেক প্রজাতির মাছের সংখ্যা এত কম যে অচিরেই সেগুলো বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। কারণ মিঠাপানির অনেক মাছ নদীতে থাকলেও বর্ষায় প্রজননের সময় প্লাবনভূমিতে চলে আসে। অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে সেই প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। একদিকে খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া, আরেক দিকে প্রজননচক্র ব্যাহত হওয়া_দুটোই দেশের মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
আশার কথা, বর্তমান মহাজোট সরকার এ ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ড্রেজার ২০১২ সাল নাগাদ দেশে পেঁৗছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আরো ১৭টি ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া চলছে। ভারতও বাংলাদেশের নদীগুলোর খনন কাজে ও ভাঙন রোধে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। ইতিমধ্যেই ২৫টি ড্রেজার দিয়ে সীমান্তসংলগ্ন ইছামতী নদীর খননকাজ তারা সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশও নদী খননের দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যাতে ব্যয় হবে এক হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে ৫০টি নদীপথের খনন কাজ সম্পন্ন করা হবে। বড় নদীগুলো বিআইডাবি্লউটিএ-র আওতায় থাকলেও দেশের ছোটখাটো নদীগুলোর খনন কাজ পরিচালিত হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবোর আওতায়। তাদের কাছে ২০টি ছোট আকারের ড্রেজার রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে ছোট নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধিতে তা যথেষ্ট সহায়ক হবে। আবার বেসরকারিভাবেও অনেকে দেশি খনন-নৌকার সাহায্যে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। এর পরিমাণও নেহাত কম নয়। তবে এ ধরনের বালু উত্তোলনের ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। কারণ তারা নদীর কোনো একটি স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ বালু উত্তোলন করে এবং সেখানে হঠাৎ করে গভীরতা বেড়ে যায়। বর্ষায় সেখানে নদীর তলদেশে পানির ঘূর্ণি তৈরি হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী জনপদ নদীভাঙনের শিকার হয়। এ ব্যাপারেও সরকার একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তারা কোথায় কী পরিমাণ বালু তুলতে পারবে, তা ওই নীতিমালায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে সমন্বিত উপায়ে বালু উত্তোলন করা হলে তা খনন কাজেও সহায়ক হবে।
সমস্যা হচ্ছে, ১৯৯৮ সালের হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পলি আসে ৯০ লাখ ঘনমিটার। মেয়াদোত্তীর্ণ সাতটি ড্রেজার পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করলেও খনন করতে পারবে ৩০ লাখ ঘনমিটার। আরো তিনটি ড্রেজার এলে খননের পরিমাণ বাড়বে আরো ১৫ লাখ ঘনমিটার। তার পরও প্রতি বছর ৪৫ লাখ ঘনমিটার পলি নদীগুলোতে জমা হবে। কাজেই নদীগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হলে বছরে ৯০ লাখ ঘনমিটারের বেশি খনন কাজ চালাতে হবে।
প্রাথমিকভাবে এটি একটি ব্যয়বহুল কাজ। কিন্তু প্রতিবছর বন্যায় যে ফসলহানি হয়, জীববৈচিত্র্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তার তুলনায় সে ব্যয় খুবই সামান্য। বর্তমান সরকার দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে অতি ব্যয়বহুল সেই কাজটিকেই এগিয়ে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সাংবাদিক
No comments