পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও জাতীয় রাজনীতি by ড. এম শামসুল আলম
সম্প্রতি সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ইচ্ছামাফিক ভাড়া বৃদ্ধিতে গণপরিবহন নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয়। জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ ও সতর্ক হলে এ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব ছিল। এ ব্যাপারে গত ২৩ মে এ পত্রিকায় আমার একটি লেখা প্রকাশ হয়।
বর্তমানে বিইআরসির কাছে পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি বিবেচনাধীন রয়েছে। সিএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে রাজধানীতে যে গণ-অসন্তোষ দেখা দেয়, পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে যেন পল্লী অঞ্চলে তেমন গণ-অসন্তোষের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে প্রত্যাশায় এ লেখা।
পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে আরইবির প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য গত ১৮ এপ্রিল পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি তাঁদের অভিমত ও প্রতিক্রিয়া জানা এবং দেখার জন্য যাই। সকাল-দুপুর ও বিকেলে আমি যখনই যে বাড়িতে গেছি, সেখানে দেখেছি, হয় বিদ্যুৎ নেই, না হয় আমার চোখের সামনেই বিদ্যুৎ চলে গেছে অথবা ফিরে এসেছে। বিদ্যুতের এমন আসা-যাওয়া এবং অনুপস্থিতি আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এ পরিস্থিতি নিজ চোখে না দেখলে আমার পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ বাড়িতে আমি মহিলাদের মুখোমুখি হই। বিদ্যুতের এ বিপর্যয়ে তাঁরা প্রায় সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ, কারণ বিদ্যুতের অভাবে তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। তাঁদের এসব প্রতিক্রিয়ায় আমি ভয় পেয়েছি। কারণ গত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দেশের নারীসমাজ ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়ে যে বিপ্লব ঘটায়, সে বিপ্লব তারা আগামী নির্বাচনে ঘটাতে পারে বলে তাদের এমন প্রতিক্রিয়ায় আমার আশঙ্কা হয়।
২০০৩ সালে আরইবির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিলেটের জনৈক সংসদ সদস্য তখনকার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৭০ জনই আরইবির বিদ্যুৎ গ্রাহকের ভোটে নির্বাচিত। এসব গ্রাহক বিদ্যুতের অভাবে কষ্টে আছেন। যদি এ অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে গ্রামের মানুষ ধানের শীষে আর ভোট দেবে না। গ্রামের মানুষ কোনো সময়ই ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায়নি, এখনো পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। এখন যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তাহলে এসব মানুষের মনোভাব আরো খারাপ হবে। তার বহিঃপ্রকাশ আগামী ভোটে নয়, এখনই ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করতে পারে। কানসাট ও শনির আখড়ার মতো ঘটনাবলি এমন আশঙ্কা জাগায়। গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানসহ জিডিপি বৃদ্ধিতে গ্রামের কৃষি খামারের মতোই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এখন গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। দরিদ্র জনগণ নিজের মালিকানায় নিজ গৃহে ছোট ছোট শিল্প-কারখানার বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর 'একটি বাড়ি একটি খামার' মডেলের মতোই একটি বাড়ি এখন একটি কারখানা। এসব খামার ও কারখানায় এখন স্বল্পমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ একান্ত অপরিহার্য। তাই গ্রামে স্বল্পমূল্যে বিরতিহীন বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। সেই বিবেচনায় পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়নে সরকারকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। দেশের গ্যাস তথা জ্বালানিসম্পদের মালিক জনগণ। সে গ্যাসে সরকারের নিজস্ব মালিকানায় উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় এখনো ১ দশমিক ৫০ টাকার বেশি নয়। এখনো প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। সে বিদ্যুৎ স্বল্পমূল্যে এককভাবে গ্রামের মানুষের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ রাখা হলে সরকারকে পল্লী বিদ্যুতে সাবসিডি দিতে হবে না। উদ্বৃত্ত রাজস্ব ক্রস-সাবসিডিতে একদিকে অর্থপ্রবাহ বাড়াবে, অন্যদিকে আবার সরকারের আয়ও বৃদ্ধি হবে। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষ বিরতিহীন বিদ্যুৎ পাবে। পিছিয়ে থাকা গ্রাম এগিয়ে যাবে। দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের সরকারের জন্য এর চেয়ে বড় ও মহৎ কাজ আর কী হতে পারে? পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব এখন বিইআরসির বিবেচনাধীন, সে প্রস্তাব এই লক্ষ্যে হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলার কৌশলে এ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি বাস্তব ও জনস্বার্থসম্মত হয়নি।
গত ২৭ এপ্রিল বিইআরসিতে ওই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সে শুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান ভোক্তা প্রতিনিধিদের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে নিচে উল্লেখ করা প্রস্তাবগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
১. পল্লী বিদ্যুতে বিধিবদ্ধ সরকারি ভর্তুকির ব্যাপারে ভোক্তাদের মতের সঙ্গে এক ও অভিন্ন মত পোষণ করে তিনি ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেন; ২. পেট্রোবাংলার জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও পিডিবির জন্য যেমন বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে, আরইবির জন্য তেমন পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনের ব্যাপারে তিনি সম্মত হন এবং ৩. আরইবির প্রস্তাবে বিভিন্ন ধরনের অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে, তা নিরসনের জন্য বিইআরসি, আরইবি ও ভোক্তা প্রতিনিধি সমন্বয়ে এক বা একাধিক ত্রিপক্ষীয় সভা বিইআরসির মাধ্যমে আহ্বানের ব্যাপারে তিনি সম্মত হন। গত ৫ মে গণশুনানির ভিত্তিতে পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন ক্যাব ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সুপারিশসহ বিইআরসির কাছে পেশ করে। তার অনুলিপি আরইবিকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গত ১ জুন পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে থাকা বিভিন্ন অসংগতি ও বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বিইআরসি, আরইবি ও ক্যাব প্রতিনিধির সমন্বয়ে এক ত্রিপক্ষীয় সভা আহ্বানের জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে বিইআরসিকে এক পত্র দেওয়া হয়েছে। এ সভা ফলপ্রসূ হলে সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির মতো পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না। ফলে জাতীয় রাজনীতি এ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবিত হবে না, এমন আশা করা যায়। আগামী লেখায় মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাবের একটি তথ্য ও পরিমাণগত বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হবে। উল্লেখ্য, গণশুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ক্যাব ভোক্তাদের পক্ষ থেকে নিচে বর্ণিত অভিমত উপস্থাপন করা হয় :
পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি ন্যায্য ও যৌক্তিক এবং জনস্বার্থের অনুকূলে বলা যায় না। তবে ১. গণশুনানিতে যদি মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাবটি যৌক্তিক ও জনস্বার্থের অনুকূলে প্রমাণিত হয়, ২. আরইবির জন্য প্রতিপালনীয় বিইআরসির আদেশ পালনের অগ্রগতির প্রতিবেদন যদি পাওয়া যায়, ৩. পিবিএসগুলোতে বিদ্যুৎপ্রবাহ বৃদ্ধির ব্যাপারে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা আরইবি যদি বিইআরসিতে জমা দেয় এবং ৪. ওই প্রস্তাবে যেসব অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে, তার সংশোধনী যদি পাওয়া যায়, তাহলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ক্যাবের সুপারিশ গণশুনানি পরবর্তী প্রতিবেদনে পেশ করা হবে; কিন্তু আরইবির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। গণশুনানিতে ওই প্রস্তাব যৌক্তিক ও জনস্বার্থসম্মত প্রমাণ হয়নি। গণশুনানিকালে জেরায় আরইবিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেসব প্রশ্নের অধিকাংশ জবাব শুনানি-পরবর্তী প্রতিবেদনে দাখিল করার কথা ছিল, সেসব জবাবও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিইআরসি বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধি নিশ্চিত না করে পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করার কারণে মানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে পারে। সিএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে যেমন গণ-অসন্তোষ দেখা দেয়, পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতেও তেমন গণ-অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। জাতীয় রাজনীতি সে গণ-অসন্তোষের শিকার হতে পারে, এমন আশঙ্কা এখন প্রবল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও জ্বালানিবিশেষজ্ঞ
পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে আরইবির প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য গত ১৮ এপ্রিল পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি তাঁদের অভিমত ও প্রতিক্রিয়া জানা এবং দেখার জন্য যাই। সকাল-দুপুর ও বিকেলে আমি যখনই যে বাড়িতে গেছি, সেখানে দেখেছি, হয় বিদ্যুৎ নেই, না হয় আমার চোখের সামনেই বিদ্যুৎ চলে গেছে অথবা ফিরে এসেছে। বিদ্যুতের এমন আসা-যাওয়া এবং অনুপস্থিতি আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এ পরিস্থিতি নিজ চোখে না দেখলে আমার পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ বাড়িতে আমি মহিলাদের মুখোমুখি হই। বিদ্যুতের এ বিপর্যয়ে তাঁরা প্রায় সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ, কারণ বিদ্যুতের অভাবে তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। তাঁদের এসব প্রতিক্রিয়ায় আমি ভয় পেয়েছি। কারণ গত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দেশের নারীসমাজ ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়ে যে বিপ্লব ঘটায়, সে বিপ্লব তারা আগামী নির্বাচনে ঘটাতে পারে বলে তাদের এমন প্রতিক্রিয়ায় আমার আশঙ্কা হয়।
২০০৩ সালে আরইবির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিলেটের জনৈক সংসদ সদস্য তখনকার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৭০ জনই আরইবির বিদ্যুৎ গ্রাহকের ভোটে নির্বাচিত। এসব গ্রাহক বিদ্যুতের অভাবে কষ্টে আছেন। যদি এ অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে গ্রামের মানুষ ধানের শীষে আর ভোট দেবে না। গ্রামের মানুষ কোনো সময়ই ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায়নি, এখনো পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। এখন যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তাহলে এসব মানুষের মনোভাব আরো খারাপ হবে। তার বহিঃপ্রকাশ আগামী ভোটে নয়, এখনই ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করতে পারে। কানসাট ও শনির আখড়ার মতো ঘটনাবলি এমন আশঙ্কা জাগায়। গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানসহ জিডিপি বৃদ্ধিতে গ্রামের কৃষি খামারের মতোই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এখন গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। দরিদ্র জনগণ নিজের মালিকানায় নিজ গৃহে ছোট ছোট শিল্প-কারখানার বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর 'একটি বাড়ি একটি খামার' মডেলের মতোই একটি বাড়ি এখন একটি কারখানা। এসব খামার ও কারখানায় এখন স্বল্পমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ একান্ত অপরিহার্য। তাই গ্রামে স্বল্পমূল্যে বিরতিহীন বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। সেই বিবেচনায় পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়নে সরকারকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। দেশের গ্যাস তথা জ্বালানিসম্পদের মালিক জনগণ। সে গ্যাসে সরকারের নিজস্ব মালিকানায় উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় এখনো ১ দশমিক ৫০ টাকার বেশি নয়। এখনো প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। সে বিদ্যুৎ স্বল্পমূল্যে এককভাবে গ্রামের মানুষের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ রাখা হলে সরকারকে পল্লী বিদ্যুতে সাবসিডি দিতে হবে না। উদ্বৃত্ত রাজস্ব ক্রস-সাবসিডিতে একদিকে অর্থপ্রবাহ বাড়াবে, অন্যদিকে আবার সরকারের আয়ও বৃদ্ধি হবে। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষ বিরতিহীন বিদ্যুৎ পাবে। পিছিয়ে থাকা গ্রাম এগিয়ে যাবে। দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের সরকারের জন্য এর চেয়ে বড় ও মহৎ কাজ আর কী হতে পারে? পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব এখন বিইআরসির বিবেচনাধীন, সে প্রস্তাব এই লক্ষ্যে হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলার কৌশলে এ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি বাস্তব ও জনস্বার্থসম্মত হয়নি।
গত ২৭ এপ্রিল বিইআরসিতে ওই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সে শুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান ভোক্তা প্রতিনিধিদের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে নিচে উল্লেখ করা প্রস্তাবগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
১. পল্লী বিদ্যুতে বিধিবদ্ধ সরকারি ভর্তুকির ব্যাপারে ভোক্তাদের মতের সঙ্গে এক ও অভিন্ন মত পোষণ করে তিনি ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেন; ২. পেট্রোবাংলার জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও পিডিবির জন্য যেমন বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে, আরইবির জন্য তেমন পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনের ব্যাপারে তিনি সম্মত হন এবং ৩. আরইবির প্রস্তাবে বিভিন্ন ধরনের অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে, তা নিরসনের জন্য বিইআরসি, আরইবি ও ভোক্তা প্রতিনিধি সমন্বয়ে এক বা একাধিক ত্রিপক্ষীয় সভা বিইআরসির মাধ্যমে আহ্বানের ব্যাপারে তিনি সম্মত হন। গত ৫ মে গণশুনানির ভিত্তিতে পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন ক্যাব ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সুপারিশসহ বিইআরসির কাছে পেশ করে। তার অনুলিপি আরইবিকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গত ১ জুন পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে থাকা বিভিন্ন অসংগতি ও বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বিইআরসি, আরইবি ও ক্যাব প্রতিনিধির সমন্বয়ে এক ত্রিপক্ষীয় সভা আহ্বানের জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে বিইআরসিকে এক পত্র দেওয়া হয়েছে। এ সভা ফলপ্রসূ হলে সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির মতো পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না। ফলে জাতীয় রাজনীতি এ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবিত হবে না, এমন আশা করা যায়। আগামী লেখায় মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাবের একটি তথ্য ও পরিমাণগত বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হবে। উল্লেখ্য, গণশুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ক্যাব ভোক্তাদের পক্ষ থেকে নিচে বর্ণিত অভিমত উপস্থাপন করা হয় :
পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি ন্যায্য ও যৌক্তিক এবং জনস্বার্থের অনুকূলে বলা যায় না। তবে ১. গণশুনানিতে যদি মূল্যবৃদ্ধির এ প্রস্তাবটি যৌক্তিক ও জনস্বার্থের অনুকূলে প্রমাণিত হয়, ২. আরইবির জন্য প্রতিপালনীয় বিইআরসির আদেশ পালনের অগ্রগতির প্রতিবেদন যদি পাওয়া যায়, ৩. পিবিএসগুলোতে বিদ্যুৎপ্রবাহ বৃদ্ধির ব্যাপারে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা আরইবি যদি বিইআরসিতে জমা দেয় এবং ৪. ওই প্রস্তাবে যেসব অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে, তার সংশোধনী যদি পাওয়া যায়, তাহলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ক্যাবের সুপারিশ গণশুনানি পরবর্তী প্রতিবেদনে পেশ করা হবে; কিন্তু আরইবির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। গণশুনানিতে ওই প্রস্তাব যৌক্তিক ও জনস্বার্থসম্মত প্রমাণ হয়নি। গণশুনানিকালে জেরায় আরইবিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেসব প্রশ্নের অধিকাংশ জবাব শুনানি-পরবর্তী প্রতিবেদনে দাখিল করার কথা ছিল, সেসব জবাবও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিইআরসি বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধি নিশ্চিত না করে পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করার কারণে মানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে পারে। সিএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে যেমন গণ-অসন্তোষ দেখা দেয়, পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতেও তেমন গণ-অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। জাতীয় রাজনীতি সে গণ-অসন্তোষের শিকার হতে পারে, এমন আশঙ্কা এখন প্রবল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও জ্বালানিবিশেষজ্ঞ
No comments