নাগরিক সমাজ-দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরাম থেকে কী পেলাম by মহিউদ্দিন আহমদ
২০০৬ সালের জানুয়ারি মাস। ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে বসেছে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের আসর। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশ থেকে আসা প্রায় হাজার খানেক অংশগ্রহণকারী। এশিয়া থেকে জনা দশেক। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
শেষ দিনে ছিল একটা বিশেষ আয়োজন। রাষ্ট্রপতি হুগো রাফায়েল শাভেজ ফ্রায়াস, যিনি হুগো শাভেজ নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত, তিনি ‘বিদেশি’ ডেলিগেটদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিলিত হলেন এক সন্ধ্যায়। উপস্থিত ৩০-৩৫ জনের মধ্যে আমিও ছিলাম।
শাভেজকে আমি চিনি ২০০২ সাল থেকে, যখন তাঁকে দেখি জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক সম্মেলনে। নাগরিক সমাজের একটি ফোরামে তিনি এসেছিলেন জি-৭৭ জাতিগোষ্ঠীর তখনকার নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমার মনে হয়েছিল, লাতিন আমেরিকায় তিনি সিমন বলিভার, অগাস্তো সিজার সানদিনো এবং চে গুয়েভারার পরম্পরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমি অনেক সুবক্তা দেখেছি। তাঁরা হাজার হাজার মানুষকে অনেকক্ষণ ধরে আবিষ্ট করে রাখতে পারেন। তাঁদের বক্তৃতায় আবেগ থাকে, উত্তেজনা থাকে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো সারবস্তু থাকে না। শাভেজ একজন ব্যতিক্রম। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ঝাড়া তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, সমর কৌশল, সাহিত্য, সামাজিক যোগাযোগ, ক্রীড়া—হেন বিষয় ছিল না, যা তিনি আলোচনা করেননি। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনছিলাম। শেষমেশ তিনি আমাদের উদ্দেশে একটা গুরুতর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘এই যে আপনারা ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সহমর্মিতা ও সংহতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন, আমি তার প্রশংসা করি। আমিও আপনাদের একজন। কিন্তু আপনারা রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। এটা আমার পছন্দ নয়। আপনাদের অবশ্যই রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ কথাটি আমার মনে ধরল।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের ধারণাটি আসে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বৈশ্বিক সম্মেলন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ থেকে। সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে এই সম্মেলন হয় প্রতিবছর। এর সমান্তরাল আয়োজন হিসেবে নাগরিক সমাজের বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে। প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল ২০০১ সালের ২৫-৩০ জানুয়ারি ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রে শহরে। সম্মেলনের সহ-আয়োজক ছিল পোর্তো এলেগ্রের স্থানীয় সরকার এবং ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টি। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির মোড়কে চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদের প্লাটফরম হিসেবে এই ফোরামের যাত্রা শুরু হয়। এই ফোরাম লাতিন আমেরিকায় সৃষ্টি করেছিল গণজোয়ার, যার ফলে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুই ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা এক বছরের মধ্যেই ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের রথযাত্রা দক্ষিণ এশিয়ায় শুরু হয় ভারতের হায়দরাবাদে, ২০০২ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এশিয়া সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে। মাঝে মুম্বাই, করাচি হয়ে এবার দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরামের আয়োজক হলো এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীনতম নগর ঢাকা। ঢাকা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগে সম্ভবত এটাই নাগরিকদের সর্বশেষ আঞ্চলিক সম্মিলন।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের কোনো মাথাভারী প্রশাসনিক কাঠামো নেই, নেই কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটি বা পলিটব্যুরো। প্রতিটি সম্মেলনের জন্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। থাকে একটি অস্থায়ী সচিবালয়। এবার এই ফোরামের সহ-আয়োজক ছিল এ দেশের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সচিবালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিল ‘অঙ্গীকার বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ-আয়োজক হওয়ায় কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন ভবন ও চত্বর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। আয়োজন ছিল বিশাল, ৪৪টি দেশের এক হাজার ২০০ প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশি অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কত ছিল, তা জানা যায়নি। সচিবালয়ের খরচ বাদে মোট খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করা হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় তিন কোটি ৬৬ লাখ টাকা। (সূত্র: অঙ্গীকার বাংলাদেশ) ১৮ থেকে ২২ নভেম্বর অবধি আয়োজিত এই ফোরামে অনুষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রদর্শনী এবং শোভাযাত্রা। গণমাধ্যম ভালোই কভারেজ দিয়েছে। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, আমরা কী পেলাম।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের স্লোগান হলো, ‘অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড ইজ পসিবল’, অন্য রকম বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। মূল চেতনা হচ্ছে, পৃথিবীর মধ্যে মানুষে মানুষে কৃত্রিম দেয়াল থাকবে না, মানুষ শুধু বৈশ্বিক পুঁজির জন্য শ্রমের জোগানদার হবে না, সমাজে কোনো রকম বৈষম্য থাকবে না, মানুষের জীবন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হবে না, রাষ্ট্র হবে মানুষকেন্দ্রিক। ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের প্রতিটি সম্মেলনে এই ঘোষণা ও অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। এটা এনজিওদের কোনো জোট বা ফোরাম নয়। এটা নাগরিক সমাজের জন্য একটা প্লাটফরম। আগ্রাসী ধনতন্ত্র, নয়া উদারবাদী অর্থনীতি এবং বৈষম্যমূলক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান বা যারা সোচ্চার, তাদের জন্য এই প্লাটফরম। পথ-মতনির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই প্লাটফরম ব্যবহার করতে পারেন। তুলে ধরতে পারেন তাঁদের মতামত।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ফোরামে ইউনেসকো অংশ নিয়েছিল। ফলে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংগঠনের কাছে এই ফোরামের একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া ফোরামের সহ-আয়োজক হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করল। ব্যাপক নাগরিক সমাজের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শগত সম্পর্ক তৈরি হলো। সোশ্যাল ফোরামও পেল আরও গ্রহণযোগ্যতা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হলেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের যুগ-যুগের সংগ্রামেরও একটা পরিচয় পেলেন। আন্তঃসীমান্ত গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ তৈরি করা ও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য এগুলো উল্লেখযোগ্য সিঁড়ি হিসেবে বিবেচিত হবে।
অবশ্য একটা নেতিবাচক দিকও লক্ষ করা গেছে। দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরাম ছিল বহুলাংশে এনজিওকেন্দ্রিক। ব্যাপক আমজনতা, গণসংগঠন ও সামাজিক আন্দোলনগুলোর অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের যে মূল চেতনার সঙ্গে এটা সংগতিপূর্ণ নয়।
প্রথম থেকেই আয়োজকদের চেষ্টা ছিল করপোরেট সংস্থাগুলো থেকে গা বাঁচিয়ে ফোরাম আয়োজন করা। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও করপোরেট এনজিওগুলো প্রস্তুত ছিল উদারভাবে আর্থিক সাহায্য দিতে। কিন্তু সেটা নিলে ফোরাম পথভ্রষ্ট হতো। তথাপি ফোরামে বিদেশি অনুদানপুষ্ট এনজিওদের প্রাধান্য ছিল লক্ষ্যণীয়।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম একাদশ বর্ষ অতিক্রম করতে চলেছে। প্রথম তিন বছর এটা ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রেতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চতুর্থ বছর থেকে এটা অন্যান্য মহাদেশে বিস্তৃত হতে থাকে। ২০০৩ সালের তৃতীয় ফোরামে আমি পোর্তো এলেগ্রেতে যে আগ্রহ, অঙ্গীকার ও উন্মাদনা দেখেছিলাম, এই এক দশকের ব্যবধানে তার অনেকটাই অন্তর্হিত। ফোরাম অনেকটা গতানুগতিকতায়, আনুষ্ঠানিকতায় পৌঁছে গেছে। লাতিন আমেরিকায় একে একে ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, পেরু, আর্জেন্টিনা ও চিলিতে যে রকম গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, দেশে দেশে মার্কিন-অনুগত সরকারগুলো নির্বাচনে হেরে গেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার; আমাদের মহাদেশে সে রকমটি ঘটছে না। দেশে যদি গণমানুষের অংশগ্রহণে সত্যিকার লড়াই না থাকে, এ ধরনের ফোরাম কোনো রকম অনুঘটকের কাজ করতে পারে না। যেখানে গণমানুষের গণতন্ত্রায়নের সংগ্রামকে বেগবান করার পথে একটা সহায়ক ভূমিকা রাখার কথা, নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টির ও নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করার সঞ্জীবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত করার কথা, সেখানে দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরাম হয়তো একটা বড়সড় মেলার দৃষ্টান্ত হিসেবেই মানুষ মনে রাখবে। আমাদের নাগরিক সমাজের একটা বড় ঘাটতি হলো, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বেশ নির্লিপ্ত। ‘রাজনীতিবিদেরা খারাপ’ এই কথা শুনছি বহু দিন ধরে। কিন্তু ভালো মানুষেরা যদি শুধু এনজিওর খোলসে নিজেদের ঢেকে রাখেন, তাহলে রাষ্ট্র কাদের হাতে পড়বে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
শাভেজকে আমি চিনি ২০০২ সাল থেকে, যখন তাঁকে দেখি জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক সম্মেলনে। নাগরিক সমাজের একটি ফোরামে তিনি এসেছিলেন জি-৭৭ জাতিগোষ্ঠীর তখনকার নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমার মনে হয়েছিল, লাতিন আমেরিকায় তিনি সিমন বলিভার, অগাস্তো সিজার সানদিনো এবং চে গুয়েভারার পরম্পরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমি অনেক সুবক্তা দেখেছি। তাঁরা হাজার হাজার মানুষকে অনেকক্ষণ ধরে আবিষ্ট করে রাখতে পারেন। তাঁদের বক্তৃতায় আবেগ থাকে, উত্তেজনা থাকে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো সারবস্তু থাকে না। শাভেজ একজন ব্যতিক্রম। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ঝাড়া তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, সমর কৌশল, সাহিত্য, সামাজিক যোগাযোগ, ক্রীড়া—হেন বিষয় ছিল না, যা তিনি আলোচনা করেননি। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনছিলাম। শেষমেশ তিনি আমাদের উদ্দেশে একটা গুরুতর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘এই যে আপনারা ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সহমর্মিতা ও সংহতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন, আমি তার প্রশংসা করি। আমিও আপনাদের একজন। কিন্তু আপনারা রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। এটা আমার পছন্দ নয়। আপনাদের অবশ্যই রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ কথাটি আমার মনে ধরল।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের ধারণাটি আসে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বৈশ্বিক সম্মেলন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ থেকে। সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে এই সম্মেলন হয় প্রতিবছর। এর সমান্তরাল আয়োজন হিসেবে নাগরিক সমাজের বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে। প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল ২০০১ সালের ২৫-৩০ জানুয়ারি ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রে শহরে। সম্মেলনের সহ-আয়োজক ছিল পোর্তো এলেগ্রের স্থানীয় সরকার এবং ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টি। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির মোড়কে চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদের প্লাটফরম হিসেবে এই ফোরামের যাত্রা শুরু হয়। এই ফোরাম লাতিন আমেরিকায় সৃষ্টি করেছিল গণজোয়ার, যার ফলে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুই ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা এক বছরের মধ্যেই ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের রথযাত্রা দক্ষিণ এশিয়ায় শুরু হয় ভারতের হায়দরাবাদে, ২০০২ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এশিয়া সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে। মাঝে মুম্বাই, করাচি হয়ে এবার দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরামের আয়োজক হলো এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীনতম নগর ঢাকা। ঢাকা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগে সম্ভবত এটাই নাগরিকদের সর্বশেষ আঞ্চলিক সম্মিলন।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের কোনো মাথাভারী প্রশাসনিক কাঠামো নেই, নেই কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটি বা পলিটব্যুরো। প্রতিটি সম্মেলনের জন্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। থাকে একটি অস্থায়ী সচিবালয়। এবার এই ফোরামের সহ-আয়োজক ছিল এ দেশের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সচিবালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিল ‘অঙ্গীকার বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ-আয়োজক হওয়ায় কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন ভবন ও চত্বর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। আয়োজন ছিল বিশাল, ৪৪টি দেশের এক হাজার ২০০ প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশি অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কত ছিল, তা জানা যায়নি। সচিবালয়ের খরচ বাদে মোট খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করা হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় তিন কোটি ৬৬ লাখ টাকা। (সূত্র: অঙ্গীকার বাংলাদেশ) ১৮ থেকে ২২ নভেম্বর অবধি আয়োজিত এই ফোরামে অনুষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রদর্শনী এবং শোভাযাত্রা। গণমাধ্যম ভালোই কভারেজ দিয়েছে। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, আমরা কী পেলাম।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের স্লোগান হলো, ‘অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড ইজ পসিবল’, অন্য রকম বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। মূল চেতনা হচ্ছে, পৃথিবীর মধ্যে মানুষে মানুষে কৃত্রিম দেয়াল থাকবে না, মানুষ শুধু বৈশ্বিক পুঁজির জন্য শ্রমের জোগানদার হবে না, সমাজে কোনো রকম বৈষম্য থাকবে না, মানুষের জীবন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হবে না, রাষ্ট্র হবে মানুষকেন্দ্রিক। ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের প্রতিটি সম্মেলনে এই ঘোষণা ও অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। এটা এনজিওদের কোনো জোট বা ফোরাম নয়। এটা নাগরিক সমাজের জন্য একটা প্লাটফরম। আগ্রাসী ধনতন্ত্র, নয়া উদারবাদী অর্থনীতি এবং বৈষম্যমূলক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান বা যারা সোচ্চার, তাদের জন্য এই প্লাটফরম। পথ-মতনির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই প্লাটফরম ব্যবহার করতে পারেন। তুলে ধরতে পারেন তাঁদের মতামত।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ফোরামে ইউনেসকো অংশ নিয়েছিল। ফলে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংগঠনের কাছে এই ফোরামের একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া ফোরামের সহ-আয়োজক হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করল। ব্যাপক নাগরিক সমাজের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শগত সম্পর্ক তৈরি হলো। সোশ্যাল ফোরামও পেল আরও গ্রহণযোগ্যতা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হলেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের যুগ-যুগের সংগ্রামেরও একটা পরিচয় পেলেন। আন্তঃসীমান্ত গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ তৈরি করা ও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য এগুলো উল্লেখযোগ্য সিঁড়ি হিসেবে বিবেচিত হবে।
অবশ্য একটা নেতিবাচক দিকও লক্ষ করা গেছে। দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরাম ছিল বহুলাংশে এনজিওকেন্দ্রিক। ব্যাপক আমজনতা, গণসংগঠন ও সামাজিক আন্দোলনগুলোর অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের যে মূল চেতনার সঙ্গে এটা সংগতিপূর্ণ নয়।
প্রথম থেকেই আয়োজকদের চেষ্টা ছিল করপোরেট সংস্থাগুলো থেকে গা বাঁচিয়ে ফোরাম আয়োজন করা। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও করপোরেট এনজিওগুলো প্রস্তুত ছিল উদারভাবে আর্থিক সাহায্য দিতে। কিন্তু সেটা নিলে ফোরাম পথভ্রষ্ট হতো। তথাপি ফোরামে বিদেশি অনুদানপুষ্ট এনজিওদের প্রাধান্য ছিল লক্ষ্যণীয়।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম একাদশ বর্ষ অতিক্রম করতে চলেছে। প্রথম তিন বছর এটা ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রেতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চতুর্থ বছর থেকে এটা অন্যান্য মহাদেশে বিস্তৃত হতে থাকে। ২০০৩ সালের তৃতীয় ফোরামে আমি পোর্তো এলেগ্রেতে যে আগ্রহ, অঙ্গীকার ও উন্মাদনা দেখেছিলাম, এই এক দশকের ব্যবধানে তার অনেকটাই অন্তর্হিত। ফোরাম অনেকটা গতানুগতিকতায়, আনুষ্ঠানিকতায় পৌঁছে গেছে। লাতিন আমেরিকায় একে একে ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, পেরু, আর্জেন্টিনা ও চিলিতে যে রকম গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, দেশে দেশে মার্কিন-অনুগত সরকারগুলো নির্বাচনে হেরে গেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার; আমাদের মহাদেশে সে রকমটি ঘটছে না। দেশে যদি গণমানুষের অংশগ্রহণে সত্যিকার লড়াই না থাকে, এ ধরনের ফোরাম কোনো রকম অনুঘটকের কাজ করতে পারে না। যেখানে গণমানুষের গণতন্ত্রায়নের সংগ্রামকে বেগবান করার পথে একটা সহায়ক ভূমিকা রাখার কথা, নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টির ও নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করার সঞ্জীবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত করার কথা, সেখানে দক্ষিণ এশিয়া সোশ্যাল ফোরাম হয়তো একটা বড়সড় মেলার দৃষ্টান্ত হিসেবেই মানুষ মনে রাখবে। আমাদের নাগরিক সমাজের একটা বড় ঘাটতি হলো, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বেশ নির্লিপ্ত। ‘রাজনীতিবিদেরা খারাপ’ এই কথা শুনছি বহু দিন ধরে। কিন্তু ভালো মানুষেরা যদি শুধু এনজিওর খোলসে নিজেদের ঢেকে রাখেন, তাহলে রাষ্ট্র কাদের হাতে পড়বে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments