সরল গরল-টিপাইমুখ নিয়ে দুই নেত্রীর টিপ্পনী by মিজানুর রহমান খান

চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপরে জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে ভারতে হইচই পড়েছিল। সংসদে বিতর্ক হয়েছিল। গত ১৪ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা বলেছিলেন, ‘আমরা নিজস্ব সূত্রে জেনেছি যে চীন ব্রহ্মপুত্রে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য বাঁধ দিচ্ছে। তারা পানি জমা করে রাখবে না। এর ফলে ভাটি অঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। সুতরাং, আমি মনে করি, আশু উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।’


টিপাইমুখ প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাতে বাংলাদেশের আশ্বস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকা-দিল্লি বিশ্বাসের সংকটে বিরাট ঘাটতি। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় সেই ঘাটতি আরও প্রকট হয়েছে।
মাত্র দুই বছর আগে আমরা টিপাই নিয়ে দুই বড় দলকে কলহ করতে দেখেছি। এবারের ব্যতিক্রম, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দৃশ্যত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো মন্তব্য নজরে আসেনি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি একে স্বাগত জানিয়েছেন। এখন একে একটা যৌক্তিক পরিণতি দেওয়াই চ্যালেঞ্জ।
১৯২৯ সালে কাছাড় উপত্যকায় ভয়াবহ বন্যা হয়। তখন ব্রিটিশরা বন্যা মোকাবিলায় এখানে বাঁধ তৈরির কথা ভেবেছিল। ভূমিকম্পপ্রবণ এ এলাকাটি বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উজানে। পৃথিবীতে এখনো নিরাপদ ড্যাম বলে কিছু নেই। ড্যাম দুর্ঘটনায় চীনে লাখ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ হলে বাংলাদেশের সামনে সম্ভাব্য নতুন বিপদ পরিবেশগত যেমন, তেমনি দুর্ঘটনাজনিতও। তবে সবচেয়ে স্পর্শকাতরতা বরাকের পানি প্রত্যাহার করা হয় কি না, যদিও ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে। ব্রিটিশ আমলেও টিপাইমুখে একটি জলাধার নির্মাণ করে নিম্ন অববাহিকার পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা হয়েছিল।
১৯৫৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন এখানে একটি বহুমুখী প্রকল্প গঠনে সমীক্ষা চালিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে বাঁধ নির্মাণের পাকা সিদ্ধান্ত হয়। প্রয়াত পানিবিশেষজ্ঞ বি এম আব্বাস এটি-র বর্ণনায় দেখি, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে একটি সংযোগ খাল তৈরি করে গঙ্গার পানি টিপাইমুখে জলাধার বানিয়ে ধরে রাখার চিন্তাও ভারতীয়রা করেছিল। ১৯৮২ সালে যৌথ নদী কমিশন জেআরসিতে এ প্রস্তাব ভারত পেশও করেছিল। এ প্রকল্পের বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে ভারত সরকার ১৯৮০ সালে ব্রহ্মপুত্র বোর্ড গঠন করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে ভারত প্রথম টিপাইমুখে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এরপর ২০০৬ সালে সেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। কিন্তু স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর প্রায় দুই ডজন সংগঠন মণিপুরে ধর্মঘটসহ সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুললে তা স্থগিত হয়েছিল। পাঁচ বছরের বিরতি দিয়ে এবারে তাদের নতুন চুক্তি প্রকাশ পেল। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রতিক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত একটা ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা ফুটে উঠেছে। দুই বড় দল যথারীতি অসূয়াপ্রসূত তর্কাতর্কি করছে। আর তাতে ভারতেরই মওকা।
১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলা-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ১৪তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উভয় দেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা টিপাইমুখে একটা যৌথ সমীক্ষা চালাবেন। তাঁরা যৌথভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য কী সুবিধা এ থেকে পাওয়া যায়, সেটাও পরীক্ষা করবেন। কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন পেশ করার কথা ছিল। কিন্তু আজও সেই যৌথ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়নি।
২০০৯ সালের আগস্টে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিল ১০ সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধিদল। বিএনপির দুজন ও জামায়াতের একজন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি সরকারি দল আশা করেছিল। কিন্তু বিএনপি প্রথাগত বিরোধিতার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। টিপাইমুখ সফর বয়কট করে তারা ‘একদলীয় সফর’কে পিকনিকের সঙ্গেও তুলনা করেছিল। এবারেও খালেদা জিয়ার প্রস্তাব তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসা কি না, তা প্রশ্নের বাইরে নয়। তবে এটাকে বড় সুযোগ বিবেচনায় নিয়ে সরকারি দলকেই উদ্যোগী হতে হবে।
সরকারি ও বিরোধী দলের উচিত, কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করা। যৌথ সমীক্ষা সম্পাদনে গুরুত্ব দিতে উভয়ের রেকর্ড রয়েছে। সুতরাং, এ নিয়ে অহেতুক পারস্পরিক টীকা-টিপ্পনী আত্মঘাতী। বাংলাদেশের ওপর টিপাইয়ের পরিবেশগত প্রভাব কী হতে পারে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এখনও বুঝতে সক্ষম হননি। কারণ, প্রকল্পের ডিজাইন ও অপারেশন-সংক্রান্ত তথ্যাদি জানতে চেয়ে বাংলাদেশ সরকার একাধিক নোট ভারবাল (কূটনৈতিক পত্র) ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু ভারত এ বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেছে বলে জানা যায় না।
সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ২০০৯ সালে টিপাইমুখ পরিদর্শনে সংসদীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত একটি সমীক্ষার ফলাফল বিএনপি গোপন করেছে। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টিপাইমুখে বাঁধ দিলে বাংলাদেশের জন্য তা সুফল বয়ে আনবে। বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। এমনকি সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেই যে সন্দেহমুক্ত নয়, তার প্রমাণ হিসেবে সরকার দিল্লিতে এখন বিশেষ দূত পাঠাতে চাইছে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কথা বলছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ওই সংসদীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন। গতকাল টেলিফোনে তিনি জানালেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পরপর দুই দিনের চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের বহনকারী ভারতীয় হেলিকপ্টার টিপাইমুখে অবতরণ করতে পারেনি। তবে তাঁরা ফিরে এসে ২০০ থেকে ২৫০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালের জেআরসি সিদ্ধান্ত, ১৯৯৩ সালের সমীক্ষা ও ২০০৯ সালের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এখন একটি উপযুক্ত প্রতিনিধিদল গঠন করা যেতে পারে। যৌথ নদী কমিশন টিপাই-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পারে।
আব্দুর রাজ্জাক এর আগে বলেছিলেন, ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে জেআরসির ৩৫তম বৈঠকে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ওই সময় হাফিজ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে কোনো আপত্তি তোলেননি (ডেইলি স্টার, ২০ জুলাই ২০০৯)। কিন্তু দলিলপত্র তাঁকে সমর্থন করে না। জেআরসির সাবেক সদস্য খলিলুর রহমান ২০০৭ সালে এক নিবন্ধে লিখেছেন: ‘জেআরসির ৩৫তম (২০০৩) ও ৩৬তম (২০০৫) বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়। ৩৬তম বৈঠকে বাংলাদেশ ভারতীয় পক্ষকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে বিরত থাকতে অনুরোধ জানায়। এর উত্তরে ভারতীয় পক্ষ বলেছিল, প্রকল্পের আওতায় সেচের কোনো বিষয় নেই। তাই বরাক নদীর পানি প্রত্যাহার হবে না। বরং বাঁধ হলে বাংলাদেশের বন্যা কমবে। শুকনো মৌসুমে বরাক/সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীতে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহ মিলবে। বাংলাদেশ পক্ষ নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে, বরাক নদীর কোথাও কোনো কাঠামো তৈরি করে পানি প্রত্যাহার করা যাবে না। ভারতীয় পক্ষ নিশ্চয়তা দেয় যে, কোথাও কোনো কাঠামো তৈরি করে পানি প্রত্যাহারে তাদের পরিকল্পনা নেই।’
চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারত নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক নেশায় মেতেছে। আমরা মনে করি, টিপাই প্রকল্পের বিষয়ে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে যৌথ সমীক্ষা সম্পাদন এবং তার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের মানুষের মনে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তা অপনোদনে সচেষ্ট হতে পারে।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই অর্বাচীন মন্তব্যের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেননি। জাতীয় স্বার্থে তাঁর এ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। তাই দেশের স্বার্থরক্ষা করতে আমরা জানি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, এমন কিছু কাউকে করতে দেওয়া হবে না।’ বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাটি তিনি হয়তো একই সঙ্গে বিএনপি এবং দিল্লির উদ্দেশে বলেছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, বিএনপিকে সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কার্যত বিএনপির অন্ধ ভারত বিরোধিতার গরল গলাধঃকরণ করছেন। ভোটের রাজনীতির সুযোগ কেউ হারাতে চান না।
ড. মনমোহনকে লেখা খালেদা জিয়ার চিঠি একটি যথার্থ উদ্যোগ। অথচ একে খোঁচা দিতে শেখ হাসিনা ‘পত্রালাপ’, ‘পত্রাঘাত’ এবং দিল্লির ‘পদলেহন’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া এ প্রসঙ্গেই যথারীতি বাংলাদেশকে ভারতের ‘অধীনস্থ’ বানানোর অসংযত উক্তি করেছেন।
১৯৭৮ সালে জেআরসির যৌথ সমীক্ষার সিদ্ধান্ত অচল, অবৈধ কিংবা অসার হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে ১৯৭৮ সালের যৌথ সমীক্ষার সিদ্ধান্তের উল্লেখ না করতে পারা একটি বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। পেশাদার কূটনীতিকদের দলতোষণ-নীতি পরিহার করতে হবে। সরকারি দল যে না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থান গ্রহণ করেছে, তা দীপু মনির দুই দিনের প্রেস ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট। প্রথম দিন তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন না শুনে সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় দিনের কথাবার্তায় দিল্লির উদ্দেশে বার্তা পাঠানোর চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেন।
পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় আশ্বাস চূড়ান্ত নয়। দীপু মনি বলেছেন, ‘এ প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু হবে কি না, সেটি যাচাই করে দেখতে আমরা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা করব; এবং এ বিষয়ে ভারতের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছি।’ তবে তিনি এটাও বলেছেন, ‘ভারত ২০০৯ সালের ২১ মে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে সেচকাজের জন্য কোনো কিছু টিপাইমুখে করা হবে না।’ কিন্তু তার পরও বর্তমান আওয়ামী লীগই টিপাইয়ে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। তাদের রিপোর্টের সুপারিশ নিয়ে কেন তাঁরা এত দিন ঘুমিয়েছিলেন, সে দায় ক্ষমতাসীনদের ওপরই বর্তায়। বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে বর্তমান সরকার তিস্তা বা টিপাইমুখ নিয়ে তাদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.