ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা-শিক্ষক হিসেবে আমরা লজ্জিত, ক্ষমাপ্রার্থী
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাংলাদেশের যে কটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়, তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। সেই ১৯২১ সাল থেকে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং জাতীয় নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে অনেকের স্বপ্ন থাকে।
অনেক শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে এ স্বপ্নকে লালন করে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য ধাপে ধাপে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীদের আনন্দের সীমা থাকে না। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে তার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিশ্চিত জানার পর যদি শিক্ষার্থীরা দেখতে পায় যে, শিক্ষকদের ভুলের কারণে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে, তাহলে কষ্টের সীমা থাকে না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বেদনার্ত হতে থাকে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।
সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা ঘটে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা অর্থাৎ ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। ভর্তি-প্রক্রিয়ায় এত বেশি ভুল ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ভর্তিপরীক্ষা বাতিল করে নতুন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ ডিসেম্বর।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর ‘গ’ ইউনিটে ৯৭৫টি আসনের বিপরীতে ৩৮ হাজার ৮৫৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ৩১ অক্টোবর ফল প্রকাশ করা হলে দুই হাজার ৭২৭ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু এই ফল নিয়ে অভিযোগ উঠলে ২ নভেম্বর পুনর্মূল্যায়িত ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাস করে ছয় হাজার ৯৪ জন শিক্ষার্থী। তবে বাদ পড়ে যায় প্রথমবার মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া ১৯৪ জন শিক্ষার্থী। বাণিজ্য অনুষদের ডিন ও ‘গ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী জামাল উদ্দিন আহমেদ ফল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলেছেন, পরীক্ষা কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্রের মোট ১২টি উত্তরে অসংগতি পায়। এর মধ্যে ছয়টি প্রশ্নে সঠিক উত্তরই ছিল না। আর বাকি ছয়টি প্রশ্নের মূল্যায়ন হয় ভুল উত্তর দিয়ে। সঠিক উত্তর না থাকা ছয়টি প্রশ্নের পূর্ণ নম্বর সব পরীক্ষার্থীকেই দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা মানে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। ভর্তি কমিটি গঠন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, কয়েক সেট প্রশ্ন প্রণয়ন, সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সেট প্রশ্নের সঠিক বা ‘মডেল উত্তর’ প্রণয়ন, কোচিং সেন্টারের উৎপাত ও নজরদারি এড়িয়ে প্রশ্নপত্র ছাপা, ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে অর্ধলক্ষ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ, কম্পিউটারে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে কয়েক দিনের মধ্যে তা নোটিশ বোর্ড ও ওয়েবসাইটে প্রদান করা। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে করে আসছেন। পরীক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো কাজে অধিকাংশ শিক্ষক অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন। ১০ নম্বরের একটি টিউটোরিয়াল বা ক্লাস টেস্ট গ্রহণ করার সময়ও আমরা অনেক সতর্কতা অবলম্বন করি, অথচ বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রমে যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
শিক্ষকদের ভুলের কারণে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল এবং পুনরায় তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের ফলে অনেকগুলো জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, একটি ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য ৭০ থেকে ৮০ লাখ বা তারও অধিক টাকা ব্যয় হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯ ডিসেম্বর নতুন করে যে পরীক্ষাটি গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সেই অর্থের জোগান কে দেবে? দ্বিতীয়ত, হাজার হাজার শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন পড়াশোনা করে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। দীর্ঘদিন পড়াশোনা করে যে মান ও গভীরতর প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ২৮ অক্টোবরের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল, ওই একই ধরনের প্রস্তুতি কি তারা ৯ ডিসেম্বরের ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিতে পারবে? কেননা, ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া, পরে ফল বাতিল হওয়া—সবকিছু মিলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় একটা ছেদ পড়ে গেছে। উপরন্তু, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। তৃতীয়ত, মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত জেনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি অথবা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করার পরও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য মফস্বল ও দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ঢাকা আসেন। এতে কয়েক দিন সময় যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি কিছু টাকা-পয়সাও খরচ করতে হয়। ৯ ডিসেম্বরে নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে টাকা খরচ ও যে সময় নষ্ট হবে, তার ক্ষতিপূরণ কে করবে?
২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতে বাণিজ্য অনুষদের আটটি বিভাগের ১৬ জন শিক্ষক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে আটজন হলেন আটটি বিভাগের চেয়ারম্যান। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নের বাংলা ও ইংরেজি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে করানোর কথা। কিন্তু তাঁরা তা না করে বাণিজ্য অনুষদেরই দুজন শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর এ কারণেই প্রশ্নপত্রে এত ভুল হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সঠিক বা মডেল উত্তরপত্রে ১২টি ভুল! এতগুলো ভুল নিয়ে কোনো পরীক্ষার সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৮ অক্টোবরের পরীক্ষা বাতিল করে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আমরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমরা লজ্জিত, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কতিপয় শিক্ষকের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের জন্য শত শত শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা সে জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও দাবি করছি যে, ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী জামাল উদ্দিন আহমেদ যেন পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন তাঁকে পদচ্যুত করে। আমরা আরও দাবি জানাতে চাই, পূর্বেকার ভর্তি কমিটি বাতিল করে অবিলম্বে যেন নতুন কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই নতুন কমিটির তত্ত্বাবধানে যেন ৯ ডিসেম্বরের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
পরিশেষে আমরা একটা কথা বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশিত মানের পড়াশোনা ও গবেষণা হচ্ছে না। এর ফলে এশিয়ার প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের তরফ থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু এশিয়াতে নয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের যতটুকু মান রয়েছে, তা ওই ভর্তি পরীক্ষাগুলোর জন্যই। কেননা ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সারা দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েকে যাচাই-বাছাই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। উপরন্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সব ধরনের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত। আমরা কোনোভাবেই চাই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মান নিয়ন্ত্রণের এই জায়গাটি ভেঙে পড়ুক।
লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।
সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা ঘটে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা অর্থাৎ ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। ভর্তি-প্রক্রিয়ায় এত বেশি ভুল ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ভর্তিপরীক্ষা বাতিল করে নতুন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ ডিসেম্বর।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর ‘গ’ ইউনিটে ৯৭৫টি আসনের বিপরীতে ৩৮ হাজার ৮৫৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ৩১ অক্টোবর ফল প্রকাশ করা হলে দুই হাজার ৭২৭ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু এই ফল নিয়ে অভিযোগ উঠলে ২ নভেম্বর পুনর্মূল্যায়িত ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাস করে ছয় হাজার ৯৪ জন শিক্ষার্থী। তবে বাদ পড়ে যায় প্রথমবার মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া ১৯৪ জন শিক্ষার্থী। বাণিজ্য অনুষদের ডিন ও ‘গ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী জামাল উদ্দিন আহমেদ ফল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলেছেন, পরীক্ষা কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্রের মোট ১২টি উত্তরে অসংগতি পায়। এর মধ্যে ছয়টি প্রশ্নে সঠিক উত্তরই ছিল না। আর বাকি ছয়টি প্রশ্নের মূল্যায়ন হয় ভুল উত্তর দিয়ে। সঠিক উত্তর না থাকা ছয়টি প্রশ্নের পূর্ণ নম্বর সব পরীক্ষার্থীকেই দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা মানে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। ভর্তি কমিটি গঠন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, কয়েক সেট প্রশ্ন প্রণয়ন, সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সেট প্রশ্নের সঠিক বা ‘মডেল উত্তর’ প্রণয়ন, কোচিং সেন্টারের উৎপাত ও নজরদারি এড়িয়ে প্রশ্নপত্র ছাপা, ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে অর্ধলক্ষ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ, কম্পিউটারে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে কয়েক দিনের মধ্যে তা নোটিশ বোর্ড ও ওয়েবসাইটে প্রদান করা। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে করে আসছেন। পরীক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো কাজে অধিকাংশ শিক্ষক অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন। ১০ নম্বরের একটি টিউটোরিয়াল বা ক্লাস টেস্ট গ্রহণ করার সময়ও আমরা অনেক সতর্কতা অবলম্বন করি, অথচ বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রমে যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
শিক্ষকদের ভুলের কারণে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল এবং পুনরায় তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের ফলে অনেকগুলো জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, একটি ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য ৭০ থেকে ৮০ লাখ বা তারও অধিক টাকা ব্যয় হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯ ডিসেম্বর নতুন করে যে পরীক্ষাটি গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সেই অর্থের জোগান কে দেবে? দ্বিতীয়ত, হাজার হাজার শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন পড়াশোনা করে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। দীর্ঘদিন পড়াশোনা করে যে মান ও গভীরতর প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ২৮ অক্টোবরের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল, ওই একই ধরনের প্রস্তুতি কি তারা ৯ ডিসেম্বরের ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিতে পারবে? কেননা, ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া, পরে ফল বাতিল হওয়া—সবকিছু মিলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় একটা ছেদ পড়ে গেছে। উপরন্তু, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। তৃতীয়ত, মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত জেনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি অথবা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করার পরও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য মফস্বল ও দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ঢাকা আসেন। এতে কয়েক দিন সময় যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি কিছু টাকা-পয়সাও খরচ করতে হয়। ৯ ডিসেম্বরে নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে টাকা খরচ ও যে সময় নষ্ট হবে, তার ক্ষতিপূরণ কে করবে?
২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতে বাণিজ্য অনুষদের আটটি বিভাগের ১৬ জন শিক্ষক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে আটজন হলেন আটটি বিভাগের চেয়ারম্যান। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নের বাংলা ও ইংরেজি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে করানোর কথা। কিন্তু তাঁরা তা না করে বাণিজ্য অনুষদেরই দুজন শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর এ কারণেই প্রশ্নপত্রে এত ভুল হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সঠিক বা মডেল উত্তরপত্রে ১২টি ভুল! এতগুলো ভুল নিয়ে কোনো পরীক্ষার সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৮ অক্টোবরের পরীক্ষা বাতিল করে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আমরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমরা লজ্জিত, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কতিপয় শিক্ষকের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের জন্য শত শত শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা সে জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও দাবি করছি যে, ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী জামাল উদ্দিন আহমেদ যেন পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন তাঁকে পদচ্যুত করে। আমরা আরও দাবি জানাতে চাই, পূর্বেকার ভর্তি কমিটি বাতিল করে অবিলম্বে যেন নতুন কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই নতুন কমিটির তত্ত্বাবধানে যেন ৯ ডিসেম্বরের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
পরিশেষে আমরা একটা কথা বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশিত মানের পড়াশোনা ও গবেষণা হচ্ছে না। এর ফলে এশিয়ার প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের তরফ থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু এশিয়াতে নয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের যতটুকু মান রয়েছে, তা ওই ভর্তি পরীক্ষাগুলোর জন্যই। কেননা ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সারা দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েকে যাচাই-বাছাই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। উপরন্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সব ধরনের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত। আমরা কোনোভাবেই চাই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মান নিয়ন্ত্রণের এই জায়গাটি ভেঙে পড়ুক।
লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।
No comments