কল্পকথার গল্প-পেয়েও হারানো সেই পরশপাথর by আলী হাবিব
'দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা' বুঝতে না পারার দুর্নামটা বাঙালির আজও গেল না। বাঙালি নাকি অনেক কিছু পেয়েও হারায়। এমন অনেক কিছু আছে, যার জন্য হন্যে হয়, সেই জিনিস আবার হাতের মুঠোয় ধরা দিলে বাঙালি সেটা বুঝতে পারে না। কথায় বলে, 'বাড়া ভাত আর সাধা মেয়ে পায়ে ঠেলতে নেই'-বাঙালি ঠেলতে পারে।
একমাত্র বাঙালিই বোধ হয় পরশপাথর পেয়েও হারায়। কেমন করে পেয়েও হারায়, সেটা বুঝে ওঠার আগে বুঝতে হবে পরশপাথর জিনিসটা কী-খায়, না মাথায় মাখে? পাথরে ভাগ্য ফেরাতে মরিয়া বাঙালি অনেক ধরনের পাথর চেনে। হাতের কোন আঙুলে কোন পাথরটি, কোন ধাতুর আংটি ধারণ করতে হবে-সেটাও বিলক্ষণ জানা। কোন পাথরটি লাল, কোনটা গোলাপি আবার কোনটা সবুজাভ-সেটাও বাঙালির জানা। কেবল চেনে না পরশপাথর।
চিনুক বা না চিনুক, পরশপাথর নিয়ে বাঙালি কবি কবিতা লিখতে ভুল করেননি। কবিশ্রেষ্ঠ রবি ঠাকুরের কবিতায় আমরা পাই এক খেপাকে, যে পরশপাথর খুঁজে খুঁজে হয়রান। 'খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর।/মাথায় বৃহৎ জটা/ধুলায় কাদায় কটা,/মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।' না, কোনো কিছু প্রয়োজন নেই তার। সোনা-রুপা সে তুচ্ছজ্ঞান করে। রাজসম্পদের জন্যও সে কাতর নয়। শুধু একটিবার সে পেতে চায় পরশপাথর। চলার পথে সেই খেপা শুধুই সন্ধান করে এক পরশপাথরের। কোথায় এই পরশপাথর খুঁজে ফেরে সেই খেপা? কোথায় নয়? যখন-যেখানে যে পথে সে হেঁটে যায়, সেখানে সে কেবলই ওই পরশপাথরই খুঁজে বেড়ায়। পাথর ছাড়া কোনো কিছুই যেন তার নজরে পড়ে না। এই যে পাখি গান গায়, সাগরে নদীতে বয়ে যায় তরঙ্গ-কিছুই চোখে পড়ে না তার। সাধুর কটিতে শুধু এক কৌপিন জড়ানো। সেখানে এক শিকল বাঁধা। একটা করে নুড়ি কোথায় পড়ে থাকতে দেখলে সেটা সে কুড়িয়ে নিয়ে ওই শিকলে ঠেকায়। দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। ভারি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন কবিগুরু। তো, একদিনের কথা। সেদিনও রোজকার অভ্যাসমতো চলছিল পরশপাথর খুঁজে ফেরা। একসময় গ্রামের এক বালক তার কাছে জানতে চায়, কোমরের এ সোনার শিকল সে কোথায় পেল-'সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।'
বালকের এ প্রশ্নে চমকে ওঠে সন্ন্যাসী। সে বারবার শিকল হাতে নিয়ে দেখে। দেখে আর বিস্মিত হয়। কোমরে ছিল লোহার শিকল। সেটা কখন যে সোনা হয়ে গেছে, সেটা সে বুঝতেও পারেনি। কপালে করাঘাত করে সে মাটিতে বসে পড়ে। জীবনের অর্ধেকটা সময় যে অমূল্য সম্পদ খুঁজতে সে ব্যয় করেছে, সেটা কখন চলেও এসেছিল তার হাতে; কিন্তু অভ্যাসের বশে সে লোহায় পাথর ঠুকেই গেছে। কখনো তাকিয়ে দেখেনি সে লোহার শিকল সোনা হয়েছে কি না-'কেবল অভ্যাসমত/নুড়ি কুড়াইত কত,/ঠন্ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,/চেয়ে দেখিত না, নুড়ি/দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,/কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশপাথর।' কী সাংঘাতিক কথা! যে পরশপাথর খুঁজতে পথে বের হওয়া, বেছে নেওয়া এই ধূলি-মলিন জীবন, সেই পরশপাথর কখন হাতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে বা কখন সে পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সে, তা তার নিজেরও জানা নেই। পরশপাথর ছুড়ে ফেলে দেওয়ার পর কী অবস্থা দাঁড়াল তার? 'অর্ধেক জীবন খুঁজি/কোন্ ক্ষণে চক্ষু বুজি/স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর,/বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ/আবার করিছে দান/ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর।' সে পরশপাথর বাকি অর্ধেক জীবনে খুঁজে পেয়েছিল কি না, সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত পরশপাথর নষ্ট করার আরেকটি গল্প।
পরশুরামের এ গল্পটির নাম পরশপাথর। গল্পের মূল চরিত্র পরেশ বাবু। পেশায় তিনি উকিল। ওকালতি করে দিবি্ব চলে যাচ্ছিল তাঁর। না, ওকালতিতে খুব যে পসার ছিল তাঁর, তা নয়। পিতৃদেব একটি বাড়ি রেখে গেছেন। বাড়িভাড়া যার দিতে হয় না, তার অনেক চিন্তাই দূর হয়ে যায়। তো, এই পরেশ বাবু এক দিন বাড়ি ফেরার পথে একটি পাথর কুড়িয়ে পেলেন। পাথরটি দেখতে বেশ ভালো। তিনি সেটি কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন। বাড়িতে ফিরে চাবি বের করতে গিয়ে দেখেন, চাবি হলুদ হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলেন দৃষ্টিভ্রম। পরে ভাবলেন, গিনি্ন বোধ হয় চাবি হারিয়ে গোপনে এই বিকল্প চাবি বানিয়ে রেখে দিয়েছে। তিনি বাড়িতে ঢুকে তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে পাথরটা রেখে দিলেন। সন্ধ্যায় ড্রয়ার খুলে তিনি অবাক! টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছুরি ও কাঁচি হলুদ হয়ে গেছে। তিনি বাড়ির নিজের হাতঘড়িটা ওই পাথরে ছোঁয়ালেন। ঘড়ি হলুদ হয়ে গেল। বুঝতে পারলেন তিনি পরশপাথর পেয়ে গেছেন। অমূল্য এ পাথর নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। তিনি একটুও আনন্দ প্রকাশ করলেন না। বাড়ির লোহার কড়িতে ছোঁয়ালেন পরশপাথর, সেটা সোনা হয়ে গেল। ঘটি-বাটিতে ঠেকালেন, সোনা হয়ে গেল। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলেন মোটরভাঙা লোহা। তাতে ঠেকালেন পাথর, সোনা হয়ে গেল। এই সোনা বেচে তিনি জমি কিনে বড় একটা কারখানা করলেন। সোনা বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন। একজন লোক নিয়োগ করে ফেললেন। সে রোজ মণকে মণ সোনা বানায়। পরেশ বাবু সেই সোনা বাজারে বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে জমাতে শুরু করলেন। ব্যাংকে তাঁর টাকা বাড়তে শুরু করল। চারদিকে তখন তাঁকে নিয়ে আলোচনা। পরেশবাবু কোন জাদুমন্ত্র বলে এত সোনা তৈরি করছেন, তা নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা। বিদেশ থেকেও চিঠি আসা শুরু হলো। নাগরিকত্ব দিতেও আগ্রহ প্রকাশ করে ফেলল কোনো কোনো দেশ। সবাই পরেশ বাবুকে পেতে চায়। পরেশ বাবু বছরে লাখ মণ সোনা তৈরি করতে শুরু করলেন। বাজারে সোনার দাম কমে যেতে শুরু করল। এভাবে বেশ চলছিল। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, 'খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে/কাল হলো তার হেলে গরু কিনে।' সে রকমই উকিল পরেশবাবু ওকালতি করে বেশ ছিলেন। কিন্তু পরশপাথর পেয়ে সোনার লোভে বাণিজ্য করতে গিয়ে একসময় খুব বিতৃষ্ণা এসে গেল। তিনি তাঁর সোনারহস্য কর্মচারীর কাছে ফাঁস করে দিলেন। পরশপাথরটা দিয়ে দিলেন ওই কর্মচারীকে। কর্মচারী ছিল একটু অন্যমনস্ক। সে একদিন মনের ভুলে পরশপাথর খেয়ে ফেলল। এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। কেমন করে যেন তার পেটে ওই পরশপাথর হজম হয়ে গেল। পরশপাথর হজম হয়ে যাওয়ার পর পরেশবাবুর তৈরি সোনা সব লোহা হয়ে যেতে লাগল।
পেয়েও হারানোর আরো একটি গল্প বলা যায় কবিগুরুর কবিতা আশ্রয় করে। বলা যাক। কোনো একজন গ্রামের পথে পথে ভিক্ষা করে ফিরছিল। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল একটি স্বর্ণরথ। সেই রথ থেকে নেমে এলেন কোনো এক রাজপুরুষ। সেই রাজপুরুষ রথ থেকে নেমে ভিখারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর? 'আমায় কিছু দাও গো' বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই বিস্মিত ভিখারি নিতান্ত অনিচ্ছায় তার থলের ভেতর থেকে একটা ছোট শস্যদানা তুলে দিল সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে। বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ভিখারি নিজের ঘরে ফিরে ভিক্ষার ঝুলি থেকে সব কিছু বের করতেই দেখে সেখানে চকচক করছে একটা সোনার কণা। তখন তার আক্ষেপের সীমা নেই। 'দিলেম যা রাজ-ভিখারিরে/স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,/তখন কাঁদি চোখের জলে/দুটি নয়ন ভরে-/তোমায় কেন দিইনি আমার/সকল শূন্য করে।'
এটাই বোধ হয় আমাদের জাতীয় ভাগ্য। আমরা পরশপাথর পাই। কিন্তু হজম করে ফেলি। আমাদের সব অর্জন তখন মাটিতে মিশে যায়। জাতীয় জীবনে যেন কোনো কিছুই আমরা ধরে রাখতে পারি না। পেয়েও হারানো যেন আমাদের ললাট লিখন। বুঝতে পারি হারিয়ে যাওয়ার পর। তখন আর ফিরে পাওয়ার কোনো পথ থাকে না। আবার বুঝতে পারি না কাকে, কী দিতে হবে। বুঝতে না পেরে অনেক কিছু দেওয়ার ব্যাপারেই কার্পণ্য করি আমরা। পরে যখন বিষয়টি বোধগম্য হয়, তখন আর নতুন করে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। শিরে করাঘাত করা ছাড়া তখন আর কি বা করার থাকে? 'দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা' বুঝতে না পারলে এমনই তো হয়!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
চিনুক বা না চিনুক, পরশপাথর নিয়ে বাঙালি কবি কবিতা লিখতে ভুল করেননি। কবিশ্রেষ্ঠ রবি ঠাকুরের কবিতায় আমরা পাই এক খেপাকে, যে পরশপাথর খুঁজে খুঁজে হয়রান। 'খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর।/মাথায় বৃহৎ জটা/ধুলায় কাদায় কটা,/মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।' না, কোনো কিছু প্রয়োজন নেই তার। সোনা-রুপা সে তুচ্ছজ্ঞান করে। রাজসম্পদের জন্যও সে কাতর নয়। শুধু একটিবার সে পেতে চায় পরশপাথর। চলার পথে সেই খেপা শুধুই সন্ধান করে এক পরশপাথরের। কোথায় এই পরশপাথর খুঁজে ফেরে সেই খেপা? কোথায় নয়? যখন-যেখানে যে পথে সে হেঁটে যায়, সেখানে সে কেবলই ওই পরশপাথরই খুঁজে বেড়ায়। পাথর ছাড়া কোনো কিছুই যেন তার নজরে পড়ে না। এই যে পাখি গান গায়, সাগরে নদীতে বয়ে যায় তরঙ্গ-কিছুই চোখে পড়ে না তার। সাধুর কটিতে শুধু এক কৌপিন জড়ানো। সেখানে এক শিকল বাঁধা। একটা করে নুড়ি কোথায় পড়ে থাকতে দেখলে সেটা সে কুড়িয়ে নিয়ে ওই শিকলে ঠেকায়। দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। ভারি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন কবিগুরু। তো, একদিনের কথা। সেদিনও রোজকার অভ্যাসমতো চলছিল পরশপাথর খুঁজে ফেরা। একসময় গ্রামের এক বালক তার কাছে জানতে চায়, কোমরের এ সোনার শিকল সে কোথায় পেল-'সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।'
বালকের এ প্রশ্নে চমকে ওঠে সন্ন্যাসী। সে বারবার শিকল হাতে নিয়ে দেখে। দেখে আর বিস্মিত হয়। কোমরে ছিল লোহার শিকল। সেটা কখন যে সোনা হয়ে গেছে, সেটা সে বুঝতেও পারেনি। কপালে করাঘাত করে সে মাটিতে বসে পড়ে। জীবনের অর্ধেকটা সময় যে অমূল্য সম্পদ খুঁজতে সে ব্যয় করেছে, সেটা কখন চলেও এসেছিল তার হাতে; কিন্তু অভ্যাসের বশে সে লোহায় পাথর ঠুকেই গেছে। কখনো তাকিয়ে দেখেনি সে লোহার শিকল সোনা হয়েছে কি না-'কেবল অভ্যাসমত/নুড়ি কুড়াইত কত,/ঠন্ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,/চেয়ে দেখিত না, নুড়ি/দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,/কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশপাথর।' কী সাংঘাতিক কথা! যে পরশপাথর খুঁজতে পথে বের হওয়া, বেছে নেওয়া এই ধূলি-মলিন জীবন, সেই পরশপাথর কখন হাতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে বা কখন সে পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সে, তা তার নিজেরও জানা নেই। পরশপাথর ছুড়ে ফেলে দেওয়ার পর কী অবস্থা দাঁড়াল তার? 'অর্ধেক জীবন খুঁজি/কোন্ ক্ষণে চক্ষু বুজি/স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর,/বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ/আবার করিছে দান/ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর।' সে পরশপাথর বাকি অর্ধেক জীবনে খুঁজে পেয়েছিল কি না, সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত পরশপাথর নষ্ট করার আরেকটি গল্প।
পরশুরামের এ গল্পটির নাম পরশপাথর। গল্পের মূল চরিত্র পরেশ বাবু। পেশায় তিনি উকিল। ওকালতি করে দিবি্ব চলে যাচ্ছিল তাঁর। না, ওকালতিতে খুব যে পসার ছিল তাঁর, তা নয়। পিতৃদেব একটি বাড়ি রেখে গেছেন। বাড়িভাড়া যার দিতে হয় না, তার অনেক চিন্তাই দূর হয়ে যায়। তো, এই পরেশ বাবু এক দিন বাড়ি ফেরার পথে একটি পাথর কুড়িয়ে পেলেন। পাথরটি দেখতে বেশ ভালো। তিনি সেটি কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন। বাড়িতে ফিরে চাবি বের করতে গিয়ে দেখেন, চাবি হলুদ হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলেন দৃষ্টিভ্রম। পরে ভাবলেন, গিনি্ন বোধ হয় চাবি হারিয়ে গোপনে এই বিকল্প চাবি বানিয়ে রেখে দিয়েছে। তিনি বাড়িতে ঢুকে তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে পাথরটা রেখে দিলেন। সন্ধ্যায় ড্রয়ার খুলে তিনি অবাক! টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছুরি ও কাঁচি হলুদ হয়ে গেছে। তিনি বাড়ির নিজের হাতঘড়িটা ওই পাথরে ছোঁয়ালেন। ঘড়ি হলুদ হয়ে গেল। বুঝতে পারলেন তিনি পরশপাথর পেয়ে গেছেন। অমূল্য এ পাথর নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। তিনি একটুও আনন্দ প্রকাশ করলেন না। বাড়ির লোহার কড়িতে ছোঁয়ালেন পরশপাথর, সেটা সোনা হয়ে গেল। ঘটি-বাটিতে ঠেকালেন, সোনা হয়ে গেল। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলেন মোটরভাঙা লোহা। তাতে ঠেকালেন পাথর, সোনা হয়ে গেল। এই সোনা বেচে তিনি জমি কিনে বড় একটা কারখানা করলেন। সোনা বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন। একজন লোক নিয়োগ করে ফেললেন। সে রোজ মণকে মণ সোনা বানায়। পরেশ বাবু সেই সোনা বাজারে বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে জমাতে শুরু করলেন। ব্যাংকে তাঁর টাকা বাড়তে শুরু করল। চারদিকে তখন তাঁকে নিয়ে আলোচনা। পরেশবাবু কোন জাদুমন্ত্র বলে এত সোনা তৈরি করছেন, তা নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা। বিদেশ থেকেও চিঠি আসা শুরু হলো। নাগরিকত্ব দিতেও আগ্রহ প্রকাশ করে ফেলল কোনো কোনো দেশ। সবাই পরেশ বাবুকে পেতে চায়। পরেশ বাবু বছরে লাখ মণ সোনা তৈরি করতে শুরু করলেন। বাজারে সোনার দাম কমে যেতে শুরু করল। এভাবে বেশ চলছিল। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, 'খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে/কাল হলো তার হেলে গরু কিনে।' সে রকমই উকিল পরেশবাবু ওকালতি করে বেশ ছিলেন। কিন্তু পরশপাথর পেয়ে সোনার লোভে বাণিজ্য করতে গিয়ে একসময় খুব বিতৃষ্ণা এসে গেল। তিনি তাঁর সোনারহস্য কর্মচারীর কাছে ফাঁস করে দিলেন। পরশপাথরটা দিয়ে দিলেন ওই কর্মচারীকে। কর্মচারী ছিল একটু অন্যমনস্ক। সে একদিন মনের ভুলে পরশপাথর খেয়ে ফেলল। এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। কেমন করে যেন তার পেটে ওই পরশপাথর হজম হয়ে গেল। পরশপাথর হজম হয়ে যাওয়ার পর পরেশবাবুর তৈরি সোনা সব লোহা হয়ে যেতে লাগল।
পেয়েও হারানোর আরো একটি গল্প বলা যায় কবিগুরুর কবিতা আশ্রয় করে। বলা যাক। কোনো একজন গ্রামের পথে পথে ভিক্ষা করে ফিরছিল। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল একটি স্বর্ণরথ। সেই রথ থেকে নেমে এলেন কোনো এক রাজপুরুষ। সেই রাজপুরুষ রথ থেকে নেমে ভিখারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর? 'আমায় কিছু দাও গো' বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই বিস্মিত ভিখারি নিতান্ত অনিচ্ছায় তার থলের ভেতর থেকে একটা ছোট শস্যদানা তুলে দিল সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে। বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ভিখারি নিজের ঘরে ফিরে ভিক্ষার ঝুলি থেকে সব কিছু বের করতেই দেখে সেখানে চকচক করছে একটা সোনার কণা। তখন তার আক্ষেপের সীমা নেই। 'দিলেম যা রাজ-ভিখারিরে/স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,/তখন কাঁদি চোখের জলে/দুটি নয়ন ভরে-/তোমায় কেন দিইনি আমার/সকল শূন্য করে।'
এটাই বোধ হয় আমাদের জাতীয় ভাগ্য। আমরা পরশপাথর পাই। কিন্তু হজম করে ফেলি। আমাদের সব অর্জন তখন মাটিতে মিশে যায়। জাতীয় জীবনে যেন কোনো কিছুই আমরা ধরে রাখতে পারি না। পেয়েও হারানো যেন আমাদের ললাট লিখন। বুঝতে পারি হারিয়ে যাওয়ার পর। তখন আর ফিরে পাওয়ার কোনো পথ থাকে না। আবার বুঝতে পারি না কাকে, কী দিতে হবে। বুঝতে না পেরে অনেক কিছু দেওয়ার ব্যাপারেই কার্পণ্য করি আমরা। পরে যখন বিষয়টি বোধগম্য হয়, তখন আর নতুন করে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। শিরে করাঘাত করা ছাড়া তখন আর কি বা করার থাকে? 'দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা' বুঝতে না পারলে এমনই তো হয়!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments