অনিয়মের দায় কার?-সরকারি ব্যাংক by বাবুল চৌধুরী
সরকারি ব্যাংকের অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। বেসরকারি ব্যাংকিংও এ থেকে মুক্ত বলা যাবে না। এসব অনিয়মের কোনো কোনোটি যখন দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তখন কালেভদ্রে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টনক নড়ে। না হয় এসব অরণ্যে রোদনই সার হয়।
ইদানীং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের জটিলতা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি বেশ নজরে আসছে। বিশেষ করে অর্থনীতির প্রাজ্ঞ শিক্ষক ড. আরএম দেবনাথের লেখাগুলোতে অনিয়মের কারণ সন্ধান বেশ আগ্রহোদ্দীপক। তবে তার অনুসন্ধানটিও শেষ পর্যন্ত অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো হয়েছে।
সরকারি ব্যাংকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম সবার জানা। হাঁড়ির খবর যাদের জানার কথা নয়, সেই আমজনতাও জানে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বলে এসব ব্যাংকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের প্রভাব থাকেই। জনতা ব্যাংকও এ অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। ব্যাংকে পদোন্নতি, পদায়নের কোনো সুষ্ঠু নীতিমালা নেই। সৎ, দক্ষ কর্মীরা এসব থেকে দূরে। অনেকের ক্ষেত্রে মানবাধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘিত হয়।
তদুপরি, ব্যাংকে অনিয়ম উদ্ঘাটিত হলেও শাস্তি হয় না। আবার কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে শাস্তি হলেও আপিলে মওকুফ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এদের অনেককেই এরিয়ার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ পদোন্নতি এমনকি একসঙ্গে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, এমন প্রমাণও রয়েছে। অডিটে গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে ফাইল নড়ে না। এতে ব্যাংকে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে, সুশাসনের অভাব দেখা দিচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের সুনামের একটি জায়গা হলো, এর চেয়ারম্যান একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ এবং পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে বেশ ক'জন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তারা ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি যুক্ত করে এ ক্ষেত্রে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এতে বাইরে ব্যাংকের সুনাম বেড়েছে। কিন্তু এ সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটানোর পরিমাণ কী হবে এবং তা নির্ণিত হবে কীভাবে তা কারও জানা আছে কি?
কাগজ-কলমে দেখানো হচ্ছে জনতা ব্যাংক বিপুল অঙ্কের মুনাফা করে চলেছে। বাস্তবে ব্যাংকটি প্রতি বছরই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে চলেছে। এতে ব্যাংকের দায় বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, হিসাব ডক্টরিং করে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জনতা ব্যাংককে সচ্ছল ব্যাংক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ড. দেবনাথ বা অন্যদের কাছ থেকে আমরা এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা পাই না।
বিগত এক বছরে জনতা ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণ করেছে। এর অধিকাংশই রুগ্ণ অথবা পচা, যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পও রয়েছে। শুধু তাই নয়, অতিমূল্যায়িত করার পাশাপাশি বিএমআরইএর নামে এসব প্রকল্পে নতুন করে ঋণ মঞ্জুরও করা হয়েছে। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিমালা রয়েছে। ব্যাংক কী পরিমাণ ঋণ দিতে পারবে, ঋণ-আমানত অনুপাত কত হবে, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অনুপাত কত হবে_ এসব নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত এমইউ অনুযায়ী বিধিনিষেধও রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কোন নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এসব ঋণ অধিগ্রহণ ও নতুন ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে? এখানে কি বোর্ডের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? এখানেও ড. দেবনাথ নিরুত্তর।
জনতা ব্যাংক কীভাবে এসব ঋণ অধিগ্রহণ করেছে তা খোলাসা হওয়া উচিত। এই ব্যাংকটি অতীতে লিকুইডিটি সংকটে পড়েনি বলে সুনাম রয়েছে। এই একই ব্যাংককে এখন প্রতিদিন মানি মার্কেট থেকে ১-২ হাজার কোটি টাকা চড়া সুদে কলমানি নিতে হচ্ছে। অথচ নগদ অর্থের সংকট সত্ত্বেও ইচ্ছামাফিক বৃহৎ অঙ্কের ঋণ প্রদান চলছে। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে ঋণ প্রদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণ প্রদানের এহেন অস্বাভাবিকতার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর আমানত সংগ্রহের এক ভয়ঙ্কর খৰ নেমে এসেছে। অথচ এ সংকট সৃষ্টির জন্য তারা মোটেই দায়ী নয়।
এটি ঠিক যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অতীতে দেশের ব্যাংক ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তাদের হাতে আছে সম্মিলিতভাবে ৩০-৩৫ ভাগ। তবে এমন কতগুলো জনস্বার্থসম্পন্ন প্রত্যক্ষ খাতে এসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের বার্ষর্িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তা জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক। এ জন্য বেসরকারি খাতের চেয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় জরুরি এবং সরকারের কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এগুলোর অবদান এখনও এত বেশি।
তাই পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যুক্তিসঙ্গতভাবে দূর করার উদ্যোগ নেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা আনয়ন। ভুল হিসাব দেখিয়ে জনতা ব্যাংকের লাভ বেশি দেখানোর সর্বনাশা ফল ব্যাংকে কর্মরত কর্মীদেরই ভুগতে হবে। সরকারের গৃহীত আর্থিক সংস্থান প্রশ্নেও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় জনতা ব্যাংক ইতিমধ্যেই হাত লাগিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এ ব্যাংকটিকেই। জনতা ব্যাংকের বিজ্ঞ বোর্ড এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যত দ্রুত অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল।
বাবুল চৌধুরী :ব্যাংকার
সরকারি ব্যাংকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম সবার জানা। হাঁড়ির খবর যাদের জানার কথা নয়, সেই আমজনতাও জানে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বলে এসব ব্যাংকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের প্রভাব থাকেই। জনতা ব্যাংকও এ অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। ব্যাংকে পদোন্নতি, পদায়নের কোনো সুষ্ঠু নীতিমালা নেই। সৎ, দক্ষ কর্মীরা এসব থেকে দূরে। অনেকের ক্ষেত্রে মানবাধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘিত হয়।
তদুপরি, ব্যাংকে অনিয়ম উদ্ঘাটিত হলেও শাস্তি হয় না। আবার কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে শাস্তি হলেও আপিলে মওকুফ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এদের অনেককেই এরিয়ার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ পদোন্নতি এমনকি একসঙ্গে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, এমন প্রমাণও রয়েছে। অডিটে গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে ফাইল নড়ে না। এতে ব্যাংকে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে, সুশাসনের অভাব দেখা দিচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের সুনামের একটি জায়গা হলো, এর চেয়ারম্যান একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ এবং পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে বেশ ক'জন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তারা ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি যুক্ত করে এ ক্ষেত্রে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এতে বাইরে ব্যাংকের সুনাম বেড়েছে। কিন্তু এ সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটানোর পরিমাণ কী হবে এবং তা নির্ণিত হবে কীভাবে তা কারও জানা আছে কি?
কাগজ-কলমে দেখানো হচ্ছে জনতা ব্যাংক বিপুল অঙ্কের মুনাফা করে চলেছে। বাস্তবে ব্যাংকটি প্রতি বছরই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে চলেছে। এতে ব্যাংকের দায় বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, হিসাব ডক্টরিং করে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জনতা ব্যাংককে সচ্ছল ব্যাংক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ড. দেবনাথ বা অন্যদের কাছ থেকে আমরা এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা পাই না।
বিগত এক বছরে জনতা ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণ করেছে। এর অধিকাংশই রুগ্ণ অথবা পচা, যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পও রয়েছে। শুধু তাই নয়, অতিমূল্যায়িত করার পাশাপাশি বিএমআরইএর নামে এসব প্রকল্পে নতুন করে ঋণ মঞ্জুরও করা হয়েছে। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিমালা রয়েছে। ব্যাংক কী পরিমাণ ঋণ দিতে পারবে, ঋণ-আমানত অনুপাত কত হবে, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অনুপাত কত হবে_ এসব নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত এমইউ অনুযায়ী বিধিনিষেধও রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কোন নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এসব ঋণ অধিগ্রহণ ও নতুন ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে? এখানে কি বোর্ডের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? এখানেও ড. দেবনাথ নিরুত্তর।
জনতা ব্যাংক কীভাবে এসব ঋণ অধিগ্রহণ করেছে তা খোলাসা হওয়া উচিত। এই ব্যাংকটি অতীতে লিকুইডিটি সংকটে পড়েনি বলে সুনাম রয়েছে। এই একই ব্যাংককে এখন প্রতিদিন মানি মার্কেট থেকে ১-২ হাজার কোটি টাকা চড়া সুদে কলমানি নিতে হচ্ছে। অথচ নগদ অর্থের সংকট সত্ত্বেও ইচ্ছামাফিক বৃহৎ অঙ্কের ঋণ প্রদান চলছে। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে ঋণ প্রদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণ প্রদানের এহেন অস্বাভাবিকতার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর আমানত সংগ্রহের এক ভয়ঙ্কর খৰ নেমে এসেছে। অথচ এ সংকট সৃষ্টির জন্য তারা মোটেই দায়ী নয়।
এটি ঠিক যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অতীতে দেশের ব্যাংক ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তাদের হাতে আছে সম্মিলিতভাবে ৩০-৩৫ ভাগ। তবে এমন কতগুলো জনস্বার্থসম্পন্ন প্রত্যক্ষ খাতে এসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের বার্ষর্িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তা জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক। এ জন্য বেসরকারি খাতের চেয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় জরুরি এবং সরকারের কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এগুলোর অবদান এখনও এত বেশি।
তাই পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যুক্তিসঙ্গতভাবে দূর করার উদ্যোগ নেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা আনয়ন। ভুল হিসাব দেখিয়ে জনতা ব্যাংকের লাভ বেশি দেখানোর সর্বনাশা ফল ব্যাংকে কর্মরত কর্মীদেরই ভুগতে হবে। সরকারের গৃহীত আর্থিক সংস্থান প্রশ্নেও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় জনতা ব্যাংক ইতিমধ্যেই হাত লাগিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এ ব্যাংকটিকেই। জনতা ব্যাংকের বিজ্ঞ বোর্ড এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যত দ্রুত অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল।
বাবুল চৌধুরী :ব্যাংকার
No comments