নিত্যজাতম্‌-তবু আশা জাগে by মহসীন হাবিব

দেশ থেকে নীতি, নৈতিকতা, সততা, আদর্শ দৌড়ে পালিয়ে গেছে। এসব শব্দ মনে হয় যেন বাংলাদেশের ডিকশনারিতেই বসবাস করে। একটি দেশে, বাংলাদেশ নামক একটি বিশাল জনপদে মানুষ জন্মগ্রহণ করছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ লেখাপড়া শিখছেন, কেউ শিখছেন না; কেউ কেউ জীবনে 'সফল' হচ্ছেন, কেউ হচ্ছেন না।


কিন্তু কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আদর্শ, নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কমে গেছে। এই সমাজেরই অলিখিত নিয়ম ছিল, সমাজের মূল স্রোত থাকবে আদর্শের দ্বারা, নীতি পরিচালিত হবে। পাড়ায়, মহল্লায় দেখা যেত, কোটি টাকার মালিক ইটভাটার মালিক, ঠিকাদার, পরিবহন ব্যবসায়ী মান্য করতেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম অথবা পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে। অফিসপাড়ায় দেখা যেত ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত মানুষটিকে অন্যরা সমীহ করে চলে। ওইসব ব্যক্তি আবার পরিচালিত হতো একটি আদর্শের দ্বারা। সে আদর্শ বা নীতি ভ্রান্তই হোক, আর আলোকিতই হোক_সেটাকেই সবাই অনুসরণ করত। কিন্তু এত বড় একটি জনপদে এখন সে ধারাটি আর নেই। সমাজে অতি অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সততা, নৈতিকতা দ্বারা তাড়িত, তাঁরা ক্রমশ গুটিয়ে গেছেন। এমন নৈতিকতাহীন অবস্থা কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও দেখা যায় না। দার্শনিক লক বলেছেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে কোরা কাগজের মতো হয়ে। পারিপাশ্বর্িকতা (এনভায়রনমেন্ট) সেই কাগজের ওপর নানা ছাপ ফেলে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ জন্মগ্রহণ করে যে পরিবেশ, পারিপার্শি্বকতায়, যে কালচারের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠছে, সেখানে সবাই বুঝে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শলিপির কথা, চর্চিত জীবনের সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই। যেন জন্মই আমার আজন্ম পাপ।
এই পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে কত প্রকারে! দুই-একটি উদাহরণ আমাদের বোধে নাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি নাইকো রিসোর্স লিমিটেডের ঘুষ কেলেঙ্কারির বিষয়টির বিচার হয়েছে এমন একটি দেশে, যে দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথায় কথায় বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলে দেওয়া যায়, অ্যালবার্টা কোর্ট অব কুইন্স বেঞ্চ কারো প্রতি পক্ষপাতী হয়ে অথবা কারো কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করে অথবা কোনো রাজনৈতিক চাপে নাইকোর বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেননি। এই রায়ে নাইকোকে করাপশন অব ফরেইন পাবলিক অফিসিয়ালস অ্যাক্টের অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আদালত ২০০৫ সালের সুনির্দিষ্ট ঘটনায় বাংলাদেশের তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে একটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য (আদালতের রায়ে উল্লেখ আছে) গাড়ি 'উপহার' দেয়, যার তৎকালীন মূল্য ছিল ১৯০,৯৮৪ মার্কিন ডলার এবং ক্যালগারি থেকে ব্যক্তিগত নিউইয়র্ক ভ্রমণের জন্য দেয় ৫ হাজার মার্কিন ডলার। ক্যালগারির আদালত এ অভিযোগে নাইকো রিসোর্স লিমিটেডকে ৮২৬০,০০০ ডলার জরিমানা করেন এবং সেই অর্থসহ ১৫ শতাংশ ভিকটিম ফাইন সারচার্জ জরিমানা করেন। সব ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণের পর নাইকোর চেয়ারম্যান এবং সিইও এড স্যামসন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, 'যা ঘটেছে তা ছিল একটি ভুল। আমরা এটা স্বীকার করে নিচ্ছি। এর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব কম্পানির।'
বাংলাদেশের এই সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ব্যাপারে দেশে দুদক একটি তদন্তের ব্যবস্থা করেছে। তিনি দোষী না নির্দোষ, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধ সে বিষয়ে নয়। একটু অন্যত্র। কানাডার আদালতের রায়ের খবর প্রকাশের পর তাঁকে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তিনি দোষী কি না সে ব্যাপারে বক্তব্য দিতে। হঠাৎ দুই-তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের কেন তাঁর কাছ থেকে এটা জানতে চাওয়া জরুরি হয়ে গেল, কেন তাঁর বক্তব্য দেওয়ানোকে তারা জরুরি মনে করল, সেটা কিন্তু অনেক মানুষকে ভাবিয়েছে। যাহোক, মূল কথা হলো, সাবেক এই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর মুখাবয়বে কোনো লজ্জা, কোনো হতাশা দেখা যায়নি! এটাই হলো উল্লেখ করার বিষয়। একজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠলে তিনি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না, এটাই আমাদের সমাজের বহুদিনের কালচার। কিন্তু তিনি টেলিভিশনের মনিটরে জোর গলায় যা বলে গেলেন, তা একেবারে ছেলেমানুষকে বোঝানোর মতো একটি ব্যাখ্যা। তিনি একটি কথাই বারবার জোরের সঙ্গে বলেছেন, আমি কী মাত্র ৫ হাজার ডলার ঘুষ খাব, এটি কী বিশ্বাসযোগ্য কথা!
এ ঘটনায় তিনি যেমন লজ্জা পাননি, জাতিও তেমন লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সামাজিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ধিক্কার ওঠেনি। শুধু তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ রক্ষা কমিটি নাইকো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার চেয়েছে। বাকি সমাজে এর তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।
এবার আসা যাক তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির ব্যাপারে। সরকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আনু মুহাম্মদদের ওপর লাঠি চালায়। এই কমিটিকে টোকাইদের কমিটি বলে মনে করে। এর কারণ কিন্তু দেশের মানুষই। এ দেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হওয়া উচিত তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির ডাকে। কিন্তু তা হয় না। হরতাল হয় শুধু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ডাকা গাড়ি ভাঙার হরতালে।
তার পরও আমরা আশাবাদী। একটি জাতি তার সবটুকু নীতি-আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে টিকে থাকতে পারে না। সম্প্রতি লালমনিরহাটে নবনির্বাচিত আটজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একই মঞ্চে উঠে দল ও মতের উপরে থেকে দুর্নীতিমুক্ত হয়ে এলাকার উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। অভিনন্দন এই আট চেয়ারম্যানকে। প্রান্তিক পর্যায়ে এমন প্রতিশ্রতি শুরু হয়েছে। একদিন হয়তো জাতীয় পর্যায়েও নেতারা এই শপথ নেবেন। যদিও দায়িত্ব গ্রহণকালে এখনো শপথ নেন, কিন্তু সেটাকে তাঁরা 'মিন' করেন না। আনুষ্ঠানিকতা বলেই মনে করেন।
চুরির প্রবণতা পশ্চিমা দেশগুলোতেও যে একেবারে অনুপস্থিত, তা নয়। কেউ কেউ অতি গোপনে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঘুষ ও অনিয়ম করে থাকেন। ধরা পড়লে একদিকে আদালত কর্তৃক ভয়ানক শাস্তির সম্মুখীন হন, অন্যদিকে সামাজিকভাবে ভয়াবহ ঘৃণার সম্মুখীন হন। তাই, অনেকেই ইচ্ছাকে দমন করে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষের মনের ভেতর থেকে এ দুটি ভয় মুছে গেছে। তাই এখানে হারিলুটের চেষ্টাই স্বাভাবিক সমাজের চেহারা হয়ে গেছে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.