উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য কী প্রমাণ করছে?-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর

কিছুদিন থেকে উইকিলিকস বাংলাদেশ সম্পর্কিত কিছু তথ্য ফাঁস করছে। এসব ফাঁস করা তথ্য প্রায় সবই রাজনীতি বিষয়ক। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, এগুলো হলো ঢাকা থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে পাঠানো তাদের নিয়মিত বার্তা বা ফবংঢ়ধঃপয. যেসব বার্তা এভাবে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়ে থাকে সেটা দেখে মনে হয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতের মতো একজন সাধারণ রাষ্ট্রদূত নন।


তিনি হলেন ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল বা ব্রিটিশ সরকারের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেলের মতো কোনো ঔপনিবেশিক দখলদার শক্তির এমন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, যিনি বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে তার তদারকি করছেন, প্রায় সবকিছুই একভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন!
উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া এসব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের লোক এবং সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, ব্যবসায়ী ইত্যাদি সব মহলের লোকই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে ধরনা দিচ্ছেন, তাদের নিজেদের দলের ভেতরকার সব তথ্য প্রদান করছেন, রাজনৈতিক ও দলীয় পরিস্থিতি বিষয়ে নিজেদের মতামত তাদের জানাচ্ছেন! ডিজিএফআই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে দেশের অনেক গোপন তথ্য চালান করছে এবং এসব তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে; তার ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখে সবকিছু যথাসম্ভব পরিচালনা করছে।
উইকিলিকস এই তথ্যগুলো ফাঁস করার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন করছে কি-না এবং সেটা করলে কী উদ্দেশ্যে তা করছে এটা বোঝার মতো অবস্থা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। উইকিলিকসের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের কোনো যোগসূত্র ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়েছে কি-না সেটা জানাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেসব বিষয়ক ও যে পরিমাণ তথ্য ইতিমধ্যে এভাবে ফাঁস করা হয়েছে তার থেকে অনেক কিছুই বোঝার আছে। সব থেকে স্পষ্টভাবে যা বোঝার আছে তা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশে তার গোয়েন্দাগিরি ও নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার করে রাজনীতির গতিপথ বহুলাংশে নির্ধারণ করছে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে অঘোষিত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল এবং ফখরুদ্দীনকে শিখণ্ডী হিসেবে সামনে রেখে এক বেনামি সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত মিত্রদের দ্বারাই পেছন থেকে পরিচালিত হয়েছিল, এটা সেই ঘটনার পূর্বে তাদের অনেক ধরনের তৎপরতা থেকেই বোঝা গিয়েছিল। মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে এখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক মহলের যোগাযোগের যে বিষয়টি উইকিলিকসের পরিবেশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ২০০৭ সালে ঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী ঘটনাগুলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অগোচরে, তাদের প্ররোচনা ও হস্তক্ষেপ ছাড়াই হয়েছিল এই চিন্তা অবাস্তব। শুধু তাই নয়, দুই বছরের বেশি সামরিক শাসনামলে মার্কিন সরকার কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করছিল তার অনেক বৃত্তান্তও এর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।
উইকিলিকসের নতুন নতুন তথ্য প্রায় প্রতিদিনই এখন প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ১৯ সেপ্টেম্বরের পত্রিকায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, ২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনের আগে ডিজিএফআই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মোট ১৪৪ জন নেতাকে নষধপশ ষরংঃবফ বা কালো তালিকাভুক্ত করা প্রসঙ্গে। এর মধ্যে ৪২ জন আওয়ামী লীগের এবং ১০২ জন বিএনপির। ডিজিএফআই কালো তালিকাভুক্ত এই নেতাদের তালিকা তারা এই দুই দলের নেতৃত্বের কাছেই পাঠিয়ে বলেছিল, আগামী নির্বাচনে তাদের যথাসাধ্য মনোনয়ন না দিতে। কিন্তু শুধু বিএনপি বা আওয়ামী লীগকেই নয়, ডিজিএফআই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছেও এই তালিকা প্রদান করেছিল! তিনি যথারীতি ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে এই তালিকা পাঠিয়েছিলেন (উধরষু ঝঃধৎ, ১৯.৯.২০১১)। এর থেকে বোঝা যায়, শুধু বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই নয়, এ দেশের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগও কীভাবে অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে গোপন ও স্পর্শকাতর নানা তথ্য নিয়মিতভাবে পাচার করছিল! এ কাজ যে দেশে করা হয় সে দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকা কি সম্ভব? যদি থাকে তাহলে সে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অর্থ কী?
ডিজিএফআই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে তালিকাভুক্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতাদের যে নাম পাঠিয়েছিল তাতে শেখ হাসিনার এমন কয়েকজন আত্মীয়ের নাম ছিল যারা হলেন তার শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থক। তালিকাভুক্ত সব ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়ার বিরুদ্ধতা না করলেও এই দুর্নীতিবাজদের অনেককেই যাতে মনোনয়ন দেওয়া না হয় এ জন্য ডিজিআইএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম তাদের জানিয়ে দিলেন যে, শেখ হাসিনা দলের মধ্যে থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য তালিকাভুক্ত ৩০ শতাংশ দুর্নীতিবাজকে মনোনয়ন না দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। কালো তালিকায় বিএনপির দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের মধ্যেও এ নিয়ে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। খালেদা জিয়ার ছেলেরা বড় আকারে দুর্নীতি করলেও আজকে পরিবেশিত উইকিলিকসের তথ্যে তার আত্মীয়দের কোনো উল্লেখ নেই।
গত কয়েকদিন থেকে উইকিলিকসে যেসব তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা কীভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে তাকে দলীয় খবরাখবর সরবরাহ করছেন এবং রাজনীতিতে কীভাবে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছেন তার বৃত্তান্ত আছে। আজ জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে। ২০০৬ সালের ৮ আগস্ট মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস স্টেট ডিপার্টমেন্টকে পাঠানো এক তারবার্তায় জানান, এরশাদ তার সঙ্গে দেখা করে বলেন যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য জোট গঠনের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। বাকি আছে জাতীয় নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী কোন আসন থেকে লড়বেন। এরশাদ তাকে আরও বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ দুই নেত্রীকে নিয়ে হতাশ এবং তারা নতুন কিছুর অপেক্ষায় আছে। তারবার্তায় আরও বলা হয়, ২৭ জুলাই ঢাকায় এরশাদের বাসায় তার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বৈঠক হয়। এরশাদ বিউটেনিসকে আরও জানান, বিএনপির সঙ্গে কোনো অঙ্গীকারের আগে তিনি আদালতে বিচারাধীন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলোর প্রত্যাহার দেখতে চান (সকালের খবর, ১৯.৯.২০১১)।
ঢাকা থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের যেসব তারবার্তা উইকিলিকস থেকে ফাঁস করা হয়েছে তার পুরো বৃত্তান্ত এখানে দেওয়া সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও নেই। এ পর্যন্ত যা উল্লেখ করা হয়েছে তার থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী জালের মধ্যে কীভাবে আটকা পড়ে আছে। এ দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বলেও কিছু নেই।
১৯.৯.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.